ভুলের মাশুল

অডিও মোড

00:00 00:00
গতি:
ভলিউম:
বিকেলটা ছিল খুব সাধারণ। না, আবহাওয়ার দিক থেকে না। বরং আবহাওয়া ছিল মন খারাপ করা রকমের সুন্দর— মেঘলা আকাশ, মাঝেমাঝে ছিটেফোঁটা বৃষ্টি, আর বাতাসে কেমন একটা স্মৃতির গন্ধ। কিন্তু তবুও, ওই বিকেলটা নীলা কখনোই ভুলতে পারবে না, কারণ সেদিনই তার প্রেম ভেঙেছিল।

রায়হান তাকে বলেছিল—

— “নীলা, তুমি খুব ভালো, কিন্তু আমাদের আর একসাথে থাকা সম্ভব না।”

শুধু এই কথাটা। কোনো কারণ, কোনো ব্যাখ্যা, কোনো আগাম সংকেত ছাড়াই। চার বছরের সম্পর্ক এক বাক্যে শেষ।

নীলা থমকে গিয়েছিল। কানের ভেতর যেন তালা পড়ে গিয়েছিল। রায়হানের মুখের শব্দ তার মাথায় ঢুকছিল না। সে তাকিয়ে ছিল, নিঃশব্দ, চোখে জমে উঠছিল অপ্রকাশ্য জল। তারপর সে শুধু বলেছিল—

— “তুমি এত বছর কী ভান করেছিলে রায়হান? ভালোবাসা? না অভিনয়?”

রায়হান মুখ নামিয়ে বলেছিল, “ভুল হয়ে গেছে। অনেক বড় ভুল।”

এই বলে চলে গিয়েছিল, চিরতরে।

রায়হান চলে যাওয়ার পর নীলার জীবন যেন থেমে গেল। কোথাও যেতে মন চায় না, কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। সে বাসার কোণায় বসে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, হাতে ফোন নিয়ে, পুরোনো মেসেজ পড়ে, চ্যাট লিস্টে রায়হানের নাম খুঁজে, কিন্তু সেখানে শুধু লেখা থাকে— “Last seen yesterday.”

তিন দিন পর, সে ফোন করেছিল রায়হানকে।

— “একবার বলো অন্তত, তুমি কাউকে পছন্দ করো?”

— “না, নীলা। আমি কাউকে ভালোবাসি না। শুধু আর পারছিলাম না তোমার সঙ্গে। তুমি বোঝো না, তুমি খুব চাপ দাও।”

— “চাপ? ভালোবাসা তো চাপ নয়।”

— “তোমার ভালোবাসা ছিল শ্বাসরুদ্ধ করা।”

এই কথাটা বুক ভেদ করে ঢুকে গিয়েছিল নীলার ভিতর। শ্বাসরুদ্ধ করা?

সে কি এতটাই বোঝাতে গিয়েছিল, যে সেটা অন্যের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছিল?

নিজেকে নিয়ে প্রশ্ন শুরু হয় তার। প্রতিদিন সে আয়নায় তাকিয়ে দেখে, কী এমন করেছিল সে, যে কেউ তাকে ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে?

আসলে, এটা ছিল প্রেমে প্রথম ভুল বোঝাবুঝির ফল। সম্পর্কটা ধীরে ধীরে বিষিয়ে উঠেছিল— রায়হান একটু স্বাধীনচেতা, নীলা একটু বেশি আবেগপ্রবণ। সে প্রতিটা খুঁটিনাটি জানতে চাইতো, রায়হান মাঝে মাঝে উত্তর দিত না। নীলা সন্দেহ করতো, আর সন্দেহ থেকে শুরু হতো ঝগড়া।

একদিন রায়হান বলেছিল—

— “সব কিছু না জানলেও সম্পর্ক চলে।”

নীলা বলেছিল—

— “সব না জানলে ভালোবাসা ফাঁপা হয়ে যায়।”

কিন্তু ওই ফাঁপা ভালোবাসাই একদিন দুজনকে ভেঙে দিল।

সময় পেরিয়ে যায়। এক মাস, দুই মাস, তারপর এক বছর।

নীলা এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষে। রায়হানের কোনো খবর নেই। কেউ আর খোঁজও রাখে না। কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই তাদের দেখা হয়ে যায় একটা বই মেলায়।

দুইজনই একসাথে একটা বুকস্টলে দাঁড়িয়ে, একজন একটা কবিতার বই দেখছে, আরেকজন উপন্যাস। চোখাচোখি হতেই মুহূর্তে ভ্রু কুঁচকে যায়। হঠাৎ যেন থমকে যায় সময়।

রায়হান বলেছিল—

— “তুমি কেমন আছো, নীলা?”

— “ভালো,” ঠান্ডা উত্তর। কিন্তু চোখ ভিজে উঠেছিল।

রায়হান কিছু একটা বলবে, এমন সময় একজন মেয়ে এগিয়ে আসে—

— “এই যে রায়হান, তুমি এখানে? আমি খুঁজছিলাম!”

নীলা তাকায়। চুপচাপ। মেয়েটি পরিচয় দেয়— “আমি রীমা, রায়হানের...।”

থেমে যায়।

নীলা আর কিছু বলে না। চুপচাপ বেরিয়ে আসে স্টল থেকে। পেছনে রায়হানের গলা আসে না।

পরদিন রাতে, হঠাৎ রায়হানের মেসেজ—

"আমি ভুল করেছিলাম। রীমা আমার বান্ধবী না। শুধু সহপাঠী। আমি তেমন কিছু ভাবি না ওকে নিয়ে।"

নীলা পড়ে, উত্তর দেয় না।

রায়হান আবার লেখে—

"তুমি কি কখনো মাফ করতে পারবে?"

এইবার নীলা লেখে—

"ভুলগুলো এমন জায়গায় মেশে, যেখানে ভালোবাসা ঠিকমতো দাঁড়াতে পারে না। তুমি সেই ভুলগুলো বোঝোনি, শুধরে নাওনি, শুধু পালিয়ে গেছো। তাই আজ আর বিশ্বাস করতে পারি না।"

রায়হান দীর্ঘক্ষণ typing... দেখায়, কিন্তু কোনো মেসেজ আসে না।

এরপর একটা রাত, যখন হঠাৎ করেই নীলার মা হাসপাতালে ভর্তি হন, হাই ব্লাড প্রেশার, চোখে ঘোলা দেখছেন। একা কেউ নেই, সব আত্মীয় দূরে। সে দৌড়ে দৌড়ে হাসপাতালের কাগজপত্র, ডাক্তার, ওষুধ — সব সামাল দিতে থাকে। হঠাৎ পিছনে একজনে বলে—

— “আমি আছি নীলা।”

সে ফিরে তাকিয়ে দেখে— রায়হান। একটা ওষুধের ব্যাগ হাতে, মুখে আতঙ্ক-ভরা দৃষ্টি।

নীলা কিছু বলে না। রায়হান পাশে বসে, মাকে পানি খাওয়ায়, ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে, পুরো রাত হাসপাতালে কাটায়।

সকালে মা কিছুটা সুস্থ হলে নীলা বাইরে এসে দাঁড়ায়।

— “তুমি আসলে?”

— “তোমার খোঁজে ছিলাম বহুদিন। কিন্তু তোমার রাগ এত গভীর ছিল যে সাহস পাইনি। আজ যদি না আসতাম, নিজেকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারতাম না।”

নীলা চোখ ঘুরিয়ে তাকায়।

— “তুমি বুঝতে পেরেছো তোমার ভুল?”

— “প্রতিটা রাতে, প্রতিটা নিঃশ্বাসে।”

— “ভুলের মাশুল দিতে রাজি?”

রায়হান থেমে যায়। তারপর ধীরে মাথা নাড়ে।

— “তুমি যা বলবে, আমি করবো। কষ্ট, অপমান, সময় — যা লাগে।”

নীলা একটু হেসে বলে—

— “তাহলে প্রথম কাজ — নতুন করে শুরু করতে চাইলে, পুরনো অভিমান ভুলে যেতে হবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ভালোবাসা কেবল আবেগ নয়, এটা দায়িত্বও।”

রায়হান হাত বাড়িয়ে দেয়। নীলা একটু দ্বিধায় ছিল। তারপর ধীরে ধীরে হাত রাখে তার হাতে।

এই হাত ধরাটা যেন ছিল সব ভুলের ক্ষমা।

এরপর আবার শুরু হয় সম্পর্ক। এইবার বেশি বুঝে, বেশি শুনে, বেশি জানার চেষ্টা করে একে অপরকে। ঝগড়া হয়, কিন্তু সেসব তাড়াতাড়ি মিটে যায়।

একদিন রায়হান নীলাকে জিজ্ঞেস করে—

— “তুমি কি এখনো বিশ্বাস করো, আমার ভালোবাসা সত্যি?”

নীলা বলে—

— “ভালোবাসা যখন ভুল থেকে ফিরে আসে, তখন সেটা আগের চেয়েও শক্তিশালী হয়।”

আর সত্যি, সেই মাশুল রায়হান নিয়েছিল। প্রতিটা জন্মদিনে নিজে হাতে কার্ড বানানো, প্রতিটা ভুল বোঝাবুঝিতে আগে ক্ষমা চাওয়া, প্রতিটা অভিমানে পাশে দাঁড়ানো — সে প্রমাণ করেছিল, সে বদলেছে।

একটা সময় পরে, তারা বিয়ে করে। ঘর বাঁধে। সুখে না হোক, আন্তরিকতায় গড়ে ওঠা সংসার।

ভুল করেছিল সে, কিন্তু সেই ভুলের মাশুল দিয়েই সে তার ভালোবাসাকে ফিরিয়ে এনেছিল।
26 Views
2 Likes
0 Comments
0.0 Rating
Rate this: