বিচ্ছেদ (পর্ব: ০১)

অডিও মোড

00:00 00:00
গতি:
ভলিউম:
একটা রোদেলা বিকেল। ঢাকার অদূরে একটি ছোট শহরে বাস করতেন আসিফ৷তার পুরো নাম আসিফ বিন আমজাদ আলী৷ আসিফ এর গায়ের রঙ শ্যামলা,দেখতে খুব সুদর্শন৷ সে লম্বায় প্রায় ছয় ফিট এর কাছাকাছি৷ আসিফের বাবার নাম আমজাদ আলি৷তার বাবা ছিলেন একজন ব্যবসায়ী৷ তার মা আরশিয়া জাহান৷ তিনি একটি স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন৷
আসিফ একজন মুক্তমনা লেখক, যার লেখায় ছিলো কল্পনা আর বাস্তবতার মিশ্রণ। সে তার আঁকা ছবিতে ও বাস্তবতার দৃশ্য তুলে ধরতো৷ তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ভালোবাসা ছিলো লেখালেখি,ছবি আঁকা,এবং বই পড়া৷ কিন্তু সেই ভালোবাসারও একটা সীমা ছিলো। তাঁর মনে ছিলো একটা শূন্যতা, যা তিনি কখনোই পূরণ করতে পারেননি।আসিফ বড় হয়েছে ওর দাদা দাদির কাছে৷
আসিফ ছোট থাকতেই আসিফ এর মা বাবা দুজনেই মারা যান৷ সাত বছর বয়সে আসিফ এর বাবা মারা যান৷ আট বছর বয়সে আসিফ এর মা মারা যান৷ এরপর থেকেই আসিফ ওর দাদা দাদির কাছেই মানুষ হতে থাকে৷ সব খরচ আসিফ এর দাদা বহন করতো৷ আসিফ এর দাদা একটা ছোটো ব্যাবসা করতেন৷ তাদের কয়েক জায়গায় কাপড়ের দোকান ছিলো৷ সেখান থেকে ভালো টাকা আসতো৷
আসিফ এর বাবা মা দুজনেই ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন৷ আসিফ এর বাবা একদিন আসিফকে স্কুলে দিয়ে আসার সময়, গাড়ির অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়৷ এরপর থেকে আসিফ এর মায়ের জীবনে শোকের ছায়া নেমে আসে৷ এরপর আরশিয়া জাহানের স্কুলের চাকরিটাও চলে যায়৷ কারন সে কোনোভাবেই তার কাজে মন দিতে পারছিলো না৷ আসিফ খুব ছোট থাকার কারনে বুঝতো না তার বাবা কেনো নেই তাদের সাথে৷ তার মা তাকে সান্তনা দিয়ে বলতো,বাবা এক কাজে গিয়েছে খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন আমাদের কাছে৷আসিফ এর মা এই কষ্ট,শোক সহ্য করতে না পেরে এক বছর এর মাথায় সে ও মারা যায় ব্রেইন স্ট্রোক করে৷ এরপর থেকেই আসিফ একা হয়ে পড়ে৷ বড় হতে হতে আসিফ বুঝতে পারে তারা বাবা মা যে মারা গিয়েছেন৷
অনেক বছর চলে গেছে তার মা,বাবা নেই৷ সে যখন তার মা,বাবার কথা মনে করে তার ভেতরে ভেতরে খুব কষ্ট হয়৷ এমনটা না হলে ও পারতো৷ দিন গুলো আরো সুন্দর হতে পারতো৷ তার বাবা, মা আজ থাকলে হয়তো অনেক গর্ব করে বলতো তার ছেলে অনেক বড় লেখক হয়েছে৷
আসিফ মাস্টার্স শেষ করেছে সবে মাত্র৷ আসিফ এর বর্তমান বয়স উনত্রিশ৷আসিফ একদিন একটি নতুন গল্পের প্লট নিয়ে চিন্তা করছিলেন।তো আসিফ ভাবছে আজ একটু বই মেলায় যাবে৷ আসিফ ওর সবচেয়ে যেই ভালো বন্ধু মিনহাজ ওকে কল করে৷
আসসালামু আলাইকুম, মিনহাজ কইরে তুই মামা?
মিনহাজ উত্তরে বলে, ওয়ালাইকুম আসসালাম মামা আমিতো বাসায়৷ কিছু হইছে?
আসিফ: না মামা কিছুতো হয় নাই৷ আজকে আমি ফ্রি৷ তো আমি ভাবলাম বই মেলায় যাওয়া যাক তোর সাথে৷ তাই তোরে কল দিলাম৷ তুই কি ফ্রি?
মিনহাজ: হ্যা মামা আমিতো ফ্রি৷ তাহলে সন্ধ্যায় চল একসাথে যাই৷ আমি তাহলে ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ এর মধ্যে তোর বাসায় আসি?
আসিফ: হ্যা আয় তাহলে এটা আবার জিজ্ঞেস করা লাগে৷ যখন খুশি আসবি৷
মিনহাজ: আচ্ছা ঠিকাছে ফোন রাখ তাহলে আমি আসতেছি৷
আসিফ ফোন রাখে৷ বাহিরে আসরের আযান দিচ্ছে৷ আসিফ ওযু করতে চলে যায়৷ আসিফ ওযু করে এসে আসরের নামাযটা পড়ে ফেলে৷ কিছুক্ষণ তসবি জপে পরে রেডি হতে থাকে৷ আসিফ চেষ্টা করে পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ার৷ পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়তে না পারলে ও তিন চার ওয়াক্ত ঠিকি পড়ে ফেলে৷ পনেরো কি বিশ মিনিট পরে দরজায় ঠকঠক আওয়াজ৷ ও বেলের আওয়াজ শোনা যায়৷ আসিফ গেট খুলে মিনহাজকে দেখতে পায়৷ তারা দুজন দুজনকে অনেক মাস পরে দেখেছে৷
আসিফ বলে,"ভেতরে আয় তাড়াতাড়ি বাহিরে দাঁড়িয়ে এভাবে তাকিয়ে আছিস কেনো"?
মিনহাজ বলে, আচ্ছা দাঁড়া ঘরের ভেতরে ঢুকে নেই তারপর বলছি কেনো তাকিয়ে আছি৷ তো নিজেকে এমন সন্ন্যাসী বানিয়ে রেখেছিস কেনো৷ মাথা ভর্তি চুল,মুখ ভরা দাঁড়ি তোকে দেখেতো মনে হচ্ছে রাস্তার পাগল,কত বছর গোসল করিস না এমন মনে হচ্ছে৷ খাওয়া দাওয়া কি করেছিস?
কিসব যে বলিস রে ভাই৷ খাওয়া-দাওয়া ও করেছি,গোসল ও করেছি৷ আসলে সেলুনে যাবো যাবো করে আর যাওয়াই হচ্ছে না৷ বইমেলা থেকে ঘুরে পরে যাবো সেলুনে৷ এখন কি বের হবি নাকি আরো পরে বের হবি৷ রাস্তায় প্রচুর জ্যাম৷ বাহিরে ও হাল্কা হাল্কা ঠান্ডা৷ চাদর নেবো নাকি হুডি পড়বো ভাবছি৷
মিনহাজ বলে, শোন,শোন তুইতো লেখক মানুষ৷ তুই একটা কালো পাঞ্জাবি পড়, আর সাদা প্যান্টটা পড়৷ আর ঠান্ডা আছে যেহেতু বাহিরে তাহলে চাদরটাই নে৷ হেব্বি লাগবে তোরে মামা৷ মেয়ে সব পাগল হয়ে যাবে তোর প্রেমে৷ ইসস আমি নিজেই মনে হয় পাগল হয়ে যাচ্ছি৷
আসিফ হেসে বলে,ছি! ছি! ছি! বন্ধু তোর থেকে এসব আশা করিনি৷ তুই দিন দিন এমন হয়ে যাবি আমার পরিকল্পনার বাহিরে ছিলো৷ ছি!
মিনহাজ তখন বলে উঠে,যা বাবা আমিতো শুধু বললাম তুই কতো কিছু চিন্তা করে ফেললি৷ তুই একটা নষ্ট৷ যেহেতু বলেছিস আয় তোরে এক চুম্মা দেই৷ দেখ কেমন লাগে৷
আসিফ দৌড়ে পাশের রুমে চলে যায়৷ থাক তুই আমি চেঞ্জ করে আসি৷
ঠিকাছে মামা যা, য৷
আসিফ আলমারি থেকে কালো পাঞ্জাবিটা বের করে৷ সাদা প্যান্টটা বের করে আর চাদর৷ চাদরটা দেখতে বেশ ভালোই৷ সাদার মধ্যে ধূসর রঙের৷ আসিফ,পাঞ্জাবি আর সাদা প্যান্ট পড়ে নেয়৷ এরপর চুল আছড়ে নেয় ভালোভাবে৷ দাঁড়ি গুলোকেও আছড়ে নেয়৷ চুলে একেবারে হাল্কা তেল দিয়ে নেয়৷ দু এক
টা চুল পেঁকে গেছে৷ তেল দেওয়ার কারনে তা আর বোঝার উপায় নেই৷ এবার চাদরটিকে ভালোভাবে পেচিয়ে নেয় শরীরের৷ এরপর একটু পারফিউম লাগিয়ে রুম থেকে বের হয়ে মিনহাজের কাছে যায়৷ মিনহাজতো দেখে পুরো থ মেরে বসে গেছে৷
মামা তোরে নায়কের মতো লাগতেছে৷ মাশাল্লাহ নজর না লাগুক৷ এখন তোকে দেখে বুঝা যাচ্ছে তুই একজন লেখক৷ সেই লাগতেছে সেই৷ আজকে মনে হয় আমার কপালে কোনো মেয়ে নাই৷ আজকে সবাই তোর দিকেই তাকায়া থাকবে৷
আসিফ বলে,হ্যা এখন বের হই চলেন৷ অনেক তেল মারা হইছে আমাকে৷ আর তেল মারতে হবে না৷ মিনহাজ বাহিরে বের হয়৷ আসিফ দরজায় তালা লাগিয়ে তারা দুজন একসাথে নিচে নামতে থাকে৷ রাস্তায় কিছুক্ষন হাঁটতে থাকে৷ একটা রিক্সা ও নেই৷ কেউই জ্যামের কারনে যেতে চায় না৷ ফেব্রুয়ারি মাস৷ রাস্তায় জ্যাম থাকবে৷ বই মেলার সামনে ভালোই ভীড় হবে৷একটু সামনে যেতেই এক রিকশাওয়ালা মামাকে মিনহাজ ডাক দেয়৷
এই মামা যাবা,সোহরাওয়ার্দী উদ্যান৷
যামু মামা, একশ পঞ্চাশ টাকা দিবেন৷ এর এক টাকা কমে আমি যামু না৷
মামা একশ বিশ টাকা দিবো৷চলো
না মামা আমি একশ পঞ্চাশ টাকায় যামু৷ একশ বিশ টাকায় যামু না৷
আসিফ মিনহাজকে বলে ভাই আর দামাদামি করিস না৷ এবার চল৷ আসিফ ধাক্কা দিয়ে মিনহাজকে রিকশায় ওঠায়৷ ঘড়িতে ছয়টা প্রায় ভেজেই গেছে৷ শাহবাগে এতো জ্যাম কখন পৌছাবো৷ আল্লাহ ভালো জানেন৷
মিনহাজ বলে,দেরিতো হয়েছে তোর জন্য৷ তুই সময় বেশি নিয়েছিস৷

হয়েছে এখন চুপ থাক বকবক করিস না৷ রাস্তায় বেশি জ্যাম থাকার কারনে এক ঘন্টার মতো লেগেছে তাদের বই মেলায় যেতে৷ তারা বই মেলায় ঢুকতেই আসিফকে দেখে অনেক ছেলে মেয়ে আসছে তার সাথে ছবি তুলার জন্য৷
কয়েকজন এসে বলতে লাগলো, স্যার আমি আপনার অনেক বড় ফ্যান৷ আমি আপনার সবকটি বই পড়েছি৷ কেউ কেউ অটোগ্রাফ নিচ্ছে বইয়ে৷ আবার কেউ কেউ পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে৷

ছবিগুলো মিনহাজ তুলে দিচ্ছিলো৷ দেখেছিস ভাই আমার কথাই সত্যি হলো৷ আজকে তোর জন্য আমি মেয়ে ভাগে পাবো না৷ সবাই তোর সাথে কতো সুন্দর সেল্ফি তুলছে,অটোগ্রাফ নিচ্ছে আমাকে কেউই পাত্তা দিচ্ছে না৷ দে আমাকে ও অটোগ্রাফ দে৷ আমার সাথে ও ছবি তুল৷ আমার হিংসা হচ্ছে তোকে দেখে এখন৷

আসিফ মিনহাজকে বলে,"চুপ ব্যাটা তুইতো আমার প্রানের বন্ধু" এভাবে বলছিস কেনো৷ আমার অনেক বন্ধুবান্ধব আছে আমি তাদের সাথে তেমন মিশি না৷ আমি জানি তারা শুধু আমার সাথে আছে ফেমের জন্য৷ আর তুইতো আমার সেই স্কুল থেকে বন্ধু৷ সব বিপদ আপদে আমি তোকে সবসময় পাশে পেয়েছি৷

মিনহাজ বলে, যাক এখন মনে শান্তি লাগছে আমার৷ আবার কিছুক্ষণ পরে আরো কয়েকজন আসে আসিফের সাথে ছবি তোলার জন্য৷ তারা সবাই ছবি তুলছে৷ আসিফ এর চোখ পড়ে এক মেয়ের দিকে৷ মেয়েটি ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে আসিফের দিকে৷ আসিফ লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে বার বার৷ মেয়েটির পড়নে হলুদ গাউন, চুল গুলো এলো-মেলো হয়ে গিয়েছে৷ স্লিপার পড়েছে৷ মেয়েটি একটু হেলদি৷ দেখতে ভালোই লাগছে আসিফ এর৷ ছবি তোলা শেষে আসিফ তখন দেখলো ঐ মেয়েটি ওর বান্ধবীর জন্য দাঁড়িয়ে আছে৷ মেয়েটিকে আসিফের ভালো লেগে যায়৷ তো সবাই যাওয়ার পর ঐ মেয়েটির বান্ধবীকে জিজ্ঞেস করে আচ্ছা ও তোমার কি বান্ধবী হয় তাই না?
মেয়েটি উত্তরে বলে হ্যা কেনো?

আমি একটা কাজ দিলে করতে পারবে? মেয়েটি জিজ্ঞেস করে কি কাজ?আচ্ছা৷ আগে বলো তোমার নাম কি?
আমার নাম রুবা৷ আচ্ছা রুবা শুনো তুমি তোমার বান্ধবীকে একটু কষ্ট করে এদিকে ডেকে আনবে?
রুবা রাজি হয়ে গেলো৷ রুবা ডাকছে,মেঘ এই মেঘ এদিকে আয় মেঘ বিরক্ত নিয়ে সামনে আসে৷

কি হয়েছে,কি সমস্যা এভাবে ডাকছিস কেনো৷ চল বাসায় অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে আটটার কাছাকাছি বাজছে৷ যেখানেই যাস সেখানেই আটকা পড়িস৷ আজব৷
আসিফ বলে আমি ডেকেছিলাম আপনাকে৷ ওনার দোষ নেই৷

মিনহাজ শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে কি হচ্ছে৷
কেনো ডেকেছেন আপনি আমাকে৷ রুবা চলো আর দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না৷
আহা দাঁড়ান না এমন করছেন কেনো৷ আচ্ছা আপনার নাম কি?

কেনো আপনি আমার নাম শুনেননি? একটি আগে চিৎকার করে ডাকছিলো যে৷
এতো ক্ষীপ্ত হচ্ছো কেনো৷ একটু ঠান্ডা মাথায় কথা বললে কি হয়?

মেঘ বলে,বলেন কি বলবেন৷
আসিফ বলে, আপনি কিছু মনে না করলে আপনার মোবাইল নাম্বার বা ফেসবুক আইডি দেওয়া যাবে৷
মেঘ বলে,মোবাইল নাম্বার দিতে পারবো না৷ ফেসবুক আইডি দিতে পারি৷

আসিফ বলে,আচ্ছা তাই দিন আপনি৷
মেঘ ওর ফেসবুক আইডি সার্চ করতে বলে,
মেঘ এর ফেসবুক আইডির নাম, "মেহেরীম তাসনিম মেঘ"৷
আসিফ প্রশ্ন করে এটা কি আপনার আসল নাম নাকি ফেসবুক আইডি তে নাম দেওয়ার জন্য এটা দিয়েছেন৷
মেঘ রাগ দেখিয়ে বলে,এটাই আমার আসল নাম৷ নিজের নাম থাকতে বানানো নাম ব্যবহার করবো কেনো যত্তসব৷
এই বলে রুবার হাত টেনে নিয়ে চলে যেতে থাকে মেঘ৷
আসিফ মেঘের দিকে তাকিয়ে মেঘের চলে যাওয়া দেখতে থাকে৷

চলবে!
572 Views
14 Likes
3 Comments
3.6 Rating
Rate this: