আদনান আর সাফা—দুজনেই ঢাকা শহরের বাসিন্দা। দুইজন দুই জগতে বড় হয়েছে। আদনান বড় হয়েছে গুলশানের এক অভিজাত পরিবারে, আর সাফা মোহাম্মদপুরের এক মধ্যবিত্ত ঘরে। আদনানের বাবা ব্যাংকার, মা অধ্যাপিকা। সাফার বাবা ছিলেন কলেজের শিক্ষক, মা গৃহিণী। এই দুই পৃথক জগতের মানুষ কীভাবে এক হলো, সেটা এক গল্প—একটা সাধারন, অথচ অসাধারণ গল্প, ঠিক “লাভ ম্যারেজ”-এর মতো।
তারা প্রথম দেখা করেছিল ঢাবির লাইব্রেরিতে, ইংরেজি বিভাগের করিডোরে। তখন তৃতীয় বর্ষ। সাফা তার একটি প্রবন্ধ নিয়ে খুব টেনশনে ছিল, কারণ ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না কীভাবে থিসিসটা সাজাবে। লাইব্রেরির একটা কর্নারে সে বসে কিছু বই টুকে নিচ্ছিল। পাশেই বসেছিল আদনান, নোটসে ডুবে ছিল। হঠাৎ সাফার কলম ছিটকে পড়ে যায়, গড়িয়ে আদনানের পায়ে এসে ঠেকে।
আদনান কলমটা হাতে তুলে দেয়ার সময় এক ঝলক চোখাচোখি হয়। হাসি বিনিময়। সেখানেই শুরু।
এরপর ধীরে ধীরে কথা বাড়ে। আদনান স্বাভাবিকভাবে খুব সংযত, কম কথা বলা মানুষ। কিন্তু সাফা ছিল প্রাণচঞ্চল, উৎসাহী, মাঝে মাঝে অতিরিক্ত জেদি। দুজনের মাঝে চূড়ান্ত বিপরীতধর্মী বৈশিষ্ট্য থাকলেও একধরনের অদ্ভুত মাধুর্য তৈরি হয় তাদের কথাবার্তায়। তারা পড়া শেষে একসাথে হাঁটত, চা খেত, পুরান ঢাকার অলিগলিতে ঘুরে বেড়াত। কখন যে একে অপরের না বলা কথায় জড়িয়ে পড়েছিল, তা কেউই জানে না।
একদিন ছায়াঘেরা বটগাছের নিচে বসে সাফা হঠাৎ বলে ফেলল, “তুমি জানো, আমি তোমাকে অনেক বেশি ভাবি। প্রতিদিন সকালেই ভাবি, আজকে তোমাকে দেখব।”
আদনান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিল, “তুমিও জানো, আমি আগে থেকেই জানতাম এটা। আমিও ভাবি। তবে বলিনি।”
সাফা হেসে বলেছিল, “কেন?”
আদনান বলেছিল, “কারণ আমি চেয়েছিলাম, তুমি আগে বলো। আমি তোমার চোখে বুঝে গিয়েছিলাম।”
সেই দিন থেকেই তাদের সম্পর্ক আরও গভীর হলো। ক্লাসের বাইরে, পড়ার বাইরে, ক্যাম্পাসের বাইরেও তারা একে অপরের ছায়া হয়ে গেল।
তবে সম্পর্কের বাস্তবতা ধরা দিল খুব তাড়াতাড়ি।
স্নাতক শেষ করে যখন তারা বাড়িতে জানায় সম্পর্কের কথা, তখনই প্রথম প্রতিরোধ আসে। আদনানের মা সরাসরি বলেছিলেন, “এই মেয়েটি তোমার সঙ্গে মানাবে না। তার পরিবারের পেছনে কী আছে? তোমার মতো ছেলেকে অনেক ভালো পারিবারিক মেয়ে পছন্দ করবে। এই প্রেমের ব্যাপারে ভেবো না।”
সাফার বাড়িতেও অবস্থা একই রকম। তার মা বলেছিলেন, “তোমার বাবা নেই, আমরা সাধারণ পরিবার। তারা তোমাকে ছেলের জন্য মানবে না। তুমি কষ্ট পাবে। এই প্রেম টিকে না।”
তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ধৈর্য ধরবে। একটু সময় দেবে। হয়তো পরিবার রাজি হবে।
কিন্তু সময় সবসময় ভালোবাসার味কে মিষ্টি করে না।
আদনানের পরিবার তাকে বিদেশে মাস্টার্স করতে পাঠিয়ে দেয়। যাওয়ার আগে সাফাকে বলেছিল, “আমি ফিরে আসব। আমি কথা দিচ্ছি, আমি তোমাকে বিয়ে করব। ওরা বুঝবে একদিন।”
সাফা কান্নাভেজা চোখে বলেছিল, “তুমি যদি ফিরে আস না, তাহলে আমি কখনোই বিশ্বাস করব না যে সত্যিকারের ভালোবাসা আছে।”
আদনান বিদেশে গেল। প্রথমদিকে নিয়মিত কথা হতো, ভিডিও কল, চিঠি, ইমেইল। সাফা শিক্ষকতার চাকরি নেয় ঢাকাতেই, টিউশনি করে, মাকে নিয়ে সংসার চালায়।
দু’বছর পেরিয়ে যায়।
আদনান ধীরে ধীরে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। চাকরি শুরু করে লন্ডনে। ফোন আসত সপ্তাহে একবার। সাফা বুঝতে পারত, দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। অথচ সে অপেক্ষা করত।
একদিন হঠাৎ ফোনে আদনান জানাল, “আম্মু অনেক অসুস্থ। আমি দেশে আসছি মাসখানেকের জন্য। দেখা হবে, কথা হবে।”
সাফার বুকের ভেতর কেঁপে উঠল, সে যেন আবার নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করল।
আদনান এলো। দেখা হলো। তবুও আগের সেই উচ্ছ্বাসটা আর নেই। চোখে তাকানোতে একরকম কৃতজ্ঞতা, একরকম অপরাধবোধ।
সাফা একদিন সোজাসুজি বলল, “তুমি কি এখনও আমাকে বিয়ে করবে?”
আদনান চুপ করে রইল কিছুক্ষণ।
“তোমার জন্য আমি লড়াই করতে পারিনি সাফা। আম্মু ক্যান্সার পেশেন্ট, এখন কিছুতেই আমি তার মনের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারব না।”
“তুমি মানে তোমার প্রেমও পরিবারের পায়ের নিচে পিষে গেল?”
“তুমি বলেছিলে, যদি না ফিরি, তাহলে বিশ্বাস করবে না ভালোবাসায়। এখন তুমি কী ভাবছো?”
সাফা তখন বলেছিল, “আমি এখন বুঝি—ভালোবাসা না হারায়, সাহস হারায়। ভালোবাসা তো থাকবেই, শুধু সাহস আর কমিটমেন্ট না থাকলে লাভ ম্যারেজ সম্ভব না।”
আদনান ফিরে গিয়েছিল।
এর পরের এক বছরে সাফা নিজেকে সামলে নিয়েছিল। সে বিশ্বাস করত, হারিয়ে যাওয়া মানে শেষ নয়। সে চাকরিতে মনোযোগ দিল, নিজের পড়াশোনাও চালিয়ে গেল। তারপর একদিন তার কলেজে নতুন একজন সহকারী শিক্ষক যোগ দিল—রাফায়েল রহমান।
সাদামাটা, ভদ্র, কিন্তু দারুণ গভীর মনোভাবের মানুষ। প্রথমদিনই সে বলেছিল, “আমি তোমার প্রবন্ধ পড়েছি পত্রিকায়। অসাধারণ লেখো। একদিন তোমার সঙ্গে এক কাপ চা খেতে চাই।”
সাফা হেসেছিল, “এক কাপ চা থেকে যদি সব শুরু হতো, তাহলে অনেক গল্প লিখে ফেলা যেত।”
রাফায়েল হেসে বলেছিল, “তাহলে একটা গল্প শুরু করি না আজ থেকেই?”
ধীরে ধীরে তারা বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। সাফা খেয়াল করেছিল, রাফায়েলের মধ্যে এমন কিছু ছিল যা স্থিরতা দেয়, কোনো তাড়া নেই, কোনো চাপ নেই। সে ভালোবাসা শব্দটা উচ্চারণ করে না, কিন্তু প্রতিদিন পাশে থাকে, ক্লান্ত হলে এক বোতল পানি হাতে দেয়, ব্যাগটা ধরে, সময়মতো ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে যায়।
একদিন সাফা নিজেই জিজ্ঞেস করেছিল, “তুমি তো কিছু বলো না। তুমি আমার পাশে আছো কেন?”
রাফায়েল উত্তর দিয়েছিল, “কারণ আমি চাই, তুমি জানো—সব প্রেম ব্যর্থ হয় না। কিছু প্রেম সময় নিয়ে আসে, গভীরতা নিয়ে আসে।”
সাফা চুপ করে ছিল। তার চোখে জল চলে এসেছিল।
আরও ছয় মাস পর, রাফায়েল বলেছিল, “তোমার সম্মতি থাকলে আমি আমার মা-বাবাকে পাঠাব তোমার বাসায়।”
সাফা প্রথমে দ্বিধায় পড়েছিল। তার ভেতরে এখনো আদনানের ছায়া রয়ে গেছে। কিন্তু ধীরে ধীরে সে বুঝেছিল, অতীত যতই গভীর হোক, ভবিষ্যতের পথে হাঁটতে হলে নতুন একজনের হাতে হাত রাখা দরকার। সে বলেছিল, “তুমি যদি আমাকে ভালোবাসো, তবে এটাকে শুধু একটা বিয়ে না ভেবে... একটা শ্রদ্ধার সম্পর্ক ভেবে এসো।”
রাফায়েল বলেছিল, “তোমার সম্মতি মানেই আমার জয়।”
বিয়েটা হয়েছিল খুব সাদামাটাভাবে। কোনো হইচই নয়, তামাশা নয়। শুধুই আত্মীয়-স্বজন আর বন্ধুবান্ধবের মধ্যে এক নিরব ভালোবাসার বন্ধন।
সাফা বিয়ের পরদিন রাতে চুপচাপ বসেছিল বারান্দায়। রাফায়েল পাশে এসে বসে বলেছিল, “চিন্তায় আছো?”
সাফা মাথা নাড়ে।
“ভালোবাসা ভুলে গেছো?”
সাফা তাকিয়ে বলে, “ভালোবাসা ভুলে যাওয়া যায় না, কিন্তু তার রূপ বদলে যায়।”
“তবে?”
“তবে আজকে আমি বুঝেছি, লাভ ম্যারেজ মানে শুধু প্রেম করে বিয়ে না... লাভ ম্যারেজ মানে এমন কাউকে বিয়ে করা, যে প্রতিদিন প্রেম করতে জানে।"
রাফায়েল হেসে বলে, “তবে আমাদের লাভ ম্যারেজ তো আজ থেকে শুরু।”
চাঁদটা তখন অর্ধেক, আলো নরম। সাফা জানত, আগামীকালও এই আলো থাকবে, আর তার পাশে থাকবে এমন একজন, যার চোখে শুধু প্রেম নয়, প্রতিজ্ঞাও থাকে।
লাভ ম্যারেজ
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
27
Views
3
Likes
0
Comments
0.0
Rating