ঢাকার সকালটা আজ একটু আলাদা মনে হচ্ছিল। মাটির রঙের রাস্তার ধুলোমাখা গন্ধ আর চা-নাস্তার মিশ্রণ ঢাকার কোনো এক অজানা কোণে গা-ভরানো। রোদ কিরণ ম্লান, তবু শহরের ব্যস্ততা থেমে নেই। কাঁচের ঘর, উঁচু বিল্ডিং, হকারদের চিৎকার, মোটরসাইকেলের হর্ন—সব মিলেই একটা জটিল সিম্ফনি গড়ে তুলেছে।
জয়া এই শহরেরই এক ছোট্ট অংশের সঙ্গে পরিচিত, কিন্তু আজ তার চোখে শহরটা যেন নতুন রঙে রঙিন হয়ে উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরে আসার পথে রিকশার ব্যস্ত রাস্তা, মানুষের ভিড়—সবকিছু যেন তার চারপাশের জীবনকে জীবন্ত করে তুলেছে। জয়ার চোখে আজ বিশেষ করে কেউ দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু তার মনটা যেন ব্যস্ত—ভালোবাসার অজানা, অচেনা অনুভূতি নিয়ে।
জয়া কলেজ শেষ করে যখন রাস্তার পাশে দাঁড়াল, তার চোখে পড়ল এক ছেলেটা—প্রহর। প্রহরটা সাধারণ কোনো ছেলেটা নয়, তাকে দেখলে মনে হয় যেন শহরের হ্যাম্বারশেড লাইটের মতো উজ্জ্বল কিছু আলো তার চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। চোখে গাঢ় নীল রঙের ব্লেজার, হাতে একটি ক্যাফে-ফিল্টার কফির কাপ। এমন সাধারণ দৃশ্যের মধ্যে প্রহরের উপস্থিতি যেন আলাদা করে সবকিছু।
প্রহর নিজেও জ্যান্ত মানুষের মতো নয়। তার চলন-ফিরন, চোখের ভঙ্গি, আর হালকা হাসি—সব মিলিয়ে যেন একটি নিখুঁত সিম্ফনি তৈরি করছে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই একটি ছোট্ট ডিজাইন স্টুডিওতে কাজ করেন। শিল্প, রঙ, এবং শহরের শব্দগুলো তার ভেতরে এক অদ্ভুত শান্তি সৃষ্টি করে।
আজকের দিনটা একটু অন্যরকম। জয়া রিকশা থেকে নেমে কলেজের ব্যাগ সামলাচ্ছিল, হঠাৎ তার ব্যাগ থেকে একটি নোটবুক রাস্তার ধুলোয় পড়ে গেল। আর ঠিক তখনই প্রহরের চোখে পড়ল নোটবুকটি।
"ওহ!" জয়া exclaimed করে, দ্রুত নোটবুকটি তুলতে গিয়ে হাত ধুলোর সঙ্গে মিশে গেল।
প্রহর, হেসে, নোটবুকটি তার হাতে ধরিয়ে দিল। "আপনার নোটবুক!"
জয়া লাজুক হাসি দিয়ে বলল, "ধন্যবাদ। আজকাল অনেকেই এগুলো তুলেই রাখে না।"
প্রহরের চোখে মৃদু কৌতূহল ফুটল। "আপনি কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন?"
"হ্যাঁ," জয়া হেসে উত্তর দিল। "আর আপনি?"
"আমি স্টুডিওতে কাজ করি," প্রহর জানাল। তার কথার ভঙ্গি সহজ, কিন্তু চোখে লুকানো কৌতূহল যেন জয়ার মনটা আরও কাছে টেনে নিল।
শহরের রাস্তায় ভিড় বেড়েই চলেছে, কিন্তু এই মুহূর্তে জয়া আর প্রহরের চারপাশের সবকিছু অদৃশ্য। এক অদ্ভুত শান্তি—যেমন শহরের কোলাহল কিছুটা থেমে গেছে।
"তাহলে কি আমরা একসাথে কফি খেতে পারি?" প্রহর হঠাৎ করে বলে বসল।
জয়ার চমকে যাওয়া মুখ, তারপর হালকা লাজুক হাসি। "কফি?"
"হ্যাঁ," প্রহর বলল, "এটা একটু অদ্ভুত হলেও, আজকের সকালটা একটু অন্যরকম লাগছে।"
জয়া একটু হেসে বলল, "ঠিক আছে, এক কাপ কফি। কিন্তু শুধু এক কাপ।"
তারা পাশে থাকা ছোট্ট ক্যাফের দিকে এগোল। ঢাকার এই ব্যস্ত রাস্তায় এমন একটি শান্ত ক্যাফে, যেখানে কফির ঘ্রাণ মিষ্টি আর হালকা লাউঞ্জ মিউজিক—সবকিছু যেন মুহূর্তটা আরও রোমান্টিক করে তুলল।
কফি অর্ডার করার সময়, প্রহর জয়ার দিকে তাকাল। "আপনার চোখে আজ অদ্ভুত কিছু আছে," সে হেসে বলল।
জয়া লাজুকভাবে লজ্জা পেল। "সাধারণ সকাল," সে বলল, কিন্তু মনে মনে প্রহরের কথায় একটি অদ্ভুত উচ্ছ্বাস বোধ করল।
কফি এসে, তারা বসল জানালার পাশে। ঢাকা শহরের রোডে চলতে থাকা মানুষ আর যানবাহনের শব্দ দূরে চলে গেল। কেবল তাদের চারপাশের আলো, কফির ঘ্রাণ, এবং এই অদ্ভুত শান্তি।
প্রহর জিজ্ঞেস করল, "আপনি কি শৈল্পিক কিছু পছন্দ করেন?"
জয়া উত্তরে বলল, "হ্যাঁ, ছোটোবেলা থেকে ছবি আঁকা পছন্দ। তবে কলেজে পড়াশোনার কারণে সময় খুব কম।"
"দেখুন," প্রহর বলল, "আমি একটি স্টুডিওতে কাজ করি। কখনও যদি সময় থাকে, আপনি আসতে পারেন। আমরা নতুন ডিজাইন প্রজেক্টে কাজ করছি।"
জয়া কিছুটা অবাক হল। "নিশ্চয়ই," সে হেসে বলল। "কিন্তু আমি কি খুব ব্যস্ত না হয়ে পড়ব?"
প্রহর হালকা হেসে বলল, "কেউ ব্যস্ত হলেও, ভালোবাসা আর শিল্পের জন্য সময় বের হয়।"
এই ছোট্ট কথাগুলো জয়ার মনটা ছুঁয়ে গেল। তার ভেতরে একটি অজানা উচ্ছ্বাস জন্ম নিল, যা তার জীবনের প্রতিটি ধাপকে অচেনা করে তুলল।
কফি শেষ হয়ে গেল, তারা বাইরে বের হলো। রাস্তায় মানুষের ভিড় আগের মতোই, কিন্তু তাদের মধ্যে একটি অদ্ভুত সংযোগ তৈরি হয়েছে—একটি নিখুঁত মুহূর্ত, যা তারা দুজনই মনে রাখবে।
প্রহর হঠাৎ জয়ার দিকে তাকাল। "আমি চাই এই শহরের প্রতিটি সকাল আপনার সাথে কাটাতে।"
জয়ার চোখে একটি অদ্ভুত উজ্জ্বলতা, কিন্তু সে লাজুকভাবে হেসে বলল, "আজকের সকালই যথেষ্ট। বাকিটা সময়ই দেখাবে।"
শহরের হালকা কোলাহল, রিকশার শব্দ, মোটরসাইকেলের হর্ন—সব মিলিয়ে তারা এক অদ্ভুত আনন্দে শহরের রাস্তায় হাঁটতে লাগল।
যখন তারা বিদায় বলল, জয়ার মনে হয়েছে যেন এই সকাল তার জীবনের একটি নতুন অধ্যায়ের শুরু। শহরটা এখন শুধু ব্যস্ত রাস্তা নয়; এটি প্রেমের সূচনার শহর, যেখানে প্রতিটি মোড়, প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি কফি শপ তাকে প্রহরের সঙ্গে সংযুক্ত রাখবে।
এভাবেই ঢাকার ব্যস্ত সকাল থেকে শুরু হল জয়া আর প্রহরের গল্প—একটি গল্প যা শহরের রঙ, শব্দ, এবং ছোট ছোট মুহূর্তের মধ্যে ফুল ফুটতে শুরু করেছে।
চলবে.................
ভালোবাসা
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
41
Views
1
Likes
0
Comments
5.0
Rating