সিলেট শহরের টিলাঘেরা অঞ্চলটা একসময় শুধুই প্রাকৃতিক শোভায় ভরা ছিল। এখন সেখানে গড়ে উঠেছে নতুন এক চৌকস স্বপ্নের জগৎ—সিলেট টেকনো হাব। বিশাল এক স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম। শহরের ছেলেমেয়েরা এখন আর শুধু মেডিকেল বা বিসিএস নয়, কেউ কেউ স্বপ্ন দেখে গ্লোবাল টেক জায়ান্টে যাওয়ার। এই বদলে যাওয়া সিলেটের কেন্দ্রবিন্দুতে এক তরুণ কাজ করে, নাম তার রায়হান চৌধুরী।
রায়হান একজন কাইন্ডা অদ্ভুত প্রকৃতির সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। মোবাইলে গেম বানায়, রাত জেগে কোড করে, আর ছুটির দিনগুলোতে সাইকেলে করে শহর ঘোরে। সে এমন একজন—যে প্রেমে পড়লে নিজেই বুঝবে না। তার পৃথিবী মানে ল্যাপটপ, কফি আর একাকী ডেডলাইন।
কিন্তু সেই নিঃসঙ্গ ঘূর্ণির মধ্যে ঢুকে পড়েছিল এক আগুন্তুক। নাম জারিন নাওয়াল। লন্ডন থেকে ফিরেছে মাত্র তিন মাস। পড়েছে স্টার্টআপ এক্সিলারেটরের ডিরেক্টর হিসেবে। নীল রঙের কুর্তি পরা, মাথায় ঘন চুল, চোখে রিমলেস চশমা। হাসলে ঠোঁটের কোণটায় ছোট্ট একটা ভাঁজ পড়ে। আর সেই হাসি... একবার দেখলে রায়হানের মতো বোকাও ডিপ ফ্রিজড হার্ট গলে ফেলতে পারে।
ওদের প্রথম দেখা এক প্রেজেন্টেশনে। রায়হানের স্টার্টআপ ‘গেমগ্রিড’ নির্বাচিত হয়েছে ‘আলোর খোঁজে’ প্রজেক্টে। সে গেম বানাচ্ছে বাচ্চাদের মেন্টাল হেল্থ নিয়ে, যেখানে অবসাদ আর আত্মবিশ্বাসকে রঙ দিয়ে বোঝানো হয়। সবাই প্রশংসা করলেও, একমাত্র জারিন দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করেছিল, “এই গেমে আপনি যে চরিত্রটা আত্মবিশ্বাসের প্রতীক বলেছেন, তার মুখটা এমন উদাস কেন?”
রায়হান প্রথমবার কোনো মেয়েকে বলেছিল, “আপনি এত মনোযোগী কেন?”
জারিন হেসে বলেছিল, “কারণ আমি নিজের আত্মবিশ্বাস অনেকবার খুঁজে পেয়েছি, হারিয়েছি। জানি কতটা দরকার ওর মুখে হাসি থাকা।”
সেদিন থেকেই রায়হান তাকে একটু আলাদাভাবে দেখতে শুরু করে।
জারিন অফিসে কঠোর, ধনাত্মক, ফোকাসড। কিন্তু অফিসের বাইরেও সে এক অন্য মানুষ। সে টুকটাক নাটক করে, রবীন্দ্রনাথ পড়ে, সিলেটি আচার খায় আর মাঝে মাঝে হঠাৎ করে রায়হানকে বলে, “চলো, আজকে শহর না দেখে গ্রামের দিকে যাই।”
রায়হানের পৃথিবী ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে। সে এখন আর কোড কম লিখে না, তবে মাঝে মাঝে যখন জারিনের সঙ্গে রিকশায় বসে শহরের আলো দেখে, তখন হার্ডডিস্কে জমে থাকা অনুভূতিরা একটু একটু করে অনুবাদ হতে থাকে ভালোবাসায়।
কিন্তু রায়হান নিজেকে খুব সাধারণ ভাবে। তার ভেতর একধরনের ভয়—এই মেয়েটা এত বড় জীবন কাটিয়ে এসেছে, আর সে একজন ছোট শহরের প্রোডাক্ট গিক।
একদিন জারিন বলল, “রায়হান, তুমি জানো? লন্ডনে থাকার সময় কেউ কখনও আমার চোখে চোখ রেখে বলেনি, ‘তোমার এই নির্ভরতা আমার ভরসা লাগে।’ তুমি ছাড়া কেউ না।”
রায়হান চুপ করে থাকে। তারপর বলে, “তুমি লন্ডনের মেয়ে, আমি তো সিলেটের... এত দূরের দুই পাড়, জারিন।”
“ভালোবাসা নদী না রায়হান, সেতু। দূরের দুটো পাড়কে এক করে দেয়। শুধু সাহস লাগে পার হতে।”
রায়হান জবাব দিতে পারেনি। তবে মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়, এবার সে জারিনকে আর প্রশ্ন করবে না, শুধু পাশে দাঁড়িয়ে থাকবে।
তাদের গল্প এগোতে থাকে ছোট ছোট মুহূর্তে—ভুল করে একসঙ্গে বাস মিস করা, ঝগড়া করে কফির কাপ ছুড়ে ফেলা, আবার সেই কাপে নিজের হাতে বানানো মিষ্টি দই খাওয়ানো।
একদিন জারিন বলে, “তোমার গেমটা কবে গ্লোবাল রিলিজ দেবে?”
রায়হান হাসে, “যেদিন তুমি অফিস থেকে ফুল রিলিজ পাবে, আর আমার সঙ্গে রিলিজ হয়ে যাবে।”
জারিন থমকে যায়। তারপর বলে, “তুমি কি চাও আমি এখানে থেকে যাই?”
“না। আমি চাই তুমি যেখানে যাও, আমি যেন পারি তোমার সঙ্গে যেতে।”
সেই প্রথম রায়হান স্পষ্ট করে ভালোবাসার কথা বলে।
কিন্তু গল্প তখনই মোড় নেয়, যখন জানা যায় জারিনের বাবার স্ট্রোক হয়েছে। ওকে ফিরতে হবে লন্ডনে। চিরদিনের জন্য না, কিন্তু কতদিনের জন্য তাও বোঝা যায় না।
রায়হান হিমশীতল মুখে বলে, “তুমি যাও। আমি আছি এখানে। আমাদের গল্প থামবে না।”
জারিন চলে যায়। রায়হান আবার কোডে ফিরে যায়, কিন্তু এবার ওর গেমে নতুন একটা লেভেল আসে—“Homecoming”। যেখানে একটা চরিত্র হাজার বাধা পেরিয়ে ফিরে আসে তার ছোট্ট শহরে, তার ছোট্ট ভালোবাসার কাছে।
দু’বছর কেটে যায়।
রায়হান এখন তার গেম দিয়ে আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে। কিন্তু সে আজও প্রতিদিন সন্ধ্যায় টিলার মাথায় বসে থাকে, জারিন ফিরবে বলে।
একদিন শহরের কফি শপে বসে সে হঠাৎ দেখতে পায়—একটা মেয়ের চোখের কোণে সেই পরিচিত ভাঁজটা। রিমলেস চশমা, নীল কুর্তি, আর ঠোঁটের কোণায় হালকা হাসি।
“তুমি তো এখনও দিওয়ানা আছো,” মেয়েটা বলে।
রায়হান চুপচাপ বলে, “তুমিও তো ফিরেছো, সেই দিওয়ানাটার কাছে।”
সেদিন তারা আর কোনো কথা বলেনি। শুধু রিকশায় উঠে শহরটা ঘুরে এসেছে আবার, একটানা তিন ঘণ্টা।
সেই রাতে রায়হান তার গেমে নতুন ক্যারেক্টার যোগ করে—“Zareen: The Anchor of Dreams”
এবং নিচে একটা লাইনে লেখে:
"Love is not a destination, it's the courage to wait for the return."
দিওয়ানা
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
29
Views
2
Likes
0
Comments
0.0
Rating