হঠাৎ করেই খামে মোড়ানো একটা চিঠি হাতে এলো। নাম ঠিকানায় আমার নাম লেখা, লেখার ভঙ্গি পুরোনো চেনা, ঠিক যেমন করে তুই লিখতিস—শব্দের ফাঁকে ফাঁকে আবেগের কালি ছড়ানো, যেন প্রতিটা অক্ষরে লুকিয়ে আছে অতীতের ছায়া। আমি থমকে গেলাম, কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ তাকিয়ে রইলাম খামের দিকে। আজ থেকে প্রায় ছয় বছর আগে যে সম্পর্কটাকে সমাধি দিয়ে এসেছি ভেবেছিলাম, আজ সেই কবর থেকে উঠে এসেছে শব্দ হয়ে, অক্ষর হয়ে।
খাম খুলতেই হাত কেঁপে গেল। যেন সময়ের গোপন দরজা খুলে গেছে হঠাৎ করে। চিঠিটা ছিল ঠিক তেমনই, যেমন করে তুই সবসময় লিখতিস—মুগ্ধ করা বিশুদ্ধ বাংলা, আবেগে ভরপুর, আর নিঃসঙ্গ এক আত্মার কথা।
"রাফি, জানি চমকে উঠেছিস। জানতাম, তুই ভুলে গেছিস আমায়। ভুলে যাওয়ারই কথা। আমি তোকে সেই অধিকারটুকু দিয়েই গিয়েছিলাম। কিন্তু আজ হঠাৎ একটা বিকেলের বিষণ্ণ আলোয় তোকে মনে পড়ল... মনে পড়ল শেষবার যখন তোকে দেখেছিলাম, তোর চোখে তখন অভিমান ছিল, না ভালোবাসা—আমি বুঝতে পারিনি..."
চিঠির এই প্রথম কয়েক লাইনেই বুকটা কেমন করে উঠল। আয়েশা—এই নামটাই তো আজ বহুদিন পর আমার কানে বাজলো। সেই মেয়েটা, যে আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসা ছিল, আবার একই সাথে এক অপূর্ণ অধ্যায়। আমরা একসাথে পড়তাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। একই বিভাগে, একই ব্যাচে। প্রথমদিকে কোনো ভাবই ছিল না, শুধু সহপাঠী ছিলাম। কিন্তু ধীরে ধীরে—কখন, কীভাবে, কোন চোখে তাকানোয়, কোন নীরব হেঁটে যাওয়ায়, কোন এক কাপ চায়ের টেবিলে—ভালোবাসা এসে বাসা বাঁধে, কেউ বুঝতে পারিনি।
আমি বরাবরই একটু চুপচাপ, বইয়ে ডুবে থাকা মানুষ। আর আয়েশা ছিল ঠিক উল্টো, প্রাণচঞ্চল, হাসিখুশি, যে কোনো রুমে ঢুকলেই আলো ছড়িয়ে দিত। তার ঠোঁটে সবসময় লেগে থাকত একটা গান—পুরোনো রবীন্দ্রসংগীত কিংবা আধুনিক মেলোডি, আর সেই গানের মাঝেই লুকিয়ে থাকত তার অনুভব। প্রথম যেদিন আয়েশা ক্লাস শেষে এসে বলল, “রাফি, চল না আজ একটু হেঁটে আসি,” আমি কিছু না ভেবেই হ্যাঁ বলেছিলাম। সেই হাঁটা ছিল না শুধুই হাঁটা—ওটা ছিল এক সম্পর্কের শুরু।
বছর দুয়েকের মধ্যে আমাদের ভালোবাসাটা গভীর হয়ে উঠেছিল। আমরা একসাথে স্বপ্ন দেখতে শিখে ফেলেছিলাম, ভবিষ্যতের সংসার, ছোট্ট একটা বাসা, বইয়ের তাক, রোদের বারান্দা, আর দুই মগ চা। কিন্তু জীবন তো সব সময় কবিতার মতো হয় না।
আমার পরিবার আয়েশাকে মেনে নিতে পারেনি। কারণ আয়েশা ছিল একেবারে আলাদা এক পরিবেশ থেকে আসা মেয়ে। মায়ের ভাষায়, “মেয়েটার ভেতরে ঠুনকো স্বাধীনতার চাহিদা আছে, সংসার টিকবে না।” আমি বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করেছি, “মা, ওর ওই স্বাধীনতা মানেই তো বাঁচার রং।” কিন্তু তাতে কিছু বদলায়নি।
আয়েশা তখনও আমার পাশে ছিল, আগলে ছিল সবটা। কিন্তু একদিন সে নিজেই বলল, “রাফি, আমি আর তোমার বিপরীতে দাঁড়াতে চাই না। তোমার পরিবার তোমার ভেতরেই বাস করে, আর আমি যদি সেখানে কারো মতো না হই, তবে একদিন না একদিন তুমি আমাকেই দোষ দেবে।”
আমি প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিলাম সেদিন। বলেছিলাম, “তুই চাইছিস পালাতে?” আয়েশা কাঁদছিল, কিন্তু তবু বলল, “না রাফি, আমি চাইছি তোকে রক্ষা করতে। তুই যাতে একদিন আমাকে দোষ না দিস।”
এরপর সে চলে গিয়েছিল। কোনো ফোন, কোনো বার্তা, কিছুই না। আমি অনেক দিন অপেক্ষা করেছিলাম। তারপর একদিন জানিয়ে দিয়েছিলাম মনকে—আয়েশা আর আসবে না। তুই ভালো আছিস নিশ্চয়, এই ভেবে নিজেকে শান্ত রেখেছিলাম।
চিঠির পরের অংশটা আবার খুললাম:
"আমি এখনো সেই পুরোনো বইগুলো রেখে দিয়েছি, যেগুলো একসাথে কিনেছিলাম—'শেষের কবিতা', 'দেবদাস', 'ললিতা'... তুই বলেছিলি, একদিন আমাদের গল্পও হবে বইয়ের মতো। কিন্তু জানিস রাফি, কিছু গল্প বই হয়ে উঠতে পারে না, কারণ সেগুলো শেষ হয় না, শুধু থেমে যায়।
তুই হয়তো জেনে গেছিস, আমি এখন কলকাতায় থাকি, ইউনেস্কোতে কাজ করি। নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছি জীবন। একদিন তোর নাম পেলাম একটা গবেষণাপত্রে—তুই এখন শিক্ষক! শুনে বুকটা গর্বে ভরে উঠল, জানিস?
আমি জানি, আমরা আর একসাথে হব না। আমি চাইও না। এখন না। কারণ ভালোবাসা মানে সব সময় একসাথে থাকা না রাফি, ভালোবাসা মানে কখনো কখনো ছেড়ে দেওয়াও। তোর প্রতি কোনো অভিমান নেই, কষ্ট নেই, শুধু ভালোবাসা রয়ে গেছে।"
চিঠির শেষে লেখা ছিল—
"আজ পেলাম তোমার পুরোনো একটা ছবি। মনে পড়ল সেই বিকেলটার কথা, যখন তোকে শেষ দেখেছিলাম। ঠিক তখনই ভেবেছিলাম লিখব। তাই লিখলাম। ভালো থাকিস রাফি। কোনো একদিন যদি আবার দেখা হয়—তবে শুধু হাসিস, কিছু বলিস না।
— আয়েশা"
চিঠিটা পড়ে শেষ করতেই বুঝলাম, কিছু কষ্ট কোনোদিন পুরোনো হয় না, শুধু আমরা সেটার ওপর ধুলো বসতে দিই। আয়েশা চলে গিয়েছিল, কিন্তু আমার ভেতর থেকে যায়নি কোনোদিন। আমি ওকে ভালোবাসতাম, আর আজ বুঝলাম—ওও ভালোবেসেছিল, শুধু ভিন্নরকমে।
চিঠিটা বুকের ভেতর চেপে ধরলাম। বাইরে তখন মৃদু বৃষ্টি পড়ছে, জানালার কাচে টুপটাপ শব্দ। ঠিক যেমন আমাদের দুজনের ভেতর অনেক না বলা শব্দ জমে ছিল। হয়তো আর কোনো চিঠি আসবে না, হয়তো কোনোদিন দেখা হবে না—কিন্তু এই চিঠিটা আজকে আমার ভেতরে আলো জ্বেলে দিয়ে গেল।
আমি ধীরে ধীরে আমার ডেস্কে বসলাম। সাদা কাগজ বের করে কলম তুলে নিলাম। লিখতে শুরু করলাম—
“প্রিয় আয়েশা,
আজ পেলাম তোমার চিঠি...”
আজ পেলাম তোমার চিঠি
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
27
Views
4
Likes
0
Comments
5.0
Rating