দেহ নয়, ভালোবাসি তোর মনকে
ঢাকার ব্যস্ততম সড়কের এক মোড়ে ছোট্ট একটা ক্যাফে, যেখানে বিকেলের নরম আলো পড়ে জানালার কাচে, সেখানে প্রথম দেখা হলো রাহিল আর লাবণীর। রাহিল ছিলেন মাঝবয়সী, চাকরিজীবী, ঢাকা শহরের এক নামি প্রতিষ্ঠানে মিডল ম্যানেজার। জীবন ছিল ব্যস্ততার এক ধাঁধা, অফিস, বাড়ি, আবার অফিস। আর লাবণী? গ্রাম থেকে উঠে আসা সেই মেয়েটি, যার শরীরের একটা অঙ্গ— তার হাঁটার পদ্ধতি ছিল অনমনীয়, একপায়ে একটু লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটার চেষ্টা করতো।
প্রথম দেখায় রাহিল ঠিক বুঝতে পারছিল না, কেন তার চোখ বারবার ঐ মেয়েটার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। লাবণীর হাসিটা ছিল অন্যরকম, সরল ও মধুর। সে কথা বলতে পারতো না খুব বেশি, কারণ একটা ছোট্ট শৈশবের দুর্ঘটনায় তার গলায় ক্ষত ছিল, আর সে কারণে কথা বলতে স্বাভাবিক হয়নি।
তবুও তার চোখ ছিল জীবনের এক অদ্ভুত গল্প বলার মতো। রাহিল বুঝতে পারছিল, সে অন্য যেকোনো মেয়ের থেকে আলাদা, কিন্তু সেটা তার কাছে বরং আকর্ষণীয়।
ক্যাফের পাশেই ছিল একটা ছোটো পার্ক। একদিন বিকেলে রাহিল পার্কের বেঞ্চে বসে ছিল, বই পড়ছিল। লাবণী আসলো, হাতেই ছিল ছোট্ট একটা বই। সে ধীর পায়ে বেঞ্চের পাশে এসে বসলো। রাহিল তাকে তাকিয়ে দেখল, মুখে হালকা হাসি। কিছুক্ষণ পরে লাবণী কন্ঠে গুঞ্জর করে বলল—
“তুমি বই পড়ছো?”
রাহিল একটু লাজুক স্বরে বলল—
“হ্যাঁ, এটা আমার প্রিয় বই।”
লাবণী বলল—
“আমারও প্রিয় বই। তুমি আমাকে পড়িয়ে দাও?”
সেদিন থেকেই তাদের মধ্যে কথা হতে শুরু করল, যদিও লাবণীর ভাষা ছিল কম, কিন্তু চোখ আর হাসির ভাষা ছিল অসীম। রাহিল ধীরে ধীরে বুঝতে লাগল, এই মেয়েটার মন এত বড়, এত ভীষণ ভালোবাসায় ভরা।
দুজনের কথা বলতে না পারার মধ্যে যেন একটা গভীর সংযোগ গড়ে উঠল। রাহিলের জীবনের সেই একঘেয়েমি দূর হতে শুরু করল, আর লাবণী পেয়েছিল এক ভালোবাসার হাত, যেটা তাকে সব সময় শক্তি দিত।
কিন্তু জীবন তো সবসময় মধুর নয়। রাহিলের পরিবার ও বন্ধুদের প্রশ্ন ছিল, সে কেন এমন একটা মেয়েকে ভালোবাসে? কেন নিজের আরামের ভিড়ে এই বঞ্চিত মেয়েকে নিয়ে আশেপাশের হাসি-তামাশার মুখোমুখি হয়?
রাহিল বুঝিয়ে বলত—
“ভালোবাসা দেহের নয়, মন ও হৃদয়ের ব্যাপার।”
তবে পারিবারিক চাপ দিনে দিনে বাড়তে থাকল। একদিন মা বলল—
“তুই কি ওর সাথে সত্যিই বসবাস করবে? ও তো অনেক আলাদা।”
রাহিল চুপ ছিল। সে জানত, ভালোবাসার পথ সহজ নয়।
তবে সে হাল ছাড়েনি। লাবণীকে সুরক্ষিত রাখতে নিজের জীবন উৎসর্গ করল।
একদিন রাহিল আর লাবণী ঢাকার ব্যস্ত রাস্তায় হাত ধরে হাঁটছিল। হঠাৎ কয়েকজন যুবক তাদের দিকে কটাক্ষ করলো। লাবণীর পায়ের হাঁটাচলা দেখে তারা হাসতে শুরু করলো। রাহিল রেগে গিয়ে তাদের সামনে দাঁড়াল, কিন্তু লাবণী তাকে থামালো। সে বলল—
“রাহিল, শান্ত থাকো। ভালোবাসার কাছে অবজ্ঞার কোনো স্থান নেই।”
রাহিল বুঝল, এই মেয়েটাই তার জীবনের সবচেয়ে বড় শক্তি।
তাদের ভালোবাসার গল্প শহরে আলোড়ন তুলল, অনেকে বিদ্রূপ করল, কিন্তু তারা একসঙ্গে দাঁড়িয়েছিল।
একদিন রাহিল প্রস্তাব দিল, লাবণীকে জীবনের সঙ্গী করে নিতে চায়। লাবণী চুপ করে, কিন্তু চোখে জল। সে জানতো, সে পায়ে বেগ পেয়েছে, কথা বলতে পারেনা, কিন্তু তার মনের গভীরতা ছিল অসীম।
বিয়ে হয়ে গেল। তাদের সংসার শুরু হল ছোট্ট একটি ফ্ল্যাটে। রাহিল যতটা সম্ভব লাবণীর যত্ন নিলেন। লাবণী ছোট্ট হাসি দিয়ে বলত—
“তুই আমার চোখ, আমার কান।”
আর রাহিল বলত—
“আর তুই আমার জীবন।”
কিন্তু সুখের মাঝে কিছু অসুবিধাও আসলো। লাবণীর অসুস্থতা মাঝে মাঝে বেড়ে যায়। আর রাহিলের চাকরির চাপ বাড়ে।
একদিন লাবণী হাসপাতালে ভর্তি হয়। রাহিল তার পাশে বসে ধরে রাখে হাত। সে তখন বলল—
“দেখিস, দেহ নয়, ভালোবাসি তোর মনকে, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।”
সেদিন থেকে রাহিল বুঝতে পারে, ভালোবাসার মানে দেহের সীমা ছাড়িয়ে যায়।
লাবণীর চোখে জ্বলজ্বল করছিল এক আলোর ঝলক, আর রাহিল বলল—
“তুই আমার হৃদয়ের গান।”
সেই দিনের পর থেকে, তারা একে অপরের হাতে হাত দিয়ে জীবন যুদ্ধে নামলো, দেহ নয়, মনকে ভালোবেসে।
দেহ নয়, ভালোবাসি তোর মনকে
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
29
Views
2
Likes
0
Comments
0.0
Rating