অগ্নি-পরিক্ষা

অডিও মোড

00:00 00:00
গতি:
ভলিউম:
চট্টগ্রাম শহরটা পাহাড় আর সমুদ্রের মিলনস্থল। কিন্তু শহরের এই সৌন্দর্য ছাপিয়ে কেউ কেউ বাঁচে নিজেদের ভিতরের পাহাড়-সমুদ্র নিয়ে—কখনো স্থির, কখনো উত্তাল। ঠিক যেমন আরিবা আর আশফি।

আরিবা একজন স্কুলশিক্ষিকা। পাহাড়তলীর এক পুরনো স্কুলে পড়ান ইংরেজি। বাবা নেই, মা থাকেন দূরে, বান্দরবানের এক মিশনে। জীবন কেটেছে সংগ্রামে, কিন্তু কখনো মুখ ঝাপটা দেয়নি। সে চুপচাপ, দৃঢ়, আর ভেতরে ভিতরে বিশাল এক পাহাড়—চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, তবু নড়ে না।

আশফি, ঠিক তার উল্টো। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের শিক্ষক, ফটোগ্রাফির নেশা আছে। চঞ্চল, রোমান্টিক, আর নিজের মতাদর্শ নিয়ে খুব স্পষ্ট। তার মতে, জীবন মানে একটা চলমান সিনেমা—দৃশ্য বদলায়, কিন্তু ভালোবাসার পাত্র–পাত্রীরা থেকে যায়।

তাদের প্রথম দেখা হয় এক সাহিত্যসভায়। আরিবার লেখা ছোটগল্প “অগ্নি–পরীক্ষা” পড়ছিলেন এক আবৃত্তিকার। গল্পটা ছিল একটা মেয়ের, যে স্বপ্ন দেখে ডাক্তার হওয়ার, কিন্তু পরিবার চায় বিয়ের পিঁড়িতে। শেষে মেয়েটা বলে, “ভালোবাসা মানে যদি আত্মবিসর্জন হয়, তবে আমি একা থাকাই ভালোবাসি।”

আশফি পিছনের সারিতে বসে বলেছিল, “তুমি এই গল্পটা লিখেছ?”
আরিবা উত্তর দেয়, “হ্যাঁ, কিন্তু এটা কল্পনা মাত্র।”
“তবু যেন খুব বাস্তব,” আশফির কণ্ঠে কিছু একটার স্পর্শ ছিল।

সেইদিন থেকেই শুরু।

আশফি আরিবার ছবিওলে পড়ে, আর আরিবা আশফির তোলা ছবিতে গল্প খোঁজে। ওরা কখনো একসাথে পাহাড় দেখে না, তবু পাহাড় নিয়ে গল্প করে। কখনো একসাথে সমুদ্র ছোঁয় না, তবু সমুদ্র নিয়ে চুপ করে থাকে।

একদিন আশফি বলে, “তোমার গল্পগুলোতে বারবার মেয়েটা নিজেকে হারায় কেন?”
আরিবা মৃদু হেসে বলেছিল, “কারণ পুরুষরা কখনো নিজেরা হারায় না, তারা হারিয়ে দেয়।”

সেই রাতে আশফি একটা চিঠি লেখে—

"তোমাকে পড়তে পড়তে আমি নিজেই হারিয়ে ফেলেছি নিজেকে। যদি তোমার গল্পে আমাকেও একটা চরিত্র হতে দাও, আমি প্রমাণ করব—ভালোবাসা মানে আত্মবিসর্জন নয়, বরং পাশে দাঁড়িয়ে থাকা।"

আরিবার চোখে পানি চলে এসেছিল, তবু সে চিঠির জবাব দেয়নি। সে জানত, ভালোবাসা মানেই সবসময় উত্তর দেওয়া নয়।

তাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়—নির্বাক, প্রশ্নহীন, কিন্তু অনুভবে অগাধ।

আর ঠিক তখনই আশফির পরিবারের পক্ষ থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসে, আরিবার নামে নয়, অন্য একটি মেয়ের নামে।

আশফি জানিয়ে দেয়, সে বিয়ে করবে না কাউকে।
মা বলে, “ছেলেরা এমন একগুঁয়ে হয় না।”
আশফি উত্তর দেয়, “ভালোবাসার প্রশ্নে ছেলেমেয়ের পার্থক্য থাকা উচিত না।”

কিন্তু চাপ আসে—পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক।
আর আশফি বুঝে যায়, জীবনের আসল সিনেমাটা রোমান্স নয়, রেস্পন্সিবিলিটি।

সে আরিবার সঙ্গে দেখা করে পদুয়ার বাজারের চা-স্টলে।
বলে, “আমি চাই তোমার হাতটা ধরি, কিন্তু আমি জানি না, কবে আমার জীবন সেই সাহস দেবে।”
আরিবা হেসে বলে, “তুমি যদি চাও, তাহলে হাত না ধরেও পাশে থাকা যায়।”

এরপর কয়েকমাস যোগাযোগ বন্ধ। শহরটা এক হয়ে যায়, ওরা দুজন আলাদা হয়ে যায়।
আরিবা এখনো ক্লাস নেয়, গল্প লেখে। আশফি বাইরে গিয়ে ডকুমেন্টারি বানাতে থাকে চট্টগ্রামের পাহাড়ি স্কুল নিয়ে।

তিন বছর পর, শহরে ফিরে আসে আশফি। চুল একটু পেকে গেছে, চোখে কালি। তবে হাতে একটা বই—“অগ্নি-পরীক্ষা: একটি সত্য গল্প”।

বইটির উৎসর্গপত্রে লেখা—
“তোমার জন্য, যে আমাকে না বলে অপেক্ষা করতে শিখিয়েছিল। যে আমার ভালোবাসার অগ্নি-পরীক্ষায় নিজেকে পুড়িয়ে দিয়ে আমার সাহস ফিরিয়ে এনেছিল।”

বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের দিন আরিবা সবার পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল, আর আশফি মঞ্চ থেকে তাকিয়ে বলে,
“যদি তুমি আজও বিশ্বাস করো যে ভালোবাসা মানে আত্মত্যাগ নয়, তবে আমি পাশে দাঁড়াতে এসেছি—না হাত ধরে, না চিঠি লিখে—শুধু চোখে চোখ রেখে।”

আরিবা উঠে আসে সামনে। কিছু বলে না। শুধু চোখে জলে বলে দেয়,
“এটাই ছিল আমার অগ্নি-পরীক্ষা। আজ তুমি পাশ করলে।”

সেদিন পাহাড়তলী স্কুলের বারান্দায় বসে দুজন মানুষ শুধু তাকিয়েছিল একে অপরের চোখে।
ভালোবাসা কখনো চিৎকার করে না, সে চুপচাপ নিজের পরীক্ষাটা দেয়।
25 Views
3 Likes
0 Comments
0.0 Rating
Rate this: