বধূ এলো ঘরে

অডিও মোড

00:00 00:00
গতি:
ভলিউম:
গ্রামের শেষপ্রান্তে মাটির রাস্তার ধারে পুরনো এক দোতলা বাড়ি। একতলায় ফুলের বাগান, উঠানে পাতা কুলঘেরা গাছ, আর দোতলায় টিনের ছাদে ঝুলছে নামহীন স্বপ্ন। সেই বাড়িতেই নতুন এক জীবন শুরু হলো। সাদা-লাল শাড়ি পরা, হাতে শাঁখা-পলা, কপালে লাল টিপ— রোদে চকচকে হয়ে উঠছে তার মুখ।

বধূ এলো ঘরে।

তার নাম— নাজমা।
গায়ের রং মেঘলা, চোখে একরাশ দ্বিধা, আর বুকভরা অজানা ভয়। এ বাড়ির ছেলেই তার বর— মাহিন। সে শহরে চাকরি করে, মাসে একবার আসে। তাদের বিয়েটা হয়েছে আকস্মিকভাবে। আত্মীয়ের দেখা সাক্ষাতে শুরু হওয়া আলাপ, তারপর কিছুদিনের মধ্যে হুট করেই বিয়ের সিদ্ধান্ত।

মাহিন নিজেও যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি— এই মেয়েটা তার জীবনে কীভাবে এলো। আর নাজমা? সে তো কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই পাত্রী থেকে বউ হয়ে উঠেছে। বিয়ের রাতেই সে শুনেছে, মাহিন আসলে এখনো পুরোপুরি রাজি হয়নি এ সম্পর্কের প্রতি।

"আমি এখনই সংসার শুরু করতে চাই না,"— বলেছিল মাহিন।
নাজমা মাথা নিচু করে বসেছিল, কিছু বলে না।

পরদিন সকালের চায়ের কাপ হাতে নিয়ে মাহিন শুধু বলেছিল,
"তুমি এখানে থাকো, আমি মাসের শেষে আবার আসব। যদি তোমার কিছু লাগে, আম্মাকে বলো।"

তারপর মাহিন চলে যায়।
নাজমা থেকে যায় সেই অচেনা বাড়িতে, অচেনা মানুষের ভিড়ে।

শাশুড়ি একরকম ভালোই মানুষ। নিজের মতো করে গুছিয়ে নিতে বলেন, রান্নাঘরে কাজ শেখান, মাঝে মাঝে আদরও করেন। কিন্তু তবু একটা নিরবতা নাজমার চারপাশে চেপে বসে থাকে। কারো চোখে সে পুরোপুরি নিজের হয় না।

নাজমা প্রতিদিন নিজের মতো ঘর গোছায়, নিজের হাতে রুটি বানায়, শাড়ি ভাঁজ করে রাখে, জানালার ধারে বসে সূর্য দেখে, আর প্রতিদিন রাতের বেলা মাহিনের কথা ভাবে। তার মুখটা মনে গেঁথে গেছে। কম কথা বলা, গম্ভীর চেহারার সেই ছেলেটা এখনো যেন তার একমাত্র পরিচিত মুখ।

একদিন বিকেলে সে সাহস করে ফোন করল।
"হ্যালো, মাহিন ভাই… আমি নাজমা।"
ওপাশে নীরবতা।
"হ্যাঁ বলো,"— গলা ঠান্ডা, নিরাসক্ত।

"কেমন আছেন?"

"ভালো। কিছু দরকার?"

নাজমা চুপ করে গেল।
"না… এমনি… ভাবলাম কথা বলি।"

"আমি একটু ব্যস্ত। পরে কথা বলব।"
কেটে গেল ফোন।

নাজমা জানত, মাহিন এখনো মেনে নিতে পারেনি তাকে। জানত, সে কাউকে চায়নি, তবু বিয়েটা হয়ে গেছে। কিন্তু তাও সে চেয়েছিল— হয়তো একটু চেষ্টা করলে, হয়তো ভালোবাসা না হোক, একটু সম্মান তো পাওয়া যেতে পারে।

দিন যায়। মাস শেষে মাহিন আসে। কিন্তু এবারও দূরত্ব থেকে যায়। নাজমা রান্না করে রাখে মাহিনের প্রিয় খাবার, সে খায়, ধন্যবাদও দেয়, কিন্তু চোখে পড়ে না কোনো অনুভূতি।

সেদিন রাতে মাহিন ঘরে ঢোকে দেরি করে। নাজমা জেগে থাকে।
মাহিন এসে বলে,
"তুমি যদি থাকতে চাও, থাকো। না চাইলে বাবাকে বলো, ব্যবস্থা করে দেবেন।"

নাজমা চোখ নামিয়ে বলে,
"আপনি কী চান?"

"আমি এখনো নিশ্চিত না। বিয়েটা হঠাৎ হয়ে গেছে। আমি তো তোমাকে চিনতাম না।"

নাজমা শান্ত গলায় বলে,
"তবু আমি চেষ্টা করছি আপনাকে জানার, আপনাকে বুঝবার। আপনিও পারেন না একটু চেষ্টার সুযোগ দিতে?"

মাহিন কিছু বলে না। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে। তার চোখে প্রথমবারের মতো একটুকরো মানুষ দেখা যায়।

পরদিন সকালে নাজমার পাশে এক টুকরো কাগজ রাখা—
"আজকে আমি অফিস যাচ্ছি না। চলো, কোথাও ঘুরে আসি।"

নাজমা অবাক হয়ে তাকায়।
ছেলেটা ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে।

তারা নদীর ধারে হেঁটে যায়, চুপচাপ বসে গল্প করে, নাজমা মাহিনকে বলে তার ছোটবেলার কথা, স্কুলে প্রথম পড়া কবিতার লাইন, তার বাবার হাতের খিচুড়ির স্বাদ। মাহিন শোনে। খুব মন দিয়ে শোনে।

সেইদিন রাতে তারা প্রথমবার একসঙ্গে এক কাপ চা খায়। শাড়ির কোণায় চা লেগে যায়, নাজমা হাসে। মাহিনও হাসে। সেই হাসির মাঝে প্রথমবার কিছু একটার শুরু হয়।

পরের মাসে মাহিন ফিরে যায় শহরে, কিন্তু এবার সে প্রতিদিন রাতে ফোন করে।
"আজ কী রান্না করেছো?"
"আজ কত পৃষ্ঠা পড়েছো?"
"আজ কি বৃষ্টি পড়েছে?"

নাজমা জানে না এগুলো ভালোবাসা কি না, কিন্তু জানে— এগুলো আগলে রাখে, যত্নে রাখে।

তিন মাস পর মাহিন আসে, সাথে একটা ছোট প্যাকেট।
"এটা তোমার জন্য। নিজের হাতে বেছে এনেছি।"
নাজমা খুলে দেখে— একটা বই, তার প্রিয় লেখকের।

"তুমি তো বলেছিলে কবিতা ভালোবাসো। আমি তো বুঝতে পারিনি, ভালোবাসা কেমন হয়। এখন একটু একটু করে শিখছি…"

নাজমার চোখ ভিজে যায়।
সে জানত, বধূ হয়ে সে এসেছিল এই ঘরে। কিন্তু এখন সে শুধু ঘরের মানুষ না— এখন সে কারও হৃদয়েরও মানুষ।

বছর ঘুরে যায়।
বাড়িটা এখন বদলে গেছে। উঠোনে এখন লাউয়ের গাছ ঝুলে, ছাদে ছোট টবে বসে গোলাপ। আর ঘরের ভেতরে— একটুকরো আলো।

নাজমা এখন আর শুধু বধূ নয়, সে এখন মাহিনের প্রিয়জন, সংসারের স্বপ্নপালক।

সে যখন হাঁটুর ওপর মাথা রেখে বসে মাহিনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, তখন মনে হয়—
"এই ঘরে আমি শুধু এসেছি না, আমি এখানে জন্ম নিয়েছি নতুন করে।"

বধূ এলো ঘরে…
আর সেই ঘরটাই একদিন তার নিজের পৃথিবী হয়ে উঠল।
67 Views
8 Likes
0 Comments
5.0 Rating
Rate this: