ভোর পাঁচটা।
শহর তখনো জেগে ওঠেনি। কুয়াশার চাদরে ঢেকে থাকা রাস্তাগুলো নিঃশব্দ, যেন কিছু একটা ঘটবার অপেক্ষায়। পুরনো একতলা দোচালা বাড়ির বারান্দায় চুপচাপ বসে আছে একটা মেয়ে—অপরাজিতা। চোখে ক্লান্তি, চুলে জট, হাতে এক কাপ ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চা।
এই বাড়িটাই তার যুদ্ধক্ষেত্র। প্রতিদিন যুদ্ধ করে যেতে হয়—সমাজের সঙ্গে, পরিবারে, এমনকি নিজের মধ্যেকার ভাঙা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেও।
অপরাজিতার বয়স মাত্র ২২। অথচ জীবন তাকে এমনভাবে পেষে দিয়েছে, যেন সে চল্লিশ পেরিয়ে গেছে বহুদিন আগে। মা মারা গিয়েছেন যখন সে ছিল ক্লাস নাইনে। বাবা ছিল, কিন্তু ছিল না—মদের নেশায় ভেসে যাওয়া এক শরীর। একদিন রাতে সেও হারিয়ে যায়। পুলিশের খোঁজ, মানুষের সন্দেহ, শেষে জানা যায় ট্রেন লাইনে পাওয়া গিয়েছিল তার শরীর। কেউ জানে না, সেটা আত্মহত্যা ছিল নাকি দুর্ঘটনা।
তারপর থেকে অপরাজিতা একাই। পাশের বাড়ির রেণু খালা মাঝে মাঝে এসে খাবার দিয়ে যান, খোঁজখবর নেন, কিন্তু তাতে কি? জীবন তো আর থেমে থাকে না।
তবুও অপরাজিতা থামেনি।
স্নাতক শেষ করেছে টিউশনি করে, বাসন মাজা করে, বাচ্চা সামলে। এখন সে একটি সরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করে।
মেয়েদের নিয়ে যখন সমাজ কথা বলে—বিয়ে করো, সংসার করো, বাধ্য হও, চুপ করো—তখন অপরাজিতা বলে,
“আমি কোনো সীমানায় বাঁধা নই। আমি নিজের জীবনের অধিকারী।”
তবে গল্পটা এখানেই থেমে থাকলে তা কেবল এক সংগ্রামী নারীর গল্প হতো।
কিন্তু একদিন হঠাৎ বদলে যায় সব।
সেদিন ছিল ১৫ই অক্টোবর। স্কুলে নতুন এক শিক্ষক এল—নাম রিশাদ আহমেদ।
স্মার্ট, ভদ্র, কিন্তু চোখে একটা চাপা বিষণ্ণতা।
অপরাজিতা প্রথম থেকেই লক্ষ্য করছিল, লোকটা অন্যরকম। ছাত্রদের পড়ানোয় আন্তরিক, সহকর্মীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু তার চেয়েও আকর্ষণীয় ছিল—সে অপরাজিতাকে সম্মান করতো, তার মতামত শুনতো।
দীর্ঘদিন পরে অপরাজিতা কারো সামনে নিজেকে নিরাপদ মনে করে।
তবু সে ভয় পায়।
এই ভয়টা অন্যরকম—যেটা আসলে আশার থেকেও বিপজ্জনক।
রিশাদ ধীরে ধীরে অপরাজিতার জীবনে জায়গা করে নিতে চায়।
তার জন্মদিনে তাকে একটা বই উপহার দেয়—“অপরাজিত”—বিভূতিভূষণের সেই বিখ্যাত উপন্যাস।
বইয়ের ভেতরে লেখা ছিল:
“তুমি নিজেই এক অপরাজিতা।
তোমাকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে।
তবে তোমার সম্মতি ছাড়া কিছু না।”
সেই রাতে অনেক বছর পর অপরাজিতা কেঁদেছিল।
কিন্তু সেটা দুর্বলতার কান্না ছিল না—ছিল কৃতজ্ঞতার।
কারণ, কেউ তাকে ভালোবাসার প্রস্তাব দিয়েছিল, তাকে বদলাতে চায়নি, জয় করতে চায়নি—শুধু পাশে থাকতে চেয়েছিল।
তারপর?
অপরাজিতা “না” বলেনি, “হ্যাঁ”-ও না।
সে শুধু বলেছিল—
“আমার অনেক যুদ্ধ বাকি।
তুমি যদি একজন সৈনিক হয়ে পাশে দাঁড়াতে চাও, তবে এসো।
তবে আমার পথ আমি নিজেই তৈরি করব।”
রিশাদ হেসেছিল, বলেছিল—
“তুমি পথ হও, আমি ছায়া হব।”
আজ দশ বছর পেরিয়ে গেছে।
অপরাজিতা এখন শহরের সবচেয়ে জনপ্রিয় নারী অধিকারকর্মী।
তার লেখা বই “অপরাজিতা” সারা দেশে আলোড়ন তুলেছে।
আর বারান্দায় বসে থাকা সেই মেয়েটা?
সে আজও চা খায় সকালে, চুলে হালকা জট থাকে, ক্লান্তি জমে, কিন্তু চোখে এখন আত্মবিশ্বাসের দীপ্তি।
কারণ সে জানে,
সে হার মানেনি।
সে অপরাজিতা।
---------
সমাপ্ত........................
অপরাজিতা
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
43
Views
5
Likes
0
Comments
0.0
Rating