আসছে মা দূর্গা

ঢাকার ছোট শহরতলীর রাস্তায় ধুলো কুয়াশার মধ্যে আজও কিছুটা উৎসবের গন্ধ ভাসছে। কার্পেটের ওপর ভাঙা আলো আর মাটির ঘরের জানালায় ফাঁকা বাতাসে মিশে থাকা দুর্গাপূজার রঙিন বাতিগুলো যেন দূরের দিনের প্রতিচ্ছবি।

রূপমনি দেবী বউমার বাড়ি আজ ভীষণ ব্যস্ত। চারপাশে লাল, হলুদ, এবং সোনালী পঁচমণ্ডলির কাগজগুলো ছড়িয়ে আছে। মায়ের হাতগুলো কাঁপছে না, শুধু আগুনে গরম জল দিয়ে প্রয়োজনীয় সমস্ত সাজগোজ যাচাই করছেন। ছোট মেয়ে রাশ্মি তার পাশে দাঁড়িয়ে আঙুলের মাঝখানে লাল চন্দনের দাগ চেপে ধরেছে। তার চোখে এক আশ্চর্য এক আনন্দ, যেন মা দূর্গার আগমন শুধু উৎসব নয়, এক জীবনের আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা।

রাস্তায় কাঁদা-মাটি মিশে ছোট ছোট দোকানগুলো সাজানো, যেখানে লাঠি দিয়ে বাঁধা মাটির দেবীর মূর্তিগুলো একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। “আসছে মা দূর্গা, আসছে মা দূর্গা!”–শিশুদের চিৎকার আর বয়স্কদের গম্ভীর সঙ্গীত এক সঙ্গে মিলিয়ে শহরের ফাঁকা কোণগুলো প্রাণবন্ত করে তোলে।

কিন্তু শুধু আনন্দ নয়, কিছু মানুষের মনে আজও ব্যথা লুকানো। রূপমনি দেবী বউমার বাবা–মা মারা গেছেন বহু বছর আগে। সংসারের সমস্ত দায়িত্ব এখন তার হাতে। তবু এই পূজা তার কাছে এক আশার আলো, যা জীবনের কঠোর বাস্তবকে কিছু সময়ের জন্য ভুলিয়ে দেয়।

রাশ্মি মায়ের কাঁধে হাত রেখে বলে, “মা, এবার কি আমরা নতুন আলো দিয়ে মণ্ডপ সাজাব?”
রূপমনি হেসে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ, বাচ্চা, এবার আমরা মা দুর্গাকে এমনভাবে স্বাগত জানাব, যেন এই ছোট শহরেও তার আশীর্বাদ ছড়িয়ে পড়ে।”

মণ্ডপে ঢোকার পর, রঙিন ফুল, ধূপ, এবং আলোতে প্রতিটি কোণা যেন নতুন জীবন পায়। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা, পড়ুয়ারা, এবং গ্রামের মানুষ একত্রিত হয়ে এই পূজাকে আরও উজ্জ্বল করে তোলে।

রূপমনি দেখছেন, প্রতিবেশী বয়স্ক শাশুড়ি কাঁদছে। তিনি কাছে গিয়ে হাত ধরেন। “মা দূর্গা সব ব্যথা ভেঙে দিক, তাই তো?”
বয়স্ক নারীটি ধীরে হেসে বলে, “হ্যাঁ, মেয়ে, এই পূজা আমাদের জীবনের ব্যথাকে আনন্দে রূপান্তরিত করে।”

সন্ধ্যা নামতেই কাঁটাচামচের আলো আর ঢাকের টানে পুরো এলাকা যেন এক জাদুকরী আবহে রূপান্তরিত হয়। রাশ্মি মায়ের হাত ধরে প্রার্থনা করছে, “মা, আমাদের ছোট শহরকে ভালো রাখো, সবাইকে ভালো রাখো।”
রূপমনি বলছেন, “দেখছিস, বাচ্চা, শুধু আনন্দই নয়, মানবতার বন্ধনও এই পূজায় প্রকাশ পায়। মানুষের ভালোবাসা, ভ্রাতৃত্ব, সহমর্মিতা—এটাই আসল মা দূর্গা।”

রাত যত গভীর হচ্ছে, মণ্ডপে মানুষের ভিড় তত বাড়ছে। প্রত্যেকের চোখে এক ভিন্ন আশা, ভিন্ন আনন্দ। দূর্গা আসছে, শুধু মূর্তির আকারে নয়—মানব হৃদয়ে, সম্পর্কের বন্ধনে, এবং মানবতার আড়ালে।

এই শহরটা জানে, পূজা শেষ হলেও এই ভালবাসা, এই সহমর্মিতা, এই মানবিকতা থাকবে চিরকাল। আর তাই রূপমনি, রাশ্মি, এবং পুরো সম্প্রদায় মিলেমিশে মায়ের আগমনকে স্বাগত জানায়—একসাথে, এক হৃদয়ে, এক মনোনিবেশে।