বাড়িটি তখন সম্পূর্ণ নীরব। রাত প্রায় ১২টার দিকে।। নিশির মায়ের প্রায় ৪০ দিন হয়ে গেল আজ মৃত্যুর। নিশি একা একা বসে মায়ের কথা স্মরণ করছে আর ভাবছে যদি মা তার সাথে থাকতো তখন কতই না ভালো হতো।।
অনেক অনেক দিন আগের কথা যখন এক ছোট্ট গ্রামে বসবাস করত ছোট ছোট পরিবার। যেখানে ছিল শুধু সুখ আর সুখ।। ছিল না ধনী গরিবের মধ্যে কোন পার্থক্য।। গ্রামের সব লোককেই সমান মর্যাদা দেওয়া হতো।
গ্রামের ছোট ছোট সুখ সবাই মিলে আনন্দে উদযাপন করতো।এরকমই প্রথমে মনে হতো।। গল্পের মত যে সব কিছু সুন্দর, সুশৃংখল এবং সুখপূর্ণ হবে তা কিন্তু নয়।। ধীরে ধীরে জানা গেল গ্রামের মূলরহস্য।। ভয়ংকর ছিল গ্রামের সব কথা। গ্রামটি ছিল সম্পূর্ণ জঙ্গলে।। চারপাশ দিয়ে শুধু গাছগাছালি ছিল।। সন্ধ্যা হতেই না হতেই যেন গ্রামটি পুরোই অন্ধকার হয়ে যেত।। সন্ধ্যার সময় গ্রামটিতে গেলে যেন গভীর রাত মনে হতো।।
আর সেই গ্রামে ভুলবশত নিশিতা নামক এক মেয়ের বিবাহ হয়। নিশিতার মা-বাবা ছিল খুবই লোভী প্রকৃতির মানুষ।। ছেলে পক্ষ থেকে যৌতুক দিবে বলে মা-বাবা কোন চিন্তাই করলো না মেয়েকে নিয়ে ।। নিশিতা তখন ছিল অসহায় এক নির্বাক মেয়ের মত।। সে তার মা বাবার কথা কোনো মতোই অস্বীকার করতে পারে না। পরিবারে থাকা মানে তার কাছে মনে হতো এক বন্দীর মতো।।
প্রতিদিনই শিকার হয় সে অন্যায় অত্যাচারে।।
নিশিতার মা-বাবা থাকে এক বৃদ্ধ বয়সী পুরুষের সঙ্গে বিয়ে দেয়।। তখন নিশিতার ছিল ১০ বছর।। গ্রামের লোকের কাছে সে বড্ড বড়।
আর এইসব কারণেই নিশিতার বিয়ে হয় ওই গ্রামে।
বিয়ের পর নিশিতার খুব ভয় করতে ওই গ্রামের।। তার বর ছিল খুবই অত্যাচারী পুরুষ। মার তো করতেই সাথে কত রকমের গালিগালাজ করতো।।
নিশিতার বেশিরভাগ সময়ই কেঁদে কেঁদে কাটত।।
তারই এক প্রতিবেশী ছিল খুবই ভালো প্রকৃতির মানুষ। তার নাম ছিল নয়ন। যখন নিশিতার বয়স ১৫, তখন নয়নের বয়স ১৮..
নয়ন নিশিতার উপর চলিত অত্যাচার দেখে খুবই কষ্ট পেত।। নয়ন নিশিতাকে মনে মনে খুবই পছন্দ করত। তার মনে হতো সে যেন নিশিতাকে নিয়ে দূর এক অজানা শহরে চলে যায়। এই গ্রামে সেই নিশিতাকে রাখতে চায় না। নয়নের মা-বাবা কেউ ছিলনা।। সে একাই গরু রাখালী করে দিন কাটাতো।। গ্রামে সে থাকতে চাইতো না কারণ নিশিতার উপর এত অত্যাচার করে তার স্বামী তারপরেও গ্রামবাসীরা একটুকু প্রতিকার করতে চাইতো না।। মাঝে মাঝে নয়ন এসব কথা নিয়ে নিশিতার স্বামীর সাথে কথা বলতো কিন্তু নিশিতার স্বামী কয়েকজন লোকে নিয়ে তাকে মারধর করেন এবং বলে এসব বিষয় থেকে সে যেন দূর থাকে।। তারপরেও নয়ন নিশিতাকে খুব পছন্দ।।
একদিন ঘটলো এক ঘটনা।। নিশিতার গর্ভে ছিল এক কন্যা সন্তান। আর ঐদিনই কন্যা সন্তানটি জন্মগ্রহণ করেন। নিশিতার স্বামী সব সময় চাইতো তার যেন পুত্র সন্তান হয়। কিন্তু আজ কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করায় নিশিতার স্বামীর খুব রাগ হয় এবং নিশিতাকে প্রচন্ড মারধর করে।। কিন্তু তখন নয়ন তাকে বাঁচানোর জন্য আসে।।
তখন নিশিতার স্বামী নিশিতাকে ছেড়ে নয়নকে মারতে শুরু করে। নয়ন মার খেয়েও স্বাভাবিক থাকে কারন সে মনে করে যাই হোক নিশিতা তো বেঁচে গেল.........................।।
তারপর কয়েক বছর কেটে গেল।। আর সে
নিশিতার মেয়ের নাম রাখা হয়েছিল নিশি ।। নিশি এখন অষ্টম শ্রেণীর একটি ছাত্রী।।
একদিন নিশিতা দেখলো নয়ন তাকে চুপিচুপি দেখছে।। তখন নিশিতা ভয় পেল যে তার স্বামী যদি তাকে দেখে তাহলে নয়নকে মেরে ফেলবে।। আর তার জন্যই সে নয়নকে বলে রাত্রে দেখা করার জন্য যাতে কেউ তাদেরকে একসাথে না দেখে ।। ওই গ্রাম তো গাছ গাছালি দিয়ে ঘেরা তাই সন্ধ্যা হতেই না হতে রাত হয়ে গেল।। তখন নিশিতা নয়নের সাথে দেখা করতে যায় পুকুর পাড়ে।।নিশিতা যখন বাড়ি থেকে বের হয় তখন তার স্বামী জসিম নিশিতাকে দেখে ফেলে এবং নিশিতার পিছে পিছে পুকুর পাড়ে যেতে থাকে।।
যখন নিশিতা পুকুর পাড়ে যায় তখন সে দেখতে পারে নয়ন তার জন্য অপেক্ষা করছে, সে সেখানে যায় এবং বলে - " আমার পারিবারিক জীবনে যাই হোক না কেন তুমি কেন তা নিয়ে ব্যস্ত? তুমি আমার জন্য নিজের জীবনকে নষ্ট করো না"
তখন নয়ন জবাব দেয় নিশিতাকে-"" তোমার এই মারধর আমার পছন্দ নয়। দয়া করে তুমি এ সম্পর্ক থেকে চলে আসো এবং নিজে ও নিজের মেয়েকে নিয়ে
সুন্দর ভাবে জীবন যাপন করো "" নিশিতা কিছু বলার আগেই জসিম তাদের সামনে আসে এবং দানবের মতো চিৎকার করতে থাকে।। জসিমের চিৎকার শুনে গ্রামের সব লোক পুকুর পাড়ে চলে আসে।। তারা সেখানে দেখে জসিম, নয়ন এবং নিশিতাকে।। গ্রামবাসীরা জসিমকে জিজ্ঞাসা করল কেন সে চিৎকার মারছিল।। জসিম তাদের উপর কত মিথ্যা ও খারাপ কথা ছুড়ে মারে।। এতে নিশিতা খুব কষ্ট পায়। এবং গ্রামবাসীদের কে বলে যে এসব কিছুই নয়। আমি আপনাদেরকে সবকিছু খুলে বলছি , নিশিতা বলে।। নিশিতা কিছু বলার আগেই জসিম বলে ওঠে নিশিতা ও নয়ন নাকি পালানোর জন্য তৈরি হয়েছে।।
তখন গ্রামবাসীরা খুব রাগান্বিত হয়ে একটি পরিকল্পনা করে।। এবং জসিম এই পরিকল্পনা শুনে খুবই খুশি হয়।। গ্রামবাসীরা পরিকল্পনা করেন যে নয়ন ও নিশিতাকে একসাথে পুড়িয়ে ফেলার জন্য।। নয়ন ও নিশিতা খুব জোরে জোরে কান্না করে ও তাদের কাছে মাফ চায়।। কিন্তু গ্রামবাসীদের নিষ্ঠুর মন তাদের জন্য একটুকুও পালটিলনা। জসিম তাতে বড্ড খুশি, তার খুশিতে তার চোখ মুখ জল জল করতে লাগলো।। নিশিতা তা দেখলো কিন্তু সে সম্পর্কে সে কিছুই বলতে পারলো না। সে শুধু তার মেয়ে নিশি কে নিয়ে চিন্তায় মগ্ন। সে নিশির ভবিষ্যতের কথা ভেবে কান্না শুরু করে এবং গ্রামবাসীদের কাছে ভিক্ষা চায়।।সে বলে এই গ্রাম ছেড়ে সে বহু দূরে চলে যাবে কিন্তু তাকে যেন না মারা হয়।। তারপরেও গ্রামবাসীরা কিছুতেই তার কথা শুনল না। নয়ন ও নিশিতাকে জ্বালানোর জন্য ব্যবস্থা নিল গ্রামবাসীরা। নয়নও কাঁদতে থাকে নিশিতা ও নিশির জন্য।
তাদেরকে হাত পাবে বেঁধে গাছের সাথে আটকানো হলো। কয়েক ঘন্টা পর তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হলো পুকুর পাড়ের একটি বট গাছের নিচে এবং ওই গাছের সঙ্গে তাদের দুইজনকে বাধা হলো। তাদের দুজনের উপর কেরোসিন ঢালা শুরু করল। ওই সময় গ্রাম জুড়ে যেন শুধু নয়ন ও নিশিতার কান্না শোনা যায়। নিশিও তার মায়ের কান্না শুনতে পায় কিন্তু সে ওখানে যেতে পারেনা কারণ তাকে জসিম তাদের ঘরে তালা দিয়ে আটকে রেখেছিল। তারপর গ্রামবাসীরা নিশিতা ও নয়নকে নির্মমভাবে আগুনের পুড়িয়ে ফেলে।কয়েক মিনিট পর গ্রামটা একদম নিস্তব্ধ হয়ে গেল।।
গ্রামবাসীরা এরকম দুইজন জলন্ত মানুষ রেখেই তারা তাদের ঘরে চলে গেল। তাদের মনে একটুকু আফসোস হলো না যে নিষ্পাপ দুইজন ব্যক্তিকে নির্মমভাবে হত্যা করলো। কয়েকদিন পর তারা ঠিক আগের মত স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে লাগল। আর এরই মধ্যে দিয়ে জসিম তার নতুন জীবন শুরু করতে চায়, মানে সে আবার নতুন বিয়ে করতে চায়। সে এমনিতে তো বৃদ্ধ,কোন দিন যে সে মরে যায় কে জানে... তারপরেও রাজা বাদশাদের মত শখ তার।
আর ওপর দিকে নিশি বারি মন নিয়ে তার পড়াশুনা চালিয়ে গেল। কিন্তু তাতেও সহজ ছিল না, ছিল না থাকে সাহায্য করার মত মানুষ। মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করে সে তার পড়ালেখা চালায়, কাজ করলেও সে শান্তি পেত না..শুনতে হতো কঠোর কটুকথা।। বিশেষ করে তার মাকে নিয়ে লোকেরা অনেকেই অনেক কথা বলতো। সেসব কথা সে শুনেও না শোনার ভান করতো। এসব না করেও সে যাবে কোথায়? কি করবে সে? তার সাথে আছে কি কোন লোক? মনে তার কত প্রশ্ন।।
কিন্তু সে জানতো তার মা কেমন ছিল। সে তাকে ততটুকুই ভালোবাসতো যতটুকু তার মা তাকে বসত।
কয়েকদিন পর গ্রামবাসীদের মধ্যে শুরু হয় নানা রকমের কথাবার্তা। তখন দিনটি ছিল ৪০ তম দিন নিশিতার মৃত্যুর। গ্রামবাসীরা শুধু শুনতে পায় নিশিতা ও নয়নের কান্না। অনেকের স্বপ্নতে আসে নিশিতা ও নয়ন।
ওই রাতেই জসিম ছিল ঘুমিয়ে। ঘড়িতে প্রায় ১২ টা.. নিশি তার রুমে পড়ালেখা শেষ করে তার মায়ের কথা ভাবচেয়ে আর মনে মনে বলছে - মা যদি এখানে থাকতো তাহলে কতই না ভালো হতো। হঠাৎ করে নিশি রসিমে চিৎকার শুনতে পায় এবং সে দৌড়ে তার বাবার রুমে যায়। সেখানে গিয়ে সে দেখে তার বাবা কাঁপতে শুরু করে এবং বলে- কে যেন আমাকে ডাকছে ওই জানালার দিকে। কি ভয়ংকর ওর চেহারা। নিশী তখন তার বাবাকে শান্ত করে ঘুমিয়ে যাওয়ার জন্য বলল। এবং সে বেশি একটা পরুয়া না করে সেখান থেকে তার রুমে চলে যায়। নিশির মা মরার পর থেকে সে তার বাবাকে তেমন একটা পছন্দ করে না।
গ্রামবাসীরাও অনেক ভয় পেতে লাগলো। ওই পুকুর পাড়ের কাছে কেউ যেতে চাইলো না। পুকুরটাও দিনে দিনে আরও ভয়ংকর হতে লাগলো।। প্রতিদিনের এই কান্নার শব্দ শুনে গ্রামবাসীরা পালানোর কথা ভাবে কিন্তু তারপরেও তারা কোনভাবেও এই গ্রাম ছেড়ে যেতে না।। গ্রামবাসীরা ও জসিম তার ভুল বুঝতে পারল। একদিন তারা সবাই মিলে নিশিকে নিয়ে ঐ পুকুর পাড়ে যায় এবং পরিকল্পনা করে যে যদি তারা নয়ন ও নিশিতাকে দেখে তাহলে তারা ক্ষমা চাইবে।। তারা যখন পুকুর পাড়ে যায় তখন ঐ বট গাছের নিচে নিশিতা ও নয়নকে জলন্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকা দেখে গ্রামবাসীরা কাঁপতে শুরু করে। নিশি এসব দেখে পুরোই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে, গ্রামবাসীরাও কান্না শুরু করে তাদের কাছে ক্ষমা চাইতে লাগল।
তখন নিশিতা খুব জোরে জোরে কেঁদে ভয়ংকর কন্ঠে বলতে লাগলো - আমার ছোটবেলা থেকেই জীবন ছিল না সুন্দর , ছিল না সুখের, ছিল না মা-বাবার মায়া-মমতা।। কেন তোমার আমাকে এই নির্মমভাবে হত্যা করলে?? কি দোষ ছিল আমার? যাই হোক এখন এইসব নির্ভর করে আমার মেয়ে নিশির উপর, সে যদি চায় তোমাদেরকে ক্ষমা করতে তাহলে আমিও ক্ষমা করে দেবো। নয়নও নিশিতার মতে একমত। তখন নিশিতার মেয়ে নিশি কান্না করতে করতে বলে -- মা তুমি ওদেরকে ক্ষমা করে দাও. তোমার সাথে যারা এমন করেছে তুমিও যদি তাদের সাথে তেমনি কর তাহলে তোমার আর তাদের মধ্যে পার্থক্য রইল কোথায়। আমি জানি মা তুমি ওদেরকে ক্ষমা করে দিবে। আমিও তাদেরকে এখন ক্ষমা করে দিলাম।আর আমি মনে করি এখন তারা তাঁদের ভুল বুঝতে পারছেন।
তারপর তারা আবারও তাদের কাছে ক্ষমা চাইলেন।
এবং পরিশেষে নিশিতা ও নয়ন সবাইকে ক্ষমা করে দিল।।
সবশেষে সবাই এখন শান্তিতে বসবাস করতে লাগলো। এখন জসিম ও তার মেয়ের প্রতি যত্নশীল হল। আর বর্তমানে নিশি এখন একজন পরিপূর্ণ দক্ষ ডাক্তার। সে গ্রামবাসীদের বিনা টাকাতে চিকিৎসা দেয়।।
গ্রামবাসীরাও এখন নিশিকে খুব ভালোবাসে....
সেই পুকুর পাড় ও বটগাছ
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
222
Views
7
Likes
1
Comments
4.8
Rating