পর্ব-১২
জেবা প্রতিবারের মতোই সাইয়ারার কথায় মুচকি হাসলো। কথাগুলো যে জালসান আর হিশমার উদ্দেশ্যে বলেছে সেটা জেবা ভালো করেই বুজতে পারলো। এই মেয়েটার ধনাত্মক চিন্তুাধারা তাকেও ধনাত্মক ভাবতে উৎসাহিত করে।
- খেয়েছিস।
- না খাবো। তুমি খেয়েছো।
- হুম
দুপাশই নিশ্চুপ হয়তো কিছু ভাবছে। হয়তো বোঝার চেষ্টা করছে অপরজনের মনের মধ্যে কি চলছে। কিছুক্ষণ পর নিরবতা ভেঙ্গে সাইয়ারা বলে উঠলো।
- জানো আপু, নানু(নানি)-নানা মাকে নিয়ে অনেক চিন্তা করে। ভালোবাসে খুব। আমি এখানে এসেছি দেখে তাদের মায়ের জন্য অনেক চিন্তা হচ্ছে। মা একা একা কিভাবে কাজ করবে? মায়ের একা একা কাজ করতে কষ্ট হবে। আমি না আসলে তো মাকে সাহায্যে করতে পারতাম। আমার মা এমন কেন হলো না আপু। মা তো নানু-নানারই মেয়ে তাহলে তাদের মতো কেন হলো না?
সাইয়ারার চোখ বেড়ে দুফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। জেবা বুজতে পারছে না সাইয়ারার কথার কি জবাব দিবে। তখনই সাইয়ারা মাথায় কারোর হাতের স্পর্শ পেয়ে হকচকিয়ে সেদিকে তাকালো সে। ভেবেছিলো হয়তো নানি বা নানা তার কথা শুনে ফেলেছে। কিন্তু সেখানে মামীকে দেখতে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। তাকমিলা সাইয়ারার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন..,
- সবার ভাগ্য এক হয় না মা। হয়তো তোমার এ দুঃখ ভবিষ্যৎের কোনো সুখের বার্তাবাহক। ইন শা আল্লাহ দেখো একদিন তুমি অনেক সুখি হবে।
তাকমিলার চোখে মেঘ জমেছে। যেন এই মূহুর্তেই বর্ষন শুরু হবে। সাইয়ারা মৃদু হাসলো। তারপর তাকমিলাকে বললো..,
- মামী আমরা জীবনে যা চাই সে সবকিছু পায়না দেখেই আমাদের জীবনটা এতো সুন্দর। যদি সব পেয়ে যেতাম তাহলে আমাদের দুঃখ, কষ্ট, আক্ষেপ কিছুই থাকতো না। আর এগুলোর অনুভূতি আমরা পেতাম না। আর এই অনুভূতিগুলো না থাকলে আমরা জীবনের সৌন্দর্য বুজতাম কি করে।
তাকমিলা চোখে জমা মেঘ এবার বাধ ভেঙে গড়িয়ে পড়লো গাল বেড়ে। সাইয়ারার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো..,
- তুমি অনেক বড় হয়ে গেছো। এখন আর তোমাকে বোঝানোর দরকার পড়ে না। কথা শেষ করে খেতে এসো।
কথাটা বলে তাকমিলা চলে গেলো। সাইয়ারা কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলো। ফোন থেকে জেবার কন্ঠ ভেসে আসায় তার মনে পড়লো সে জেবার সাথে কথা বলছিলো। একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ফোনটা তুলে নিলো সাইয়ারা।
- এখনো কি ঝামেলা হচ্ছে বাড়িতে?
- না আব্বু থামিয়ে দিয়েছে।
সাইয়ারা মুচকি হাসলো।
- আচ্ছা এখন তুই যা খেয়ে নে অনেক রাত হয়েছে।
সাইয়ারা ফোন রেখে খেতে চলে গেলো।
সবাই খাবার খেতে বসেছে। কোনো একটা কাজ থাকায় ফাওয়াযের আসতে একটু দেরি হয়েছে। এসে খাবার ঘরে সবাইকে দেখতে পেলেও সাইয়ারাকে দেখতে না পেয়ে তাকমিলাকে সাইয়ারার ব্যাপারে জিঙ্গাসা করলে “একটু পরেই আসছে” জবাব পেল। ফাওয়ায খেতে বসে এক লকমা ভাত মুখে নিয়ে চিবাতে থাকলে লহরিকা আবার বলা শুরু করলো..,
- আমার ছেড়িডা না জানি একলা একলা কি রানছে? কি খাইতাছে? ছেড়িডা না আইলে তো হের মার সাথে রানবার পারতো।
ফাওয়ায আর এক লকমা ভাত মেখে হাতে নিয়েছিলো মুখে নেওয়ার জন্য তোলার আগেই মায়ের কথায় বেশ বিরক্ত হলো। হাত নেওয়া লোকমাটা রেখে হাত ঝেড়ে হাতে লেগে থাকা ভাতগুলো পাতের উপর ঝাড়লো।
- মেয়েটা এসেছে থেকে শুনছি তোমার মেয়ে একা একা কিভাবে কাজ করবে? সাইয়ারার জন্মের আগে কি তুমি কাজ করে দিয়ে আসতে তোমার মেয়েকে? তোমার মেয়ের জন্য এতই চিন্তা তাহলে বিয়ে দিতে গিয়েছিলে কেন? মেয়েটা মাত্র কিছুদিনের জন্য এসেছে। মেয়েটা আসার কয়েক ঘন্টাও হলো না তুমি এসব বলা শুরু করেছো। তুমি বুজতেও পারছোনা এসব বলে তুমি তোমার মেয়ের জন্য চিন্তা প্রকাশ করছো না। বরং মেয়েটার চোখে নিজেকে খারাপ করছো।
বলেই চলে গেলো ফাওয়ায। পেছন থেকে তাকমিলা অনেকবার ডাকলো ফাওয়াযকে খাওয়া শেষ না করে না যাওয়ার জন্য কিন্তু ফাওয়ায কোনো কথা কানে নিলো না। ফাওয়ায যাওয়ার পরে ইমাদূদ্দিন লহরিকাকে বললো..,
- ছেড়াডা সারাদিন পরে একটু খাইবার বইছিলো। অহনি তুমার এতা কওন লাগলো। ছেড়াডা খাইলও না।
স্বামীর কথার জবাবে লহরিকা কিছু বলতে পারলো না। ইমাদূদ্দিন খাওয়া ছেড়ে উঠতে চাইলে তাকমিলা না উঠার জন্য অনুরোধ করলো আর বললো তারা খেয়ে উঠলে তাকমিলা স্বামীর জন্য খাবার নিয়ে যাবে। ইমাদূদ্দিন ও লহরিকা খাওয়ায় মনোযোগ দিলো।
ফাওয়ায ঘর থেকে বেরিয়ে সাইয়ারাকে ফিরে যেতে দেখে পেছন থেকে ডাক দিলে সাইয়ারা ঘুরে তাকালো। ফাওয়ায ভাগ্নির কাছে গিয়ে বললো..,
- মায়ের কথায় কিছু মনে করিস না। চল আমার সাথে আমার পড়ার ঘরে সেখানে অনেক বই সংগ্রহ করে ছোট একটা পাঠাগাড় বানিয়েছি। তোর যেই বই ভালো লাগে পড়বি।
- কিন্তু তুমি খাওয়া শেষ করলে না যে।
- আমি পড়ে খেয়ে নেব। এখন চল।
সাইয়ারা মৃদু হাসলো। ফাওয়াযের সাথে পড়ার ঘরে গিয়ে লাইব্রেরি থেকে কয়েকটা ছোটদের ছড়ার বই বের করে পড়তে শুরু করলো। পাশের চেয়ারেই ফাওয়ায একটা উপন্যাসের বই নিয়ে বসেছে। এদিকে ফাওযীয়া শ্বশুড়-শ্বাশুড়ীকে খাওয়ানো শেষ করে সাইয়ারার ঘরে গিয়ে সাইয়ারাকে না পেয়ে নিজেদের ঘরে গেলো দেখতে। সেখানেও না পেয়ে পড়ার ঘরে এসে পেল তাদের। দুজনকেই খাওয়ার জন্য বললে তারা একটু পর আসছে জানালে তাকমিলা কিছুটা বিরক্ত হয়ে চলে গেলো। ফাওয়ায আর সাইয়ারা দুজনেই মনে মনে বই পড়ছে। পড়ার ঘরে পিনপতন নিরবতা হঠাৎ সামনের টেবিলে কিছু রাখার শব্দ হলে দুজনেই হকচকিয়ে টেবিলে তাকালে দুহাতে ধরে রাখা একটা হাড়ি দেখতে পেল। হাত অনুসরণ করে হাতের অধিকারির দিতে তাকালে তাকমিলার ভাবলেশহীন দৃষ্টি দেখতে পেল। ফাওয়ায তাকমিলাকে কিছু বলার আগেই সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পর একটা কড়াই নিয়ে এভাবে। প্লেট, গ্লাস, থালা আর বাকি খাবারগুলো নিয়ে এসে খাবার বেড়ে ফাওয়ায আর সাইয়ারার সামনে দিলো। ফাওয়ায কিছু বলতে গেলে তাকমিলা চোখ বড় করে খাবার খেতে বললো। ফাওয়ায কিছু না বলে খাওয়া শুরু করলো। এদিকে সাইয়ারা না পাড়ছে হাসতে না পারছে হাসি আটকে রাখতে। নিচের দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে সে। ফাওয়ায সাইয়ারাকে কিছু বলতে যাবে তার আগে সাইয়ারা তাকমিলার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো..,
- মামি তুমিও বসে পড়ো না।
- না তোমরা খাও আমি পড়ে খেয়ে নেব।
সাইয়ারা কিছু বলতে যাবে তার আগে ফাওয়ায বলল..,
- আরে বসে পড়ো তো। পড়ে একা একা খাবে।
তাকমিলা মুচকি হেসে তাদের সাথে খাওয়ায় যোগ দিলো। খাওয়ার এক পর্যায়ে ফাওয়ায সাইয়ারাকে বলল..,
- খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড় কালকে সকালে আবার বই পড়িস। এই ঘর খোলায় থাকে।
সাইয়ারা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। খাওয়া শেষে থালা রান্নাঘরে রাখার জন্য নিয়ে যেতে চাইলে তাকমিলা সাইয়ারাকে এখানেই রেখে যেতে বলে। সাইয়ারা চলে যাওয়ার পর ফাওয়ায তাকমিলাকে বলল..,
- কালকে বিকালে বড় আপুর বাসায় যাবো। সাথে সাইয়ারাকেও নিয়ে যাবো। মেয়েটা এসেছে থেকে মায়ের ফালতু কথা-বার্তা শুনে যাচ্ছে। আপুর বাসায় গেলে ওরও মনটা ভালো হয়ে যাবে।
তাকমিলা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁসূচক উত্তর দিলো।
পরের দিন কাজ থেকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরলো ফাওয়ায। কালকে রাত থেকেই একটা আশঙ্কা হচ্ছিল তার। বাসায় এসে দেখলো আশঙ্কাটায় সত্যি হয়েছে। চৌকির বসে ইমাদূদ্দিনের সাথে কথা বলছে জামীর। ফাওয়ায ভেতরে ঢুকতে ইচ্ছে করছে না তাই ফিরে যেতে চাইলে কানে এলো জামীর লহরিকাকে বলছে সাইয়ারাকে তাড়াতাড়ি তৈরি হতে। কথাটা শোনা মাত্রই থেমে গেলো ফাওয়ায। ঘরে প্রবেশ করে জামীরের সাথে সালাম বিনিময় করলো।
- দুলাভাই কি একা এসেছেন? কোনো কাজ ছিলো?
- না সাইয়ারাকে নিয়ে যেতে এসেছিলাম।
ফাওয়ায নিজের রাগটা সামলে শান্ত গলায় বললো..,
- মেয়েটা তো কালকেই এসেছে থাকুক কিছুদিন।
ফাওয়াযের কথাটা যে জামীরের মোটেও পছন্দ হয়নি তার ছাপ চোখে মুখে ফুটে উঠলো। বউয়ের ভাই দেখে নিজেকে সামলে হাসার চেষ্টা করলো জামীর।
চলবে..
জানি ঠিকিই দেখা হবে (পর্ব ১২)
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
253
Views
4
Likes
0
Comments
5.0
Rating