বিকেলটা যেন একটু বেশিই নির্জন ছিল। কোলাহল না থাকলেও অদৃশ্য এক ব্যস্ততা ছড়িয়ে ছিল বাতাসে। ঢাকা শহরের চেনা অলিগলি পেরিয়ে পুরান ঢাকার নবাব কাটরায় দাঁড়িয়ে ছিল মেঘলা। চোখের নিচে হালকা কালি, চুলগুলো খোলা, ঠোঁটে লিপস্টিক নেই, তবু চোখে যেন এক তীব্র প্রতীক্ষার দীপ্তি।
আজ তার দেখা হবে। পাঁচ বছর পর।
পাঁচটা বছর কোনো খেলো না, কোনো উপন্যাসের পাতাও না—যা চাইলেই উল্টে দেওয়া যায়। এটা জীবনেরই অংশ, যেখানে প্রতিটি মুহূর্ত মনে করিয়ে দেয়, ‘সে’ ছিল, আছে, থাকবে।
সায়ান।
সেই এক নাম, এক মুখ, যে আজও মেঘলার স্বপ্নে আসে। তারা একসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো। রাজশাহীর এক প্রাচীন ছায়াঘেরা ক্যাম্পাসে হাঁটতে হাঁটতে কত স্বপ্ন বুনেছিল তারা—যেখানে বই পড়া, রাজনীতি, সংগীত, আর চায়ের দোকানের লম্বা আলাপগুলো জীবনের নতুন মানে দিত।
তাদের প্রেমটা কোনো ‘প্রেম প্রস্তাব’-এ শুরু হয়নি। বরং ধীরে ধীরে, কথায়, চিন্তায়, বিশ্বাসে একে অপরকে জায়গা করে নিয়েছিল তারা।
মেঘলা ছিল একটু জেদি, মুখে যেটা আসে বলে দেয়। সায়ান ছিল নরম স্বভাবের, সৃষ্টিশীল, কবিতা লিখতো। আর এই বিপরীত মেরু দুই মানুষ একসাথে হলে কী হয়—তারা একে অপরকে ছাড়া ভাবতেই পারতো না।
তবুও বাস্তবতার কাঁটা একদিন এসে বিদ্ধ করলো স্বপ্নকে। মেঘলার পরিবার চায়নি তার এমন একজন ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক থাকুক, যার চাকরি নেই, বাড়ি নেই, শুধু কবিতা আছে। আর সায়ানও তখন বাধ্য হয়ে সরে গিয়েছিল, তার সেই পুরনো ডায়েরিতে একটা শেষ কবিতা লিখে—
"ভালোবাসা মানে পেয়েই ফেলতে হবে—এমন নয়,
ভালোবাসা মানে হারিয়েও রেখে দেওয়া…"
মেঘলা অনেক কেঁদেছিল। তারপর ধীরে ধীরে নিজেকে বদলেছে, কর্পোরেট চাকরি নিয়েছে, শহরে ফ্ল্যাট কিনেছে, স্বাধীন হয়েছে।
কিন্তু মাঝেমাঝে একা রাতে তার মাথার নিচের বালিশটা ভিজে যেত। কোনো ফোন নম্বর না থাকলেও সে অজান্তে সায়ানের কবিতার বই গুগল করে খুঁজতো, কোনো সংবাদ খুঁজতো কি সে এখনো লিখে চলে?
একদিন হঠাৎ মেইলে আসে একটি নিমন্ত্রণ—পুরনো বন্ধুদের পুনর্মিলনী, পাঁচ বছর পর।
আর সেখানেই লেখা ছিল… "সায়ান রহমান—আমন্ত্রিত কবি অতিথি"।
মেঘলা ঠিক করেছিল, সে যাবে। না, আর পালিয়ে বেড়ানো নয়। এতো বছর চুপ করে থাকার পর, সে অন্তত জানবে, কেন সায়ান চুপ হয়ে গিয়েছিল।
ঘড়ির কাঁটা পাঁচটা ছুঁতেই হলে উঠল একটা পুরনো স্কুটি, আর তাতে নেমে এল সেই পুরনো চেনা ছেলেটি—চোখে কালো ফ্রেম, হালকা দাড়ি, হাতে খসখসে ডায়েরি।
মেঘলার দম বন্ধ হয়ে আসছিল।
— "তুমি ঠিক আগের মতোই আছো…" সায়ান হেসে বললো।
— "তুমি না। তুমি অনেক শান্ত, অনেক দূরে।"
তারা পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো, হীরাঝিল পেরিয়ে, সেই পুরনো দিনগুলোর ছায়ায় গা ভিজিয়ে।
— "তুমি ভালো আছো তো?"
— "ভালো থাকার অভিনয়টা ভালো শিখেছি।"
এই সহজ কথাটাতে কেঁপে উঠল মেঘলার ভিতরটা। সে ভাবলো, এই ছেলেটা কি আজও…?
— "আমি জানি, হঠাৎ করে হারিয়ে যাওয়া ঠিক ছিল না," সায়ান বললো। "কিন্তু সেদিন যদি থেকে যেতাম, তোমার জীবনে হয়তো আজকের স্বাধীনতা আসতো না।"
— "তুমি আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে কে? আমার স্বাধীনতা তুমি না চাইলে আসতো না? তুমি শুধু চলে গেলে, একটা বারও জানতে চাওনি আমি কেমন?"
মেঘলার গলায় অভিমানের ঝাঁঝ। এতদিনের ক্ষোভটা বেরিয়ে এলো।
সায়ান থামলো। তার চোখে সেই চেনা কষ্ট, যা মেঘলা বারবার এড়াতে চেয়েছে।
— "আমি চেয়েছিলাম তুমি বড় হও, উঁচুতে ওঠো। আমি তখন কিছুই ছিলাম না।"
— "তুমি বুঝলে না, আমি যা ছিলাম, তাতেই সুখী ছিলাম। তুমি না থাকলে সব অর্জন শূন্য।"
তাদের মাঝে নিরবতা নেমে এল। শুধু পাখিদের ডাক, আর দূরে ভেসে আসা আজানের আওয়াজ।
— "চলো, আজ রাতটা হাঁটি। আজ আর কোনো ভান নয়। শুধু সত্যি কথা, মনের কথা," বললো মেঘলা।
সায়ান মুচকি হাসলো। দুজনে হেঁটে গেলো শহরের অচেনা রাস্তায়, ভেজা বাতাসে গা মেলে।
হেঁটে হেঁটে পুরনো গল্প খোলা হলো। তারা মনে করলো সেই এক বিকেল, যখন সায়ান বলেছিল—"ভালোবাসা মানে ধীরে ধীরে জানা, তাড়াহুড়ো নয়।"
মেঘলা সেই কথাটা বুকের ভেতর সযত্নে রেখেছিল।
তারা পৌঁছে গেলো বুয়েটের পিছনের রোডে, যেখানে প্রথমবার হাত ধরেছিল। পাঁচ বছর পেরিয়ে গিয়েছে, কিন্তু সেই প্রথম স্পর্শের স্মৃতি আজও তরতাজা।
— "তুমি কি এখনো লেখো?"
— "লিখি। শুধু তোমাকে নিয়ে আর লিখি না। কারণ তুমি তো আছো না।"
মেঘলার চোখ ভিজে যায়। সে বুঝতে পারে, সময় অনেক দূর নিয়ে গেলেও কিছু অনুভব কখনোই ফিকে হয় না।
রাত গভীর হতে থাকে। তারা বসে পড়ে একটি পার্কের বেঞ্চে। চুপচাপ। চারপাশে সাইলেন্স।
— "তুমি কি এখনো আমায় ভালোবাসো?" প্রশ্ন করে মেঘলা, এক নিঃশ্বাসে।
সায়ান কাঁপে। বলে না। শুধু মেঘলার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
— "বলো না! অন্তত এখন, এতদিন পরে..."
— "ভালোবাসি। প্রতিদিন, প্রতিরাতে, প্রতিটা কবিতায়। কিন্তু আমি জানি, আমরা এখন আলাদা মানুষ। তুমি সফল, আমি এখনও হেঁটে চলেছি রাস্তায়।"
মেঘলা হেসে উঠে দাঁড়ায়। বলে, "আমি সফল হতে চেয়েছিলাম না। শুধু তোমার সঙ্গে হাঁটতে চেয়েছিলাম। আজও চাই।"
সায়ান বলে, "তুমি তো এখন খুব বদলে গেছো।"
— "আমিও চেয়েছিলাম তুমি বদলে যাও। কিন্তু তুমি এখনও ঠিক আগের মতো। আমিও তাই ফিরে এসেছি।"
সায়ান ধীরে ধীরে তার হাত ধরে। মেঘলা চোখ বন্ধ করে।
পাঁচ বছরের কষ্ট, প্রশ্ন, কান্না—সব যেন এই এক মুহূর্তে ধুয়ে যায়।
আকাশে তখন অল্প জোছনা। বাতাসে শান্ত একটা সুবাস।
তারা হাঁটতে থাকে আবার, নতুন করে, পুরনো পথে। এবার আর পিছুটান নেই, অভিমান নেই।
শুধু অনুভূতির ভিড়ে, একে অপরকে আবার খুঁজে পাওয়ার উষ্ণতা আছে।
অনুভূতির ভিড়ে
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
26
Views
4
Likes
0
Comments
0.0
Rating