সেই আগুনঝরা সন্ধ্যা

অডিও মোড

00:00 00:00
গতি:
ভলিউম:
আমার ছোট বোনের নাম সুইটি।
সবার খুব আদরের, মায়ার রানী। ওর হাসি দেখলেই ক্লান্ত মনেও প্রাণ ফিরে আসে। সারাদিন বাসার মধ্যে ওর কিচিরমিচির হাসি-আলাপ যেন ঘরের দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়।

সেদিনটা ছিল একেবারে সাধারণ একটা সন্ধ্যা।
চিরচেনা গ্রামবাংলার সেই সন্ধ্যা, যেখানে সূর্যটা ডুবে যায় নরম আলো ছড়িয়ে, আর ঘরবাড়ি আলোকিত হয় চেরাগের মিটিমিটি আলোয়।


বিদ্যুৎ ছিল না, তাই মা একটা কেরোসিনের চেরাগ জ্বালিয়ে রেখেছিল। বাতাসে চেরাগের শিখা দুলছিল, আর আমরা দু’ভাইবোন ঘরের এক কোণে বসে পড়াশোনা করছিলাম।

সন্ধ্যা সাতটা বাজে।পরিবেশটা বড় শান্ত,
বড় আপন লাগছিল।
মা রান্নাঘরে ব্যস্ত, আর আমি বইয়ে চোখ রাখলেও সুইটি একটু পরপর গল্প করছিল।
ভাইয়া, আজ আমাদের স্কুলে ম্যাডাম বললেন আগামী সপ্তাহে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। আমি ভাবছি একটা কবিতা আবৃত্তি করব।
আমি হেসে বললাম, তাহলে এখন থেকে ভালোভাবে অনুশীলন শুরু করো।
ও খিলখিল করে হেসে উঠল,

ঠিক তখনই ঘটল সেই ঘটনা।

হঠাৎ দেখি, সুইটির জামার এক প্রান্তে আগুন ধরে গেছে।
শুরুতে যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না, আমি তাকিয়ে থাকলাম হতবাক হয়ে। সুইটি তখনো বুঝে উঠতে পারেনি। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আগুনটা ছড়িয়ে পড়ল।

ও হঠাৎ ভয়ে চিৎকার করে উঠল,
ভাইয়া, আগুন! আগুন লাগছে! আমাকে বাঁচাও, ভাইয়া।

আমার শরীর ঘামছে, মন আতঙ্কে স্তব্ধ। কী করব কিছু বুঝতে পারছি না।
হঠাৎ চোখে পড়ল টেবিলের ওপর রাখা পানিভরা জগটা। কোনো চিন্তা না করেই আমি সেটি হাতে তুলে এক ঝটকায় পানি ঢেলে দিলাম সুইটির গায়ে।

ঠাণ্ডা পানির ছোঁয়াতেই যেন আগুন থেমে গেল।
সুইটি মাটিতে বসে পড়েছে, কাঁপছে সারাশরীর। আমি ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলাম।
ও কাঁপা কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল,
ভাইয়া... আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম।

মা দৌঁড়ে এলেন রান্নাঘর থেকে। তাঁকে দেখে সুইটি কেঁদে বলল,
মা, আমি ভেবেছিলাম আর বাঁচব না...
মা চোখ মুছতে মুছতে ওকে বুকের সঙ্গে টেনে নিলেন।

সেদিন আমাদের পুরো ঘরে নেমে এসেছিল এক নিঃশব্দ থমথমে পরিবেশ।
সবাই আতঙ্কিত, আবার শুকরিয়া আদায় করছে যে বড় দুর্ঘটনা এড়ানো গেছে।

সুইটির হাতে হালকা পোড়ার দাগ পড়েছিল। ডাক্তার দেখিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা করালাম। অনেক যত্ন আর ভালোবাসায় ধীরে ধীরে সে সুস্থ হয়ে উঠল।

কিন্তু আজও সেই সন্ধ্যার কথা ভুলতে পারিনি।
চেরাগের নিভু নিভু আলো, আগুনের হঠাৎ জ্বলে ওঠা, সুইটির চিৎকার,
ভাইয়া, আমাকে বাঁচাও...
আর আমার সেই এক ঝটকায় নেওয়া সিদ্ধান্ত।

আজ সুইটি বড় হয়েছে, কলেজে পড়ে। আগের মতো কিচিরমিচির গল্প করে না। তবে মাঝে মাঝে পুরনো কথা মনে পড়লে হেসে বলে,
ভাইয়া, তুমি না থাকলে হয়তো আমি থাকতাম না।

আমি তখন চুপচাপ মাথা নিচু করে থাকি। মনে মনে বলি,
তোমার হাসিটুকু পৃথিবীতে থাকুক বলেই তো আমি সেদিন ভয়কে হারিয়ে দিয়েছিলাম।
66 Views
0 Likes
0 Comments
0.0 Rating
Rate this: