লেখকের প্রেমে

অডিও মোড

00:00 00:00
গতি:
ভলিউম:
তিথির ঘুম ভাঙলো আজানের শব্দে। জানালার কাঁচে টুপটাপ বৃষ্টি পড়ছে, গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়া আলোতে ঘরটা একরকম কুয়াশার মতো লাগছে। সে ধীরে ধীরে উঠে বসে, তাকিয়ে দেখে বিছানার পাশে উল্টে পড়ে আছে একটা বই—"ছায়ার ইশারা"। লেখক—আতিক আহমেদ।

এই নামটা তিথির জন্য একরকম যাদু হয়ে গেছে।

তিন বছর আগে এক পুরনো বইমেলায় তার চোখে পড়ে এই বইটি। প্রথম পৃষ্ঠা খুলেই সে থেমে গিয়েছিল—
"ভালোবাসা যদি শব্দে বেঁধে রাখা যেত, তাহলে আমি কাগজে কাগজে তোমাকে লিখে রাখতাম।"

তিথির নিজের জীবনের কোনো এক অতীতের খাঁচা যেন খুলে গিয়েছিল সেই লেখায়। সেদিন থেকে, একে একে আতিক আহমেদের সব লেখা সে খুঁজে বেড়ায়—"নিঃশব্দ সন্ধ্যা", "আলোর পেছনে ছায়া", "হারিয়ে যাওয়া হিজরতে"—প্রতিটা গল্পে, প্রতিটা লাইনে যেন সে নিজেকে খুঁজে পায়।

তিথির বাড়ি ময়মনসিংহে, ছোট একটা শহরের এক ভদ্র পরিবারে বড় হয়েছে সে। বাবা অবসরপ্রাপ্ত হেডমাস্টার, মা গৃহিণী, দুই বোনের মধ্যে সে বড়। সাহিত্যের প্রতি দুর্বলতা ছোট থেকেই। তাই অনার্স-মাস্টার্স দুটোই করেছে বাংলা বিভাগে। এখন একটি কলেজে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করছে, কিন্তু তার মন পড়ে থাকে বইয়ের পাতায়, কল্পনার ভেতর।

আতিক আহমেদের লেখা তার কাছে শুধু সাহিত্য না, এগুলো যেন নিজের জীবনের ব্যাখ্যা। এক অজানা পুরুষ—যাকে সে কখনো দেখেনি, জানেনি, ছুঁয়েও দেখেনি—সে কীভাবে তার হৃদয় বুঝে ফেলে?

একদিন সাহস করে সে বইয়ের শেষ পাতায় দেয়া ইমেইল ঠিকানায় একটা মেইল পাঠিয়ে দেয়।

"
প্রিয় আতিক আহমেদ ভাই,
আমি তিথি। আপনার পাঠিকা।
‘আলোর পেছনে ছায়া’ বইটা পড়ে আমার ভিতরটা নাড়া খেয়ে গেছে।
আমি বুঝতে পারি না, একজন মানুষ এতটা গভীর করে অন্যের অনুভব ধরতে পারে কীভাবে।
আপনার লেখা আমার জীবন বদলে দিয়েছে।
ভালো থাকবেন।
—তিথি
"

দুদিন কেটে যায়। তৃতীয় দিনে উত্তর আসে।
From: Aatik Ahmed
Subject: কিছু চিঠি মেঘে হারিয়ে যায় না

"
তিথি,
তোমার মেইল পড়ে বুঝলাম, পাঠক যখন লেখার ভেতর নিজেকে খুঁজে পায়, তখনই কলম সার্থক হয়।
তুমি কীভাবে পড়ো, কোথা থেকে পড়ো, জানি না।
কিন্তু জেনে রেখো, এই নামহীন দূরত্ব পেরিয়েও কেউ যখন বুঝে ফেলে হৃদয়ের ভাষা, তখন এক অদ্ভুত বন্ধন তৈরি হয়।
ভালো থেকো।
—আতিক আহমেদ
"

এই এক লাইনের ইমেইলে, তিথির ভিতর কেমন জানি আলো ছড়িয়ে পড়ে। সে প্রতিদিন আতিক ভাইয়ের লেখা থেকে একটা করে বাক্য তুলে নিজের ডায়েরিতে লেখে। মাঝে মাঝে ছোট করে উত্তর দেয়, আর আতিক আহমেদও প্রতি সপ্তাহে একবার উত্তর দেন।

এইভাবে কেটে যায় ছয় মাস।

তিথি জানতো না—এ সম্পর্ক কী নাম পাবে। ওরা তো একে অপরকে দেখেওনি। কিন্তু প্রতিটা ইমেইলে, কিছু না বলা শব্দের ভেতর, সে টের পেত—এই মানুষটা তার হৃদয়ের কোথাও ঠাঁই করে নিয়েছে।

একদিন হঠাৎই তিথি লিখে ফেলে,

"
ভাইয়া, আপনি যদি বলেন—আমরা কখনো দেখা করতে পারি?
আপনার লেখা, আপনার ভাবনা, আপনার মানুষটা—আপনাকে একটিবার সামনে থেকে জানতে চাই।
যদি কখনো আপনি চান, আমি ঢাকায় যাবো।
"

তিনদিন কোনো উত্তর নেই।

চতুর্থ দিনে, মেইল আসে—
"
তিথি,
তুমি আমার লেখা পড়ে যা অনুভব করো, জানো, আমিও ঠিক তেমন একজন পাঠিকার প্রতীক্ষায় ছিলাম,
যে কেবল গল্প না, আমার নীরবতাকেও পড়তে জানে।
আসো, দেখা হোক।
শুক্রবার, বিকেল চারটা, শাহবাগের পাঠাগারে।
"

তিথি থমকে যায়। বুক কেঁপে ওঠে।

ঢাকায় সে খুব কম এসেছে। কিন্তু এবার যেন একটা আলাদা টান আছে। বাবাকে বলে—বন্ধুর বাসায় যাচ্ছে, পড়াশোনার কাজে।

শুক্রবার, এক সাদা রঙের সালোয়ার কামিজে সেজে, চোখে ক Kajol দিয়ে, সে নেমে পড়ে বাসে। ময়মনসিংহ থেকে তিন ঘণ্টার পথ যেন এক শ্বাসে পেরিয়ে যায়।

শাহবাগের পাঠাগারে ঢুকে সে তাকিয়ে থাকে। কয়েকজন মানুষ বসে আছে। কারো হাতে বই, কেউ ফোনে।

তারপর দরজার পাশে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে পড়ে—কালো পাঞ্জাবি, হাতে একটা খোলা খাতা, গম্ভীর চোখে তাকিয়ে আছেন।

তিথি এক মুহূর্তেই চিনে ফেলে।

এই চোখ... এই মুখ... যেন তার প্রতিটি চিঠির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে।

— “আপনি আতিক আহমেদ?” তিথি কাঁপা গলায় প্রশ্ন করে।

— “তুমি তিথি, তাই না?”

দুজনের মাঝে এক নিঃশব্দ বিস্ময় জমে ওঠে।

তারা ধীরে ধীরে বসে পড়ে পাঠাগারের এক কোনায়। আশেপাশের শব্দ হারিয়ে যায়, কেবল নীরব ভাষায় কথা বলতে থাকে তাদের চোখ।

— “আপনি কি জানেন, আপনার লেখা আমার জীবনের ছায়া হয়ে গেছে?”

— “তুমি কি জানো, তুমি আমায় নতুন করে লিখতে শিখিয়েছো?”

এক কাপ চা আসে সামনে। দুইজনই চুপচাপ। যেন এই নীরবতাতেই তাদের আলাপ শেষ হয় না।

আতিক আহমেদ ধীরে ধীরে বলে—
“তিথি, আমার জীবনে কেউ ছিল না, যার জন্য লিখি। সব লেখাই যেন শূন্যে লেখা। কিন্তু তোমার ইমেইল... সেটা যেন আমার কলমে রঙ এনে দিল।”

তিথি চোখ সরিয়ে নেয়। তার বুকের মধ্যে কান্না জমে যায়।

— “তাহলে এখন আপনি কার জন্য লেখেন?”

আতিক হাসেন।

— “তোমার জন্য।”

তিথির চোখ ভিজে আসে।

সে জানে না, কীভাবে এই গল্প শেষ হবে। জানে না সমাজ কী বলবে, পরিবার কী মানবে, কিংবা এই সম্পর্ক কখনো বাস্তব হবে কিনা।

কিন্তু তার হৃদয় বলে, সে একজন লেখকের প্রেমে পড়েছে—যে কেবল লেখে না, বোঝে… চুপ করে পাশে বসে থেকেও কাছে আসে।

সেদিন তারা শেষ বিকেলের আলোয় অনেকক্ষণ হাঁটে। রাস্তার পাশের ফুলওয়ালার দোকান থেকে একটা সাদা গোলাপ কিনে আতিক তিথির হাতে দেয়।

— “এটা আমাদের গল্পের প্রথম পৃষ্ঠা,” সে বলে।

তিথি চুপচাপ ফুলটা হাতে নিয়ে বলে, “আর আমি চাই, এ গল্পটা শেষ না হোক।”
38 Views
5 Likes
0 Comments
0.0 Rating
Rate this: