চেনা অচেনা

অডিও মোড

00:00 00:00
গতি:
ভলিউম:
শহরটা বড় অদ্ভুত। হাজারো মানুষ, হাজারো মুখ, অথচ কত চেনা লাগে কেউ কেউ। আবার কেউ কেউ... অনেকদিনের পরিচিত হয়েও অচেনা থেকে যায়। ঠিক যেমন সে—আরিবা। চেনা মুখ, অচেনা মনের কুয়াশায় ঢাকা।

শহরের ব্যস্ত রাস্তার ঠিক মাঝখানে একটা ছোট ক্যাফে—“কফি কালেক্টিভ”—প্রায় প্রতিদিন বিকেলের দিকে এখানে এসে বসি আমি, নাভিদ। কাজ শেষে এক কাপ কফি, কানে হেডফোন গুঁজে থাকা, আর কিছু গল্পের খসড়া লেখা। হ্যাঁ, আমি লেখক, নতুন পুরনো গল্পে বাঁচি। কিন্তু আজকের গল্পটা আমার লেখার নয়, আমার জীবনের।

প্রথম যেদিন আরিবাকে দেখলাম, ক্যাফের কোন এক কোণে বসে ছিল। কফির কাপ ঠোঁটে ঠেকানো, চোখ দুটো জানালার বাইরে ঝুলছিল। তার চোখে কোনো গ্লানি ছিল না, আবার উচ্ছ্বাসও না—শুধু একধরনের অভ্যস্ত নির্লিপ্ততা। সে পড়ছিল “The Forty Rules of Love”। আমি বিস্মিত হলাম, এ বই তো আমি খুব কম মানুষকে পড়তে দেখি। একটা চুমুক দিয়ে আমি নিজের টেবিলেই ফিরে এলাম, কিন্তু চোখ ঠিক আটকে রইল তার দিকেই।

এরপর দিনে দিনে একটা অভ্যাস গড়ে উঠল—কফি খেতে খেতে ওর দিকে তাকানো। প্রথমে হয়তো সে খেয়ালই করত না, বা করত, বুঝতে দিত না। একদিন হঠাৎ সে চোখ তুলে তাকাল, চোখে চোখ পড়তেই কেমন যেন সাড়া দিয়ে উঠল বুকের ভেতর। সে হেসে ফেলল হালকা করে। আমি হাত তুলে একটু ইশারা করলাম। সে হাসল, কিন্তু মাথা নাড়ল না। যেন বলছে—“আজ না, পরে হবে।”

দিনগুলো কেটে যেতে লাগল। আমি চেষ্টা করতাম একসাথে কথা বলার সুযোগ খুঁজতে, আরিবা যেন সেই ছায়া—যাকে স্পর্শ করা যায় না, কেবল অনুভব করা যায়।

একদিন হঠাৎ সে আমার টেবিলে এসে বসে পড়ল।

— “তুমি প্রতিদিন এখানে আসো কেন?”

— “তোমাকেই দেখতে,” বলে ফেললাম সাহস করে।

সে অবাক হলো না। হেসে বলল, “অনেকেই এমন বলেছে। তুমিও সেই লিস্টে চলে গেলে।”

— “না, আমি একমাত্র। কারণ আমি শুধু দেখিনি, অনুভব করেছি।”

সে হালকা হেসে বলল, “তুমি লেখক?”

আমি মাথা নাড়লাম। বললাম, “তুমি কেমন করে বুঝলে?”

— “তোমার চোখে গল্পের ছায়া আছে। আর যারা অনেক তাকিয়ে দেখে, তারা লিখতেও পারে।”

সেই ছিল আমাদের প্রথম কথা। তারপর থেকে প্রতিদিন ও আসত, কখনো আমার পাশে বসত, কখনো জানালার পাশে। আমরা একসাথে কফি খেতাম, গল্প করতাম, বই বদল করতাম। আরিবা ছিল খুব গভীর মননের মানুষ। ওর চোখে একটা নিরব দুরত্ব থাকত সব কিছুর সঙ্গে। যেন পৃথিবীতে থেকেও ও এই পৃথিবীর নয়।

আমি ধীরে ধীরে ওর প্রেমে পড়ে যাই—না, পড়ে যাই বললে ভুল হবে। আমি তাতে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাই। কিন্তু সে কখনো বলত না, “আমিও তোমায় ভালোবাসি।” ও বলত—

— “তুমি অনেক ভালো। তুমি খুব ভালোবাসার যোগ্য।”

— “তাহলে বলো না কেন, তুমিও ভালোবাসো?”

— “ভালোবাসলে কি বলতে হয় সবসময়?”

— “আমি চাই নিশ্চিত হতে... আমি চাই তোমার পাশে থাকতে সারাজীবন।”

ও কিছু বলত না। শুধু চুপ করে তাকিয়ে থাকত আমার দিকে।

হঠাৎ একদিন আরিবা আর এল না। একদিন, দুইদিন, তিনদিন… পুরো সপ্তাহ পেরিয়ে গেল। ক্যাফে রোজ একা বসে থাকতাম। ফোন নম্বর চাওয়ার সুযোগও হয়নি। ওর নামে কোনো সোশ্যাল মিডিয়ায় খোঁজ নেই, যেন ও ছিলই না।

আমি ভেঙে পড়েছিলাম। এমন এক অচেনা মেয়ের জন্য, যার চোখে আমি এক পৃথিবী দেখেছি, কিন্তু যার অস্তিত্ব ছিল কুয়াশার মতো। অনেক দিন ধরে আমি ক্যাফেতে বসে অপেক্ষা করতাম, মাঝে মাঝে চুপ করে ওর পড়া বইগুলোর পাতা উল্টাতাম, যেন তার গন্ধ মিশে আছে সেখানে।

তিন মাস পর, ঠিক এক বিকেলে ও এসে দাঁড়াল। আগের মতো হাসি নেই মুখে, চোখের নিচে হালকা ক্লান্তির রেখা।

— “চলবে একটু হাঁটতে?” বলল সে।

আমি উঠে পড়লাম, কোনো প্রশ্ন না করে।

হাঁটতে হাঁটতে বলল, “তুমি অনেক খুঁজেছিলে আমাকে, জানি।”

— “তুমি কোথায় ছিলে?”

— “চিকিৎসা চলছিল আমার। কিছুদিনের জন্য হসপিটালে ছিলাম।”

— “তুমি অসুস্থ?”

— “হ্যাঁ... ব্রেন টিউমার। গত তিন বছর হলো চলছে। মাঝে মাঝে হঠাৎ ব্ল্যাকআউট হয়ে যায়, স্মৃতি গুলিয়ে যায়। চিকিৎসক বলেছিল, কোনো কিছুতে জড়িয়ে না পড়াই ভালো। কিন্তু তোমার দিকে তাকিয়ে আমি ভুলে গিয়েছিলাম আমি একজন রোগী। তোমার সঙ্গে সময় কাটাতে কাটাতে মনে হচ্ছিল আমি জীবিত।”

আমি নির্বাক হয়ে গিয়েছিলাম। কিছু বলার ছিল না। শুধু ওর হাতটা চেপে ধরলাম।

আরিবা বলল, “আমি জানি, আমরা একসাথে থাকতে পারবো না। আমি জানি, আমার সময় খুব বেশি নেই। কিন্তু তোমার ভালোবাসার ছায়া আমার মৃত্যু পর্যন্ত থাকবে।”

আমি বললাম, “তুমি থাকো। আমি আছি। আমি তোমার পাশেই থাকব যতদিন তুমি চাও।”

সেই থেকে প্রতিদিন আমরা হাঁটতাম, কথা বলতাম, বই পড়তাম, আবার গল্প লিখতাম। আমি লিখতে শুরু করেছিলাম ওকে নিয়ে—চেনা অচেনা নামের এক কাহিনি। আমি জানতাম, একদিন এই গল্পের চরিত্রটা থাকবে না, তবুও লিখতাম।

শেষবার যখন ওর চোখে তাকিয়েছিলাম, তখন ছিল হাসপাতালের এক ঠাণ্ডা বিছানা। ও বলল, “নাভিদ, আমার শেষ ইচ্ছে তুমি জানো?”

আমি বললাম, “জানি না।”

“তুমি আমাদের গল্পটা শেষ করো। তোমার লেখার ভেতর আমি বেঁচে থাকতে চাই, সব পাঠকের হৃদয়ে।”

তারপর সে চোখ বুজল। শান্ত, নিস্তব্ধ, অথচ চোখে তখনো সেই মায়া—যেটা ছিল প্রথমদিন দেখা সেই জানালার পাশে বসা মেয়েটার চোখে।

আমি এখনো কফি কালেক্টিভে যাই। এখনো জানালার পাশে বসে একটা খালি চেয়ার রেখে দিই। আর আমি লিখি—আরিবার গল্প, আমাদের গল্প, চেনা অচেনা এক ভালোবাসার গল্প।
24 Views
3 Likes
0 Comments
0.0 Rating
Rate this: