(১)
ঢাকার শীতল এক বিকেল। আকাশটা মেঘে ঢাকা, যেন কোন অভিমানে মুখ গুঁজে বসে আছে। ধানমণ্ডির এক কফি শপে বসে আছে একজন তরুণ। বয়স ত্রিশ ছুঁই ছুঁই, চোখে ফ্রেমহীন চশমা, পরনে হালকা নীল শার্ট আর ব্ল্যাক জিন্স। চেহারায় এক ধরণের গাম্ভীর্য আছে, কিন্তু কারও চোখে চোখ রাখলে সেই গাম্ভীর্যের নিচে একটা নরম ছায়া টের পাওয়া যায়।
তার নাম—আরিফ হোসেন।
পেশায় তিনি একজন স্থপতি, ঢাকায় বেশ পরিচিত একটা আর্কিটেকচার ফার্মে চাকরি করেন। সুনাম আছে, দায়িত্ববোধও আছে। কিন্তু তার ব্যক্তিগত জীবনের গল্পটা একটু অন্যরকম। প্রেমে পড়েছিলেন এক মেয়ের—মিতু আয়মান।
মিতু…এই নামটাতেই আরিফের চোখ কেমন যেন ভিজে ওঠে। একসময় খুব কাছের ছিল। এখন দূর থেকেও আরও দূরে। কথাও হয় না আর। অথচ আজ এই কফি শপেই দেখা হওয়ার কথা। তিন বছর পর। হঠাৎ! হঠাৎই!
তিন বছর আগে, এক সন্ধ্যায় ঠিক এই কফি শপেই দুজনের সম্পর্কটা চিরদিনের মতো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
স্মৃতির পর্দা পেছনে যেতে শুরু করে…
তখন সময়টা ছিল বৈশাখ মাস। গরমে ঢাকায় হাঁসফাঁস অবস্থা। তবুও আরিফ আর মিতু প্রতিদিন দেখা করত। মিতুর ক্লাস শেষ হলে আরিফ চলে যেত তার ইউনিভার্সিটির সামনে, সেখান থেকেই দুজন বের হতো। রিকশায় করে বইয়ের দোকান, পুরান ঢাকার নাহার প্লাজা, মাঝে মাঝে ফুচকা খাওয়া, ছাদে বসে একে অপরের হাত ধরে থাকা—সব ছিল।
মিতু আয়মান, ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনসে মাস্টার্স করছিল। আত্মবিশ্বাসী, সাহসী আর সবসময় প্রাণবন্ত এক মেয়ে। তার চোখে একটা জ্যোতি ছিল—যা প্রথম দেখাতেই আরিফকে কাবু করে দেয়।
তারা দুজনেই একে অপরকে অনেক ভালোবাসত, কিন্তু মিতুর পরিবারের চাপ ছিল। তারা চেয়েছিল মিতু যেন বিদেশে পিএইচডি করতে যায়। বিয়ের কথা উঠলেই মিতু কেমন যেন গুটিয়ে যেত। একবারও বলেনি সে ‘না’, কিন্তু ‘হ্যাঁ’-ও বলেনি।
আরিফ অপেক্ষা করত…প্রতিদিন, প্রতি সপ্তাহ, মাসের পর মাস।
একদিন হঠাৎ করেই ফোনে বলল—
— “আরিফ, আমি যাচ্ছি কানাডা। স্কলারশিপ পেয়েছি।”
— “তুমি তো বলেছিলে থাকবে! আমরা প্ল্যান করছিলাম বিয়ের!”
— “আমি থাকলে আমার পরিবার আমার জীবনটা জটিল করে দিতো। আমি তোমাকে হারাতে চাই না। কিন্তু যদি এখন থেকে চলে না যাই, তাহলে আমাকেই হারিয়ে ফেলতে হবে।”
আরিফ চুপ হয়ে গিয়েছিল। সে কিছু বলতে চায়নি তখন। শুধু বলেছিল—
— “ভালো থেকো, মিতু।”
সেইদিন তারা শেষবারের মতো এই কফি শপে দেখা করেছিল। কথা কম হয়েছিল, চোখে ছিল হাজারটা প্রশ্ন—কিন্তু উত্তর দেয়নি কেউ।
আরিফ এখনো সেই পুরনো কফি শপেই বসে আছে। ওর চোখের সামনে দিয়ে সময়টা যেন আবার ফিরে আসছে।
হঠাৎ দরজা খুলে এক মেয়ে ঢোকে—সাদা কামিজ, কালো ওড়না, হাতে একটা নোটবুক। চেহারা বদলে গেছে, কিন্তু চোখের দৃষ্টি একদম আগের মতো।
মিতু আয়মান।
তিন বছর পরেও ঠিক একই রকমভাবে হেঁটে আসে সে, একই ধরণের ভঙ্গিতে।
মিতু এসে বসে আরিফের সামনে। প্রথমে কেউ কিছু বলে না।
— “কেমন আছো?” —মিতু জিজ্ঞেস করে।
আরিফ একটু হাসে। — “ভালো…মানে চেষ্টা করছি।”
— “তুমি একাই এসেছো?”
— “হ্যাঁ। কাউকে নিয়ে আসব কেন?”
মিতু একটু নিচের দিকে তাকায়। তার চোখে অদ্ভুত এক দ্বিধা।
— “তুমি কি এখনো আমার উপর রাগ করো?”
— “রাগ? জানো মিতু, রাগটাও অনেক বছর আগেই মরেছে। এখন শুধু মাঝে মাঝে তোমার কথা ভাবলে মনটা হালকা হয়ে যায়। তাই রাগ কিসের?”
— “আমি ভুল করেছিলাম, তাই না?”
আরিফ কোনো উত্তর দেয় না। শুধু চুপ করে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। চোখে অনেক কথা জমে আছে, কিন্তু মুখে আনে না।
মিতু নোটবুকটা টেনে নেয়। খুলে একটা পাতায় কিছু লিখে দেয়, তারপর এগিয়ে দেয় আরিফের দিকে।
— “এই চিঠিটা তোমার জন্য। কানাডায় থাকতেই লিখেছিলাম। কিন্তু পাঠানোর সাহস হয়নি।”
আরিফ ধীরে ধীরে পাতা খুলে পড়ে—
> "প্রিয় আরিফ,
তুমি বলেছিলে অপেক্ষা করবে।
আমি ভেবেছিলাম দূরত্ব সব শেষ করে দেয়।
কিন্তু এখন বুঝি, ভালোবাসা কখনো হারায় না।
কানাডার প্রতিটি রাতে তোমার কথা ভেবেছি।
তোমার পছন্দের গান, তোমার চা খাওয়ার স্টাইল, তোমার অভিমান—সব মনে পড়ে।
আমি জানি, আমি তোমাকে হারিয়েছি।
কিন্তু তোমার যদি এখনো একটু ভালোবাসা বাকি থাকে…
তাহলে আমি ফিরে আসতে চাই।
সব ছেড়ে এসেছি…এখন শুধু একটাই প্রশ্ন—তুমি কি আছো এখনও আমার জন্য?"
চিঠি পড়ে আরিফের চোখ ভিজে যায়। সে জানে, এই মেয়ে এখনো ঠিক আগের মতোই ভালোবাসে তাকে। কিন্তু এই তিন বছরে সে নিজেকেও গড়েছে নতুনভাবে। অভিমান, ক্ষোভ, একাকিত্ব—সবকিছু নিয়েই।
আরিফ মিতুর দিকে তাকায়।
— “তুমি জানো, একসময় আমি প্রতিদিন তোমার জন্য চিঠি লিখতাম, কিন্তু কখনো পাঠাইনি।”
— “তুমি এখনো ভালোবাসো?” মিতুর কণ্ঠটা কেঁপে ওঠে।
— “ভালোবাসি…তবে ভয়ও পাই। আবার হারাতে চাই না। আবার কষ্ট পেতে চাই না।”
মিতু এবার হাত বাড়িয়ে দেয় আরিফের দিকে।
— “এবার আর হারানোর সুযোগ দেব না। তুমি যদি বলো, আমি চিরদিন তোমার হাত ধরে থাকব।”
আরিফ ধীরে ধীরে হাতটা ধরে। চারপাশের কফি শপটা নিঃস্তব্ধ হয়ে আসে, সময় যেন স্থির হয়ে যায়।
বাইরে তখনো মেঘ জমে আছে। কিন্তু হঠাৎ একফোঁটা আলো এসে জানালার কাঁচে পড়ে। তারা দুজন চোখে চোখ রাখে।
তিন বছর পর, একটা নতুন শুরু।
___________________________
(২)
ঢাকার আকাশ আজ একটু বেশিই নীল। বাতাসে একটা আশ্চর্য প্রশান্তি, যেন কোন অজানা সুখ ধীরে ধীরে শহরের বুক জুড়ে নেমে আসছে। কফি শপে শেষ দেখা হওয়ার এক সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। মিতু আয়মান এখন ঢাকাতেই। ফিরে এসেছে ভালোবাসার টানে, নিজের ভুল শুধরে নেওয়ার ইচ্ছায়।
আরিফ হোসেন এখন যেন আগের থেকে অনেক শান্ত। চোখে সেই চেনা কোমলতা ফিরে এসেছে। কিন্তু মনের ভেতরে এখনও কিছু দ্বিধা খেলে যায়—এই সম্পর্ক কি আবার সেই পুরনো আঘাতে জর্জরিত হবে না?
আজ দুজনের দেখা হওয়ার কথা মিতুর বাসায়। মিতু বলেছিল, তার মা কথা বলতে চান আরিফের সঙ্গে। এটা কোনো রোমান্টিক বিকেল নয়—এটা একপ্রকার যুদ্ধ। মিতুর মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের জায়গাটা তুলে ধরা। তিনি যে কখনোই আরিফকে পছন্দ করেননি, সেটা আর গোপন নেই।
আরিফ সকালে আয়নায় নিজেকে দেখে নিয়েছিল অনেকবার। গা ছুঁয়ে যাওয়া সাদা পাঞ্জাবি, পরিপাটি চুল, হালকা পারফিউম—কোনো কমতি রাখেনি। কিন্তু তবুও বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করছে।
মিতুর বাসায় ঢুকতেই তাকে বসতে বলা হয়। মিতুর বাবা সৌম্য চেহারার মানুষ, সদা নীরব, মুখে একটা কঠিন গাম্ভীর্য। কিন্তু এই মানুষটাই আরিফের প্রতি কখনো নেতিবাচক ছিলেন না।
তবে আসল পরীক্ষা শুরু হলো মিতুর মা প্রবেশ করার পর। মুখে এক ধরণের অবজ্ঞা, চোখে কঠিন প্রশ্ন। চায়ের কাপ হাতে বসে পড়লেন, তারপর বললেন—
— “তিন বছর আগে তো তুমি চলে যেতে দিয়েছিলে আমার মেয়েকে। তখন যদি এত ভালোবাসতে, তখন তো আটকে রাখতে পারতে!”
আরিফ শান্ত স্বরে বলল,
— “ভালোবাসা মানে শেকল পরানো না, আন্টি। তখনকার পরিস্থিতি আমাকে কিছু বলার সুযোগ দেয়নি। আমি চেয়েছিলাম ও নিজের স্বপ্ন গড়ুক।”
— “আর এখন?” তিনি চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করলেন।
— “এখন আমি চাচ্ছি আমরা একসাথে স্বপ্ন গড়ি।”
ঘরটা নিঃশব্দ হয়ে যায়।
সেই মুহূর্তে মিতু এসে বসে মায়ের পাশে। তার চোখে কোনো ভয় নেই, বরং সাহস আছে।
— “মা, আমি আরিফকে বিয়ে করতে চাই।”
— “তুমি জানো না, সমাজে কত লোক কী বলবে? বিদেশ থেকে ফিরে এসেছো, আর এখন এমন একটা ছেলেকে বিয়ে করতে চাচ্ছো যে এখনো নিজে একটা ফ্ল্যাট পর্যন্ত কিনতে পারেনি?”
— “মা, আমি টাকা বা ফ্ল্যাট ভালোবাসি না। আমি মানুষ ভালোবাসি। আর আরিফ যে মানুষটা, সে তোমরা কেউ জানো না।”
একটা স্তব্ধতা যেন ঘরে জমাট বাঁধে।
এই মুহূর্তে, মিতুর বাবা মুখ খুললেন—
— “আমরা যদি সম্মতি দিই, তুমি আমাদের মেয়েকে সুখে রাখতে পারবে?”
আরিফ উঠে দাঁড়িয়ে বলে—
— “আমি প্রতিজ্ঞা করছি, যতটা পারি, আমি ওর হাসি, ওর চোখের জল, ওর প্রতিটা সকাল, প্রতিটা সন্ধ্যা—সবই আমার যত্নে রাখব। তবে সুখ শুধু আমার হাতে নেই। সুখ দু’জনের পরিশ্রমে গড়ে উঠে।”
দীর্ঘ সময় পরে, মিতুর মা মুখে একটাই কথা বলেন—
— “আমার মেয়ে যদি খুশি থাকে, তাহলে আমি বাধা হব না।”
বিয়েটা হয় খুব সাদাসিধেভাবে। অভিজাত কোনো রিসোর্টে নয়, মিতুর বাসার ছাদে, কাছের মানুষদের নিয়ে। কাগজে কলমে, সমাজের নিয়মে, ধর্মের আচার মেনে—আরিফ আর মিতু একে অপরের হয়ে যায়।
বিয়ের পরের দিন মিতু আরিফের হাত ধরে বলে—
— “জানো, আমি যখন কানাডায় ছিলাম, প্রতিদিন ভাবতাম—তুমি কি কাউকে ভালোবেসে ফেলেছো?”
আরিফ হাসে—
— “ভেবেছিলাম, কেউ যদি তোমার মতো হয়, তবে হয়তো পারি। কিন্তু কেউ তো তোমার মতো হয়নি।”
মিতু চোখ বন্ধ করে বলে—
— “আমি তোমার হাত ছাড়ব না আর।”
তাদের সংসারজীবনের শুরুটা ছিল চেনা অচেনা মিলিয়ে একরকম। মিতু একটা এনজিওতে চাকরি নেয়, যেখানে নারী অধিকার নিয়ে কাজ করে। আরিফ আগের ফার্মেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একটা সময় পর ওরা ঠিক করে, নিজেদের কিছু করতে হবে।
তারা দুজন মিলে একটা ডিজাইন কনসালটেন্সি খুলে। মিতুর নেতৃত্বে সোশ্যাল প্রজেক্টে আরিফ ডিজাইন করে দারুণ সব পল্লী কমিউনিটি সেন্টার, নারী বান্ধব স্কুল বিল্ডিং। ধীরে ধীরে ওদের জীবন আর কাজ একে অপরের সঙ্গে মিশে যায়।
তবে সুখের মাঝে আবার হঠাৎ কালো মেঘ নামে একদিন।
এক বিকেলে, আরিফ বাসায় ফিরে দেখে, মিতু স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। চোখে জল।
— “কি হয়েছে, মিতু?”
— “আমার রিপোর্ট এসেছে…আমি মা হতে পারবো না।”
আরিফ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে কাছে গিয়ে তার হাত ধরে—
— “তুমি তো আমার ভালোবাসা। মা হওয়া কি তার সংজ্ঞা? আমি তোমাকে বিয়ে করেছিলাম কারণ আমি তোমাকে চাই, একজন মা নয়। আর আমাদের সন্তান দরকার হলে, আমরা কাউকে ভালোবাসতেও পারি। এত এত এত অনাথ শিশু, যাদের একটা ঘর দরকার। আমরা ওদের ঘর হতে পারি, তাই না?”
মিতু হেসে কেঁদে ফেলে। আরিফ তাকে জড়িয়ে ধরে। তাদের ভালোবাসা আবার এক নতুন স্তরে পৌঁছায়।
পাঁচ বছর পর। তারা এখন একজন শিশু দত্তক নিয়েছে—নাম রেখেছে রাইহান। সাত বছর বয়সী এক বাচ্চা, যার চোখে এখন জীবন ফিরে এসেছে।
এক সন্ধ্যায়, আরিফ ছাদে বসে চা খাচ্ছে। পাশে মিতু, কোলে রাইহান। রাইহান হাসতে হাসতে বলে—
— “বাবা, মা বলেছে তুমি নাকি ওকে একসময় খুব রাগ করে ছিলে?”
আরিফ মিতুর দিকে তাকিয়ে হেসে বলে—
— “রাগ ছিল, কিন্তু সেই রাগ থেকে জন্মেছে ভালোবাসা। মনে রাখিস, রাগ না থাকলে অনুরাগও হয় না।”
রাইহান তখন আকাশের দিকে তাকায়। বলে—
— “তবে আকাশটা এখন খুব সুন্দর, তাই না?”
আরিফ আর মিতু একে অপরের চোখে চোখ রাখে।
এই সংসারে রাগ এসেছে, অভিমান এসেছে, ব্যর্থতা এসেছে—কিন্তু ভালোবাসা কখনো পিছু হটেনি।
আর সেখানেই তাদের জয়।
_________________________
সমাপ্ত............................
মন রাগে অনুরাগে
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
76
Views
4
Likes
0
Comments
5.0
Rating