পর্ব-১০
জেবা চাল ধুয়ে সাইয়ারার হাতে দিয়ে সবজি কাঁটতে বসলো। সাইয়ারা চাল ধুতে চেয়েছিলো জেবা দেয়নি উল্টো চোখ রাঙ্গিয়ে বলেছে তাকে যে রান্না করতে দিয়েছে এটাই অনেক। কাঁটা-ধোঁয়া শেষে সাইয়ারার পাশে বসলো।
- কালকে আমি চলে যাবো সাইয়ারা। শুনছি বাবা কালকে চলে যাবে। তোর জন্য খারাপ লাগছে। বাবা থাকলে মা, দাদি, ফুফুদের থেকে তোকে বাঁচিয়ে রাখে। আমি তো তোর জন্য কিছু করতেও পারি না।
সাইয়ারা মাড় ফেলে ভাত ভাপ দেওয়ার জন্য বসিয়ে জেবার দিকে ঘুরে বসলো।
- কে বলেছে তুমি আমার জন্য কিছু করো না। এই এখনো করছো। তুমি আসলে আমার কতো কাজ কমিয়ে দাও। এটা কম কি।
সাইয়ারা পুনোরায় রান্নায় মনোযোগ দিলো। এমন সময় ফাজেলা আসলো হাতে একটা কাগজের ঠোঙ্গা। ঠোঙ্গাটা সাইয়ারার দিকে এগিয়ে দিলে জেবা সেটা নিলো। ফাজেলা সাইয়ারার উদ্দেশ্যে বললো..,
- এই মুড়িডি মাইখ্খা দে। আমার আতডা আইট্টা গেছে নাইলে আমিই মাখতাম।
জেবা ঠোঙ্গাটা রেখে ফাজেলার কাছে এসে হাতটা ধরে এপিঠ ওপিঠ দেখতে লাগলো।
- কই কাটছে কাকি, কেমনে কাটছে, কত্তানি কাটছে।
ফাজেলা ক্ষতস্থান দেখিয়ে বললো..,
- এইযে এইনো। টিনের মধ্যে লাইগ্গা কাইট্টা গেছে।
জেবা ফাজেলার হাতের সামান্য ক্ষতটা দেখে মুচকি হাঁসলো। ফাজেলার মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো...
* এই সামান্য ক্ষতে আপনি কাজ করতে পারেন না। অথচ এর থেকেও বড় বড় আঘাতে কেউ একজনের বিশ্রাম নেই। তাকে আপনিই বলেন মেয়ে হয়ে জন্ম নিলে এসব ব্যাথা কিছুই না। অথচ আপনিই এই সামান্য ব্যাথা সহ্য করতে পারেন না।*
ক্ষতস্থানের দিকে তাকিয়ে থাকায় জেবার অবজ্ঞাপূর্ণ হাসিটা ফাজেলার চোখে পড়লো না।
- আচ্ছা কাকি আইন্নে যাইন। আমি দিয়া আইতাছি।
ফাজেলা চলে গেলে সাইয়ারা ঠোঙ্গাটা নেওয়ার জন্য হাত বাড়ালে জেবার ধমকে থেমে গেলো। জেবা মুড়ি মেখে দিতে যাওয়ার সময় শুনলো তার ভাই আসছে। না শোনার ভান করে মুড়িটা দিয়ে চলে এলো। সাইয়ারার পাশে বসে বললো।
- সাইয়ারা তুই কালকে তোর নানির বাসায় চলে যাস। অন্তত একদিনের জন্যও।
সাইয়ারা জিঙ্গাসু দৃষ্টিতে জেবার দিকে তাকিয়ে রইলো।
- কালকে মুনেম আসবে। মুড়ি দিতে গিয়ে শুনলাম।
সাইয়ারার ভাবলেশহীন ভাবে বললো..,
- বাড়ির ছেলে বাড়িতে আসবে না।
- এলেই তো তোকে অনেক রান্না করতে হবে, শুধু শুধু তোকে অপমান করবে। সুযোগ পেলে তো কথায় নেই। তুই কালকে তোর নানির বাসায় চলে যাস।
- আপু কারোর মধ্যে শিক্ষা না থাকলে তাকে শিক্ষা দেওয়ার দ্বায়িত্ব তো আমার না। হুম প্রতিবাদ করতে পারি। কেউ যদি নিজে অন্যকে অপমান করে নিজেকে দুকান বিহীন প্রমাণ করে তাহলে তো আমার কিছু করার নেই।
“দুকান বিহীন” শব্দটা শুনে জেবার অনেক হাঁসি আটকে রাখতে পারলো না। দুকান কা*টা পড়েছি কিন্তু দুকান বিহীন কি?
- ও মা তুমি জানো না। আচ্ছা শোনো। দুকান কা*টা মানে তো নির্লজ্জ। মানে যার লজ্জা নাই। কিন্তু যারা লজ্জার যাহির করে নিজে থেকে অন্যকে কথা শুনিয়ে নির্লজ্জ উপাধি দেয়। যাকে দেয় সে এসব কথা গায়ে মাখা তো দূর কানেও নেয় না। তবুও নিজে লজ্জা না পেয়ে বারবার নিজে থেকে অপমান করতে আসে সে দুকান বিহীন নয়তো কি।
জেবা এবার একটু শব্দ করেই হাসলো।
- সত্যিই তোকে কিছু বলার নেই।
- কিছু বলতেও হবে না। তুমি আব্বুর কাছে গিয়ে বোলো আমি নানির বাড়ি যাচ্ছি।
জেবা সাইয়ারাকে কিছুক্ষণের মধ্যে আসছে বলে চলে গেলো।
সবাই নিজেদের মতো কথা বলছে। জেবা চোখ বুলিয়ে জাওয়াদকে পেলো না। ঘরে আছে মনে করে ঘরে গিয়ে দেখলো। জাওয়াদ কাপড় গোছাচ্ছে।
- বাবা আসবো।
জাওয়াদ নিজের কাজ করতে করতেই বললেন..,
- বাবার কাছে আসার জন্য কি মেয়ের অনুমতি নিতে হয়।
জেবা কিছু বলার আগে জাওয়াদ বলে উঠলো।
- আমার কোম্পানিটা না খুললেও ব্যবসাটার কারণে চলে যেতে হচ্ছে। শুনেছিস তো মুনেম আসছে। সাইয়ারাকে গিয়ে বল ওর নানির বাড়ি চলে যেতে। আচ্ছা থাক আমিই গিয়ে বলে আসি।
জাওয়াদ ব্যাগটা গুছিয়ে রেখে বেড়িয়ে গেলো তার সাথে জেবা।
সাইয়ারা রান্না শেষ করে ঘর উঠোন পরিষ্কার করে ঝাড়ুটা রাখলো মাত্র। পেছনে ঘুরতেই জেবা আর জাওয়াদকে আসতে দেখলো।
- শোন মা।
জাওয়াদকে থামিয়ে দিয়ে সাইয়ারা বললো..,
- আমি জানি আব্বু তুমি কি বলতে এসেছো। কিন্তু আমি আজকেই যেতে চাইছি। এখনো কেউ আমাকে মুনেম ভাইয়ারা আসার খবর জানায়নি। এখন গেলে কিছু বলতে পারবে না। কালকে গেলে এটা নিয়ে কথা উঠবে। বলবে মুনেম ভাইয়া আসছে দেখে আমি বাসা থেকে চলে যাচ্ছি। কালকে তুমি চলে যাওয়ার সময় তোমার সাথে দেখা হবে না।
- কখন যাবি।
- এইতো এখনি বেরোবো।
জেবা বলল..,
- চল তোর ব্যাগ গুছিয়ে দেই আব্বু তোকে এগিয়ে দিয়ে আসুক।
জেবা সাইয়ারার ব্যাগ গুছিয়ে দিয়ে জাওয়াদ আর সাইয়ারাকে বিদায় জানালো।
ঘরের দরজায় টোকা পড়ায় লহরিকা বেগম ছেলের বউকে দরজা খুলতে বললে। তাকমিলা দরজা খুলতে গেলে ফাওয়ায তাকে বাধা দিয়ে ভেতরে পাঠিয়ে দিলো। ফাওয়ায দরজা খুলো বোরকা পরিহিত কাউকে দেখতে পেল। চিনতে সময় লাগেনি মানুষটা সাইয়ারা। তারা সালাম বিনিময় করে সাইয়ারাকে ভেতরে ঢুকালো। দরজা বন্ধ করার জন্য দরজার কাছে দাড়ালে জাওয়াদের দিকে দৃষ্টি গেলো। জাওয়াদ ফিরে যাওয়ার জন্য কয়েকপা এগিয়েছে কেবল। পেছন থেকে ফাওয়াযের ডাক শুনে ফিরে তাকালো। ফাওয়ায তার দিকে এগিয়ে গেলো। দুজনে সালাম বিনিময় করলো।
- সাইয়ারাকে দিয়ে গেলাম কোথাও তো বেরোয় না থাক এখানে কিছুদিন।
ফাওয়াযের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জাওয়াদ চলে গেলো।
লহরিকা বসে বসে সুপারি কাঁটছিলেন। পাশের চৌকিতে শুয়ে আছেন ইমাদূদ্দিন। সাইয়ারা এসে নানা-নানিকে একসাথে সালাম দিলো। সাইয়ারাকে দেখে লহরিকা আর ইমাদূদ্দিন বেশ চমকে গেলেন। লহরিকা দরজার দিকে তাকিয়ে মেয়েকে দেখতে পেলেন না। তাই বললেন..,
- তোর মা কই।
- আইছে না।
সাইয়ারার কথা শুনে তারা আরো অবাক হলেন। নায়লা মাঝে মাঝে আসলেও সাইয়ারা সচরাচর আসে না। খুব কমই সে নানার বাড়ি আসে তবুও ফাজেলা, জামীর আর ভাই বোনরা এলে। আর সেখানে সে একা এসেছে। অবাক হওয়ার কথায় তো। ইমাদূদ্দিন উঠে বসলেন। বিষ্মিত কন্ঠে বললেন..,
- একলা আইছোস।
- না আব্বু দিয়া গেছে।
লহরিকা সামান্য অভিমানি সূরে বললেন..,
- তোর বাপ আইছিলো ভিতরে আইলোনা কে?
- বাবা আইছে না, জেঠা দিয়ে গেছে।
তাকলিমা সাইয়ারার জন্য পানি আর ইমাদূদ্দিনের জন্য চা নিয়ে আসলেন। শ্বশুড়কে চা দিয়ে পানি এগিয়ে দিলো সাইয়ারার দিকে।
- তুই যে আইছোন তোর মা একলা কাম করবো কেমনে। তুই থাকলে তো তাও ইট্টু সাহায্যে করবার পারছ। মা-বাপের দুঃখ বুজস না। কিরুম ছেড়ি অইছোস তুই।
লহরিকার কথাথয় ইমাদূদ্দিনও সায় দিলো। সাইয়ারা কিছু বললো না মুচকি হাসলো। সেই হাঁসিতে মিশে আছে যন্ত্রণা। মায়ের কথাগুলো ফাওয়াযের কানে গেলো। সে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো..,
- কেন মা সাইয়ারা কি তোমার মেয়েকে সাহায্য করে না। কই যখন তোমার মেয়ে তার অন্য সন্তানদের নিয়ে আসে তখন সাইয়ারা কেন আসলো না তা জানার প্রয়োজনও বোধ করো না। বেশির ভাগ সময়তো কাজের দোহায় দিয়ে মেয়েটাকে রেখেই আসে তখন তো বলো না। তোমার মেয়ে তো এখানে এসেছে তাহলে সাইয়ারার বাড়িতে কি কাজ। বাড়ির বেশিরভাগ কাজ এই ছোট মেয়েটাই করে। আর এই মেয়েটা কাজ করে দেখেই তোমার মেয়ে নিশ্চিন্তে এখানে আসতে পারে আর বিশ্রামও নিতে পারে। মেয়েটাতো তেমন আসেও না এখন যখন এসেছে। কয়েকদিন একটু কাজ থেকে রেহায় দাও মেয়েটাকে।
লহরিকা আর ইমাদূদ্দিন আর কিছু বললো না। ফাওয়ায সাইয়ারাকে ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিতে বললেন। খানিক বাদে তাকমিলা নুডুলস রান্না করে সাইয়ারাকে দিয়ে আসলো।
চলবে...
জানি ঠিকই দেখা হবে (পর্ব ১০)
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
269
Views
4
Likes
1
Comments
4.5
Rating