রোদেলা দুপুর। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষ। বটতলার নিচে দাঁড়িয়ে ছিল ঋতু, হাতে একটা কফির কাপ, আর চোখ সোজা তাকিয়ে সামনের ছেলেটার দিকে। শুভ। বেঁকে যাওয়া চুল, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, আর সেই সহজ, নির্লিপ্ত হাঁটা—যেন শহরের কোনো কোলাহলই তাকে ছুঁতে পারে না।
ঋতুর মুখে একটানা কথা চলছিল,
— “তুমি জানো, আমি তোমাকে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম, সেদিনই বুঝেছিলাম, এই ছেলেটা একদিন আমার জীবনের ‘কিংবদন্তি’ হবে।”
শুভ একটু হেসে বলল,
— “তুমি না একেবারে সিনেমার ডায়লগ বলো।”
— “কারণ আমার জীবনটা সিনেমার মতো, শুভ। আর তুমি? তুমি সেই নায়ক, যে শেষ দৃশ্যেও নায়িকাকে না পেয়ে ফিরে যায় একা। কিন্তু তারপরও সে নায়ক।”
শুভ চুপ করে ছিল।
ঋতু এমনই। ঝড়ের মতো, খ্যাপাটে, অথচ ভিতরে গভীর এক নদীর মতো শান্ত। তার হাসির আড়ালে লুকানো থাকে হাজারো না-বলা গল্প, আর শুভ—তাকে দেখেই বুঝে যায় সেই না-বলা কথাগুলোর ভাষা। চার বছর ধরে ওদের বন্ধুত্ব। কিন্তু এই বন্ধুত্বের গা-ছোঁয়া প্রেমটা, কোনোদিন নাম পায়নি।
তবে ভালোবাসা কি সবসময় নাম চায়?
ঋতু বহুবার চেয়েছে বলতে,
— “শুভ, আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
তবে না, বলেনি। শুভর চোখে এক অদ্ভুত দ্বিধা। তার কাছে সম্পর্ক মানে দায়িত্ব। আর সে জানে, এই পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো নিজের প্রিয় মানুষটিকে চাওয়া, যখন তুমি জানো তাকে পাওয়া সম্ভব নয়।
তাদের শেষ সেমিস্টার। ক্যাম্পাসে বসন্তের ফুল। বাতাসে বিচ্ছেদের গন্ধ। হঠাৎ একদিন শুভ বলল,
— “ঋতু, আমি কানাডা যাচ্ছি মাস্টার্স করতে। স্কলারশিপ পেলাম।”
ঋতুর হাসি থেমে গেল।
— “তাহলে আমাদের গল্পটা এখানেই শেষ?”
— “গল্পগুলো শেষ হয় না, ঋতু। তারা পাতা গুটিয়ে রাখে। কোনো একদিন আবার খুলে পড়বে কেউ।”
— “তুমি কি আমাকে... একটুও?”
— “ভালোবাসি না, এটা বলবো না। কিন্তু ভালোবাসি, এটাও বলতে পারি না।”
ঋতুর চোখে জল আসে না। সে মাথা নেড়ে বলে,
— “ভালোবাসা যদি একতরফা হয়, তাও সেটা ভালোবাসা থাকে, শুভ। আমি তোমাকে আগলে রাখবো, এমনভাবে, যেভাবে কোনো মা তার মৃত সন্তানের পুতুল আগলে রাখে। চিরদিনই তুমি যে আমার।”
সেদিন ক্যাম্পাসের সবুজ মাঠে যে দুজন হাঁটছিল, তারা জানত, এটাই শেষ হাঁটা একসাথে। তারপর শুভ চলে যায়। সময় এগিয়ে যায়। ক্যাম্পাস বদলে যায়। ঋতু থেকে যায় একা।
...
৫ বছর পর।
ঋতু এখন একজন সফল সাংবাদিক। দেশের বড় মিডিয়াতে কাজ করে। নানা দেশে যায়, রিপোর্টিং করে। কিন্তু প্রতিদিন রাতে তার ঘুম আসার আগে, সে একটা ছবি খুলে দেখে—একটা ছেলের, যে এখন দূর দেশে আছে, অন্য জীবন গড়ে নিয়েছে।
বন্ধুদের মুখে মাঝে মাঝে শুনেছে, শুভ নাকি এক কানাডিয়ান মেয়েকে বিয়ে করেছে। কেউ আবার বলেছে, সে এখন একাই থাকে। কেউ জানে না আসলটা কী। কিন্তু ঋতুর হৃদয়ে শুভ ঠিক সেই আগের মতো—নীরব, দ্বিধাগ্রস্ত, অথচ অসম্ভব আপন।
একদিন হঠাৎ, অফিসে মেইল আসে।
“জেনেভা কনফারেন্স, রিপোর্টিং অ্যাসাইনমেন্ট।”
ঋতু ব্যাগ গোছায়। প্লেনে ওঠার আগে, খেয়াল করে, এই প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে যাচ্ছে সে। কেমন যেন এক অভ্যন্তরীণ উত্তেজনা।
জেনেভা—শীতের শহর। কনফারেন্স হোটেলের করিডোরে হঠাৎ করেই সে দেখে একজনকে। শুভ।
একদম বদলে যায় সবকিছু।
সময়, দূরত্ব, গল্প—সব থেমে যায়।
— “ঋতু?”
— “শুভ?”
— “তুমি এখানে?”
— “তুমি তো ছিলে কানাডায়।”
— “জেনেভাতে কাজ করছি এখন। UN প্রজেক্ট।”
ঋতুর মাথা ঘুরে যায়। এতদিন পর এতটা কাছে, এতটা হঠাৎ!
হোটেলের ছাদে বসে তারা অনেকক্ষণ কথা বলে। শুভ জানায়,
— “আমি বিয়ে করিনি। সম্পর্ক ছিল, কিন্তু কিছুটা ভেঙে পড়েছিলাম। সবকিছু ছেড়ে দিয়েছিলাম।”
ঋতু বলল,
— “আমি বিয়ে করিনি, শুভ। আমি কাউকে পারিনি… পারিনি তোদের মতো করে ভালোবাসতে।”
শুভ চুপ করে থাকে। হঠাৎ বলে,
— “ঋতু, তুমি কি এখনো সেই আগের মতো?”
— “আমি তো থেমে ছিলাম, শুভ। তুমি যাও, আমি অপেক্ষা করি, এটাই ছিল আমাদের চুক্তি, মনে নেই?”
— “আমরা তো কোনোদিন চুক্তি করিনি।”
— “ভালোবাসার যে ভাষা, তা কাগজে লেখা হয় না, শুভ।”
সেই রাতে শুভ বলেছিল,
— “ঋতু, তুমি কি আমাকে এখনো ভালোবাসো?”
— “ভালোবাসি না এমন অভিনয় করতে পারি, কিন্তু সত্যিটা বদলাতে পারি না।”
— “তাহলে এবার আমিও বলি—চিরদিনই তুমি যে আমার।”
ঋতু একটুও কাঁদেনি সেদিন। শুধু হাতটা বাড়িয়ে বলেছিল,
— “তুমি ফিরেছো, এবার আর হাত ছেড়ো না।”
...
৩ বছর পর।
বাংলাদেশ। এক ক্যাফে। দেওয়ালে টানানো ছোট ছোট ছবি, আর ভিতরে রোদ এসে পড়ছে ঝাঁপির ফাঁক দিয়ে।
ঋতু আর শুভ বসে আছে একসাথে। তাদের মাঝখানে ছোট্ট এক মেয়ে, ছয় বছরের—নাম, চিরা।
ঋতু বলেছে,
— “তোমার চিরদিন-ই যে আমি, তার নাম রাখলাম চিরা।”
শুভ হেসে বলে,
— “তবে ওর পুরো নাম হওয়া উচিত—চিরদিনই তুমি যে আমার।”
ওরা এখনো ক্যাম্পাসে যায়, নিজেদের পুরোনো সেই বটগাছের নিচে বসে। শুভ গিটারে বাজায়, ঋতু গুনগুন করে। আর চিরা দৌড়ায় চারপাশে, আর বলে,
— “তোমরা কি এখনো প্রেম করো?”
ঋতু হাসে, শুভ চোখ মেলে চায়, আর বলে,
— “চিরদিনই তোমার মা যে আমার…”
চিরদিনই তুমি যে আমার
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
33
Views
3
Likes
0
Comments
0.0
Rating