রাত তখন প্রায় তিনটা। শহরের বাতাসে নেমে এসেছে নিস্তব্ধতা, আর সেই নীরবতায় একা বসে আছে লিজেন—তার নিজের ঘরের এক কোণায়, জানালার ধারে। জানালাটা খোলা, কিন্তু বাইরে কোনো হাওয়া নেই। সব কিছু যেন স্তব্ধ, স্থির। শুধু মাঝে মাঝে দূর থেকে ভেসে আসে ট্রেনের হুইসেলের ম্লান শব্দ—একটা স্টেশন আছে এই শহরেই, নাম ‘ছায়ার স্টেশন’।
এই স্টেশনটার কথা মানুষ খুব একটা বলে না। যাদের মুখে শোনা যায়, তারা হয় নেশাগ্রস্ত, নয়তো চুপচাপ কিছু একটা গোপন করে চলে। অথচ এই স্টেশনেই শুরু হয়েছিল এক অদ্ভুত গল্প, একটা ভালোবাসা, একটা মৃত্যু, আর এক অসমাপ্ত প্রতিশোধের যাত্রা।
লিজেন জানালার ধারে বসে থাকা অবস্থায় চোখ পড়ল দেওয়ালে ঝোলানো পুরনো এক ক্যালেন্ডারের দিকে—তারিখ: ১৩ জুলাই ২০২৫। এই তারিখটার মধ্যে লুকিয়ে আছে একটা নিঃশব্দ বিস্ফোরণ, যা কাঁপিয়ে দিয়েছিল শুধু লিজেনের জীবন নয়, গোটা দেশের সিস্টেম।
তিন বছর আগে, এই দিনে, টেলিভিশনের পর্দায় প্রথম দেখেছিল লিজেন—আয়াতকে।
---
আয়াত। নামটা যেন একটা রহস্যের খোলস। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, অদ্ভুত এক মনোযোগ, আর ঠোঁটের কোণে সবসময় একটি চাপা অভিব্যক্তি—যা হাসিও না, বিষাদও না। সে ছিল একজন তরুণ বিজ্ঞানী, যার মুখে মিডিয়া বলত “বাংলাদেশের গর্ব”, “নতুন যুগের পথিকৃৎ”। অথচ লিজেনের চোখে সে ছিল—ভালোবাসা।
আয়াতকে দেখে লিজেন যা অনুভব করেছিল, তা প্রেম না। সেটা ছিল একধরনের আকর্ষণ, যেটা শব্দে ব্যাখ্যা করা যায় না। একটা অনুভব, যেন বহু জন্ম আগের কোনো সম্পর্ক আবার ফিরে এসেছে—স্মৃতি ছাড়া।
তারা কখনো মুখোমুখি হয়নি। কখনো একসাথে বসে চা খাওয়া হয়নি, এমনকি সামাজিক মাধ্যমে একটা বার্তাও আদানপ্রদান হয়নি। অথচ তবুও আয়াতের প্রতি লিজেনের অনুভূতি ছিল এমন, যেন সে তার আত্মার দরজায় চুপিচুপি এসে দাঁড়িয়ে ছিল অনেক আগেই।
---
১৩ জুলাইয়ের সেই দিনটা ছিল সাদা রঙের, ঝকঝকে রোদ্দুরমাখা। দুপুর নাগাদ হঠাৎ Breaking News—
“বিজ্ঞানী আয়াত ইসলাম সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত”
“গবেষণাগারে বিস্ফোরণ, সন্দেহজনক মৃত্যু”
“নিরাপত্তার অভাবে প্রাণ গেল জাতীয় সম্পদের”
লিজেন সেই মুহূর্তে বাসায় ছিল না, মোবাইলও বন্ধ ছিল। বিকেলে যখন সে খবরটা শুনল, তখন তাকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করেনি, কিন্তু তার চোখের ভাষা বলে দিয়েছিল—একজন মানুষ ভেঙে যাচ্ছে, নিঃশব্দে।
লিজেন ছুটে গিয়েছিল আয়াতের শেষ বিদায়ের সংবাদ সম্মেলনে। নিরাপত্তার কারণে কাউকে ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছিল না, তবুও সে বাইরে থেকে আয়াতের নিথর দেহ দেখতে পেয়েছিল—টেলিভিশনের লাইভ স্ক্রিনে।
আর তখনই, প্রথমবারের মতো সে আয়াতকে দেখল—সামনাসামনি, কিন্তু মৃত।
আয়াতের মৃতদেহ যখন সাদা কাপড়ে ঢাকা হয়ে হাসপাতালের মেঝেতে রাখা ছিল, চারদিক ঘিরে ছিল ক্যামেরা, রিপোর্টার, পুলিশ, কিছু মন্ত্রী, এবং কিছু মুখ যাদের মুখে বিষণ্নতা ছিল, কিন্তু চোখে ছিল অস্থিরতা—ঠিক যেন কিছু ঢেকে রাখার চেষ্টা চলছে।
লিজেন দাঁড়িয়ে ছিল সবার পেছনে। তার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল, হাত কাঁপছিল। অথচ তার চোখে কোনো পানি ছিল না। না, সে কাঁদছিল না। কারণ কান্না আসার আগে তার ভেতরে অন্য কিছু জন্ম নিচ্ছিল—প্রতিশোধ।
"তুমি তো জানোই না, আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি..." — মনের ভেতর শব্দগুলো গুমরে গুমরে উঠছিল।
"তোমার চোখের দিকে একবার তাকাতে চেয়েছিলাম। একটা চিঠি লিখে রেখে যেতে চেয়েছিলাম। কিছু না... শুধু বলতে চেয়েছিলাম, তুমি মানুষ না... তুমি এক অজানা নক্ষত্র, যার আলো আমার জীবন ছুঁয়েছে।"
লিজেন জানে না আয়াত কী নিয়ে গবেষণা করছিল। কেউ জানত না। মিডিয়া বলেছিল, 'একটি গুরুত্বপূর্ণ জিন সংক্রান্ত আবিষ্কার'। কিছু রিপোর্ট বলেছিল, 'ন্যানোচিপ প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছিল'। আর কিছু ওয়েব পোর্টাল বলেছিল, 'সৈনিকদের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে সক্ষম একটি সিস্টেমের মডেল বানিয়েছিল আয়াত'।
যাই হোক, লিজেনের কাছে এসব তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তার কাছে শুধু আয়াতের চোখের তলায় হালকা কালি, ঠোঁটের কোণে দৃঢ়তা, আর তার চলাফেরার ধীর অথচ শক্ত চাহনি—এসবই ছিল স্মরণীয়।
তবে সেই দিন, স্টেশনের এক প্রান্তে, আয়াতকে শেষবারের মতো যখন দেখা গেল, তখন তার মুখে কোনো অভিব্যক্তি ছিল না। যেন সময় থেমে গেছে। লিজেন শুধু ভাবছিল,
“এমন মেয়েকে কেন মরতে হলো?”
“কে চায় এই আবিষ্কার থেমে যাক?”
“আসলে কারা আয়াতকে মেরে ফেলল?”
---
পরবর্তী কয়েকদিন লিজেন কেমন যেন অন্য জগতে ছিল। সে আর আগের মতো অফিসে যেতে পারছিল না। টিভি বা ফোন ছুঁয়েও দেখছিল না। সে শুধু একটা পুরোনো খাতা খুলে লিখে যাচ্ছিল আয়াতকে উদ্দেশ করে—কবিতা, প্রশ্ন, যন্ত্রণার চিঠি, আর মাঝে মাঝে গালাগালি। তবে সেই খাতার শেষ পাতায় ছিল একটা লাইন, শুধু একটা লাইন:
> “আমার আয়াত মারা যায়নি। তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। আমি জানি কারা করেছে। আমি ফিরে আসব।”
লিজেন কোনো সাংবাদিক নয়, কোনো গোয়েন্দা বা হ্যাকারও নয়। সে একজন সাধারণ ছাপোষা যুবক—ব্যাংকে চাকরি করে, মেসে থাকে, ভাত খেতে ভালোবাসে, কখনো প্রেম করেনি।
কিন্তু আয়াতের মৃত্যু তার ভেতরের সোজা মানুষটাকে বাঁকিয়ে দিয়েছে।
সে রাতগুলোতে ঘুমাত না। বিভিন্ন রিপোর্ট, সংবাদ বিশ্লেষণ, ভিডিও রেকর্ডিং, ব্লগ পড়ত—যেখানে আয়াতের নাম এসেছিল একবার হলেও।
এভাবেই একদিন, সে খুঁজে পেল কিছু নাম। কিছু মুখ। কিছু অদ্ভুত শব্দ, যেমন:
"Project Silence"
"উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ গবেষণা তহবিল"
"G-9 ফাউন্ডেশন"
"Tyrant Protocol"
এই নামগুলো কোন পত্রিকায় ছিল না, শুধু কিছু ফাঁস হওয়া নথিপত্রে, যা Dark Web এ ঘুরছিল। লিজেন জানত না Dark Web কী, কিন্তু এক প্রবাসী বন্ধুর সহায়তায় সে কিছু অ্যাক্সেস পেয়ে গিয়েছিল।
আর তখনই সে বুঝল—আয়াতের মৃত্যু কোনো দুর্ঘটনা নয়। এটা ছিল পরিকল্পিত হত্যা।
---
স্টেশনটা—‘ছায়ার স্টেশন’—যেখানে আয়াত শেষবার গিয়েছিল তার গবেষণার সারাংশ পাঠাতে, সেটিও রহস্যে মোড়ানো।
বলা হয়, সেই স্টেশনে প্রতি রাত ৩টা ১৫ মিনিটে একটা ট্রেন আসে, যার কোনো রুট নেই, কোনো যাত্রী নেই। ট্রেনটা শুধু দাঁড়ায় পাঁচ মিনিট, তারপর আবার অদৃশ্য হয়ে যায়।
সেই রাতেই লিজেন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল—সে সেই ট্রেন ধরবে। যে ট্রেনে আয়াত উঠেছিল কিনা কেউ জানে না, কিন্তু যেদিন তার মৃত্যু হয়, সেদিন রাতেই ট্রেনটি স্টেশনে এসেছিল।
আর সেই রাতেই ট্রেন থেকে নেমেছিল একটি মুখোশ পরা মানুষ, যার পোশাকে ছিল ‘G-9’ লেখা।
---
(চলবে…)
ছায়া
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
49
Views
0
Likes
0
Comments
0.0
Rating