পর্ব-১১
মুনেম ভোর রাতে বাসায় আসার সময় রওনা দেবে। আসতে আসতে সকাল ১০:৩০ থেকে ১১:০০টার মতো বাজবে। তাই জামীর সন্ধ্যার দিকেই চলে গেলো বাজার করতে। শাক-সবজি বাদে প্রয়োজনীয় মসলা, মাছ, মাংস কিনে এনেছে। মাছ, মাংস কাঁটা, মসলা বেঁটে এগিয়ে রাখার জন্য সাইয়ারার কাছে দিয়ে আসতে গেলে সাইয়ারাকে কয়েকবার ডাক দিলেন। বাজার রান্নাঘরের সামনে রেখে বাড়ির সবাইকে সাইয়ারার খবর জিঙ্গাসা করলে কেউ তার খবর দিতে পারলো না। মুনিহা সাইয়ারার ঘরের কাছে গিয়ে দরজায় তালা দেখে সবাইকে এসে বলল সাইয়ারা বাসায় নেই। তার ঘরে তালা দেওয়া। মূহুর্তে শোরগোল শুরু হয়ে গেলো পুরো বাড়িতে। জালসান, হিশমা, মাজেদা সাইয়ারাকে খোজার কথা না বলে উল্টে জামীরকে সাইয়ারার বিরুদ্ধে উসকাসছিলো। হিশমা বিদ্রুপের সুরে বলল..,
- দেহোগা কুনু ছেড়ার সাথে কিছু কইরা গেছে গা নাকি। ছেড়িরে তো কহনো শাসন করো না। আমরা তো কইয়ি কিন্তু শাসন তো বাপ মার করুন লাগে। হেরে কইলে কি অইবো হের মায়ি হুনে না। শাসন করবার কইলে ক বড় অইলে ঠিক অইয়া যাইবো। আর কতো বড় অইতো অহন শিক্ষা না দিলে কহন দিবো। আঙ্গর কওয়া তো কইয়ি। আর কইলেই কি অইবো মায়ি ঠিক না।
হিশমার কথার সাথে তাল মিলিয়ে জালসানও ঝাঝালো কন্ঠে জামীরকে বললেন..,
- কি ছেড়ি জন্ম দিলি বাপ মার মুহো কালি মাহাইবারো চিন্তা করে না।
ফাজেলার চোখে পানি। শত হলেও তাদের তো নাড়ী ছেড়া সম্পর্ক। সাইয়ারায় তাকে মাতৃত্ব এনে দিয়েছিল। তার মধ্যেই মাজেদা কাঁটা ঘাড়ে নুনের ছিটা দেওয়ার জন্য বলে উঠলো।
- আমার পুলাপানডি আর যাই করুক। ভাইগ্গা যাওনের কতা মাথাতো আনতো না। আমি আমার পুলাপানরে এইরুম শিক্ষা দেয় নাই।
তাদের কথার মধ্যে সামীর কিছু বলতে চাইলে জামীর তাকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দেয়। ফাজেলা চোখের পানি মুছতে মুছতে জামীরকে সাইয়ারাকে খুজে আনার কথা বললে জামীর ফাজেলাকে ধমক দেয়।
- ছেড়িরে তো মানুষ করবার পারছোস না। অহন ছেড়িরে খুইজ্জা আইন্না দিবার কস। তোর ছেড়ি যে আর কুনুদিন এই বাড়িত না ঢুহে। যুদি আইছে দেহিস আমি কি করি।
পেছন থেকে জাওয়াদের বজ্রকন্ঠ শুনে কেঁপে উঠলো বাড়ির সবাই সহ জামীরও। জেবা বাবাকে দেখে বাবার দিকে এগোতে গেলে চোখ পড়লো সদ্য জ্বলে উঠা ফোনের উপর। ফোন স্কিনে সাইয়ারার নামটা ভেসে উঠেছে নিচে ছোট করে লেখা “কল এন্ডেড”। লেখাটা দেখে আতকে উঠলো জেবা। খানিকক্ষন আগে সেই সাইয়ারাকে কল করেছিলো সে ঠিক ভাবে পৌছেছে কিনা জানার জন্য। হঠাৎ বাইরে শোরগোলের আওয়াজ শুনে কল কাঁটার কথা ভুলে গিয়ে ফোনটা হাতে নিয়েই কি হয়েছে দেখতে বেরিয়ে এসেছিলো। সে মনে মনে ভাবলো..,
*তারমানে সাইয়ারা এতোক্ষণ সবই শুনেছে। না জানি কতো কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা। এখনতো কাছেও নেই যে সান্ত্বনা দিবো। এই ঝামেলা না মেটা পর্যন্ত তো কলও করতে পারবো না।*
জাওয়াদের কন্ঠে জেবা নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো। জাওয়াদ হিশমার উদ্দেশ্যে বলল..,
- তুই পড়ালেহা করছোন। নিজের শিক্ষা লইয়া গর্ব করছ। এই তোর শিক্ষার ছিরি। কারে কি কওন যায় হেইডা তো তুইয়ি জানস না। তুই আবার অন্যরে কি সুধরাইবি। পড়ালেহা ঠিকই করছোস, সার্টিফিকেটও পাইছোস কিন্তু শিক্ষা কি এইডা তুই জানোস না। আর তোর মধ্যে যে কুনু শিক্ষা নাই হেইডা তোর কথাতই তুই সবাইরে দেহাইয়া বেরাস।
অপমানে হিশমার মুখ থমথমে হয়ে গেলো। জাওয়াদ হিশমার থেকে চোখ সরিয়ে জালসানের দিকে তাকালো।
- তুমারে আর তুমার ছেড়িরে আমার কিছু কওয়ার নাই। তুমরা কেউরে কিছু কওয়ার আগে একবারও চিন্তা করো না যে যারে যা কইতাছো হেইগুলা তুঙ্গর মধ্যেই আছে।
জাওয়াদ জামীরের সামনে গিয়ে দাড়ালো।
- তোরে যতই কওয়া ওক না কে ততই কম অইবো। নিজেরে বেডা কেমনে কস তুই। তুই জানোস না তোর ছেড়িরে। তোর ছেড়ি কি করবার পারে না করবার পারে তুই জানোস না। তোরে মা, বইন যেইবা কই হেইবাই নাচস। তোর কি চিন্তা করার ক্ষমতা নাই। তোর এই স্বভাবের লাইগ্গাই তোর ছেড়ি তোর থেইক্কা কত দূরে গেছেগা তুই জানস। বাড়িত থাহে দেইখ্খা বুজস না। হুদা তোরে দেখতো না দেইখ্খা বাড়ির পিছনে একলা একলা থাহে। নাইলে এইনোই সবার সাথে থাকবার পারতো। অহন বুজবি না কিন্তু যখন বুজবি কাইন্দা কুল পাইতেনা।
ফাজেলা চোখের পানি মুছতে মুছতে কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠলো।
- বাই আমার ছেড়িডারে খুইজ্জা আইন্না দেইন। কই গেছেগা আমার ছেড়িডা।
পুনরায় কান্না শুরু করলো ফাজেলা। জেবা ফাজেলার কাছে এসে কাকির কাধে হাত রাখলো।
- কাইনদুইন্না কাকি। সাইয়ারা হের মামার বাড়িত গেছে। আব্বু গিয়া দিয়া আইছে।
মাজেদা চিৎকার করে উঠলো।
- মানে। কালকে যে আমার ছেড়াডা আইবো হের লাইগ্গা রানবো...।
মাজেদার কথা শেষ করার আগেই জাওয়াদের রক্তচক্ষু দেখে থেমে গেলো।
- সাইয়ারাকে কি তুমার এই বাড়ির কামের ছেড়ি মনো অই। ছেড়া তুমার রানবো আরেক ছেড়ি। কে তুমি রানবার পারো না। মা অইয়া যুদি ছেড়ার লাইগ্গা রানবারই না পারো তুমার ছেড়ারে এই বাড়িত আইবার না করবা। যেইদিন নিজে রানবার পারবা হেইদিন ছেড়ারে কইবা বাড়িত আইবার।
জাওয়াদ ঘরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে কয়েক পা এগিয়ে আবার থেমে গেলো। পেছনে ঘুরে জামীরের উদ্দেশ্যে বললো..,
- সাইয়ারারে এক সপ্তাহের লাইগ্গা হের মামার বাড়িত থইয়া আইছি এর মধ্যে যে হেরে আনা না অয়।
কথাটা বলেই জাওয়াদ ঘরে চলে গেলো। জাওয়াদ যাওয়ার পরে জামীর জেবাকে জিঙ্গাসা করলো..,
- তুই জাইন্নাও আঙ্গরে কিছু কইছোস না কে?
- আমি কইলে তুমরা আমার কতা বিশ্বাস করতা। নাকি তুমার মা, বইনের মুহো লাগাম লাইগ্গা থাকতো।
কথাটা বলেই জেবা ঘরে চলে গেলো। পেছন থেকে হিশমা চিৎকার করে কটু কথা শোনাতে থাকলো কিন্তু জেবা সে সবে কান দিলো না।
সাইয়ারা রাতের খাবার খেতে আসতে আসতে তার নানির কিছু কথা শুনতে পেল। লহরিকা বলছে..,
- আজকে আমার ছেড়িডারে একলা একলা কাম করুন লাগতাছে। ছেড়িডা না আইলে কি অইতো।
তাকলিমা প্রতিত্তোরে বলছে..,
- মা সাইয়ারাতো ফাজেলা আপাকে সাহায্য করেই। এমন তো না যে সে খুব ঘন ঘন বেড়াতে আসে। এসেছেতো কিছুদিনের জন্যই। আবার কবে আসে না আসে ঠিক নেই। যে কদিন আছে এসব কথা বলবেন না মেয়েটা কষ্ট পাবে।
- আর আমার ছেড়িডার যে কষ্ট অইতাছে হেইডা কিছু না।
নানির কথা শুনে সাইয়ারা মনে মনে ভাবলো..,
*তুমি তোমার মেয়ের কত চিন্তা করো তার একাংশ যদি তোমার মেয়ে আমার জন্য করতো।*
সাইয়ারার চোখ অশ্রুশিক্ত হলো। সে ঘরে ফিরে আসলো।
- মা আপনার ফাজেলা আপুতো প্রেম করে বিয়ে করে নি। আপনারায় বিয়ে দিয়েছেন। মেয়ে যদি কষ্টই পাবে তাহলে তাকে আরেকটু বড়লোক ছেলে দেখে বিয়ে দিতেন। তাহলে সাইয়ারার উপর ভরসা করে থাকতে হতো না।
- তুমার খুব কতা ফুটছে না। বেশি কতা না কইয়া কাম করো।
তাকমিলা আর কথা বাড়ালো না। সে খাবার সামগ্রী সব একজায়গায় এনে রাখে সাইয়ারাকে ডাকতে গেলো।
সাইয়ারা ঘরে এসে বসা মাত্রই ফোন বেজে উঠলো। সাইয়ারা ফোন স্ক্রিনে জেবার নাম্বার দেখে বেড়ে পড়ার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া চোখের পানিটা মুছে নিলো। দুজনে সালাম বিনিময় করলো।
- সাইয়ারা মন খারাপ করেছিস। দাদি, ফুফুর কথায় কষ্ট পেয়েছিস।
- না আপু। তোমার সাইয়ারাকে এসব সস্তা কথায় মন খারাপ করানো যায় না। পারলে ওদের বলো কথা বলার চর্চা করতে এসব ছোট খাটো নাটকে সাইয়ারার মন খারাপ হয় না। কারণ আমি সাইয়ারা কোনো আলতু ফালতু মেয়ে না। আর আমি নিজেকে আলতু ফালতু ভাবিও না। তাই ফালতু মানুষের মুর্খতায় ভরা কথা-বার্তা আমার গায়েও লাগে না।
চলবে..
জানি ঠিকিই দেখা হবে (পর্ব ১১)
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
248
Views
4
Likes
0
Comments
5.0
Rating