শীতের শেষ সন্ধ্যা নামে মেঘে ঘেরা বান্দরবানের পাহাড়ে। সূর্যটা লুকিয়ে পড়েছে দূরের ধোঁয়াটে গিরিখাদে, আর নরম ঠান্ডা হাওয়া কানের কাছে এসে নিঃশব্দে কিছু বলে চলে যায়—যেন সেই কথাগুলো পাহাড় ছাড়া আর কেউ বোঝে না।
পাহাড়ি গ্রামের এক কোণায়, মাটির ঘরে থাকে এক মেয়ে—মৌ। বয়স হয়তো একুশ- বাইশ। লম্বা কালো চুল, চোখে পাহাড়ের ঘন সবুজ ছায়া। কারও সঙ্গ সে চায় না, আবার কাউকে সরিয়ে দিতেও চায় না। সে শুধু থাকে—নীরবভাবে, নিজের মতো।
কেউ জানে না, মৌ পাহাড়ে এসেছে কেন। চার বছর আগে হঠাৎ একদিন শহর থেকে এসে উঠেছিল এই ছোট্ট গ্রামে। কারও সঙ্গে তেমন কথা বলে না। সকালের আলোয় ওঠে, ঝর্ণার ধারে বসে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, মাঝে মাঝে পাহাড়ি শিশুদের মৃদু হাসি দিয়ে ডাকে, আবার হারিয়ে যায় নিজের ভিতর।
শোনা যায়, শহরে তার একটা বড় জীবন ছিল—গান গাইত, বড় মঞ্চে উঠত, নামডাক ছিল। কিন্তু একটা রাত বদলে দেয় সব। নিজের বোনের আত্মহত্যা, আর তার জন্য মৌকেই দোষারোপ করা হয়। গুজব ছড়ায়, প্রেমিককে বোনের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিল সে। গলা থেকে যেন সুর হারিয়ে যায় মৌয়ের, শহরের বাতাস বিষ হয়ে ওঠে তার জন্য। আর তাই একদিন হঠাৎ পাহাড়ে চলে আসে সে—চিরতরে।
গ্রামের বয়স্করা বলে, "ও মেয়েটার চোখে কষ্ট জমে আছে, কিন্তু মুখে কোনো অভিযোগ নেই।"
তবে এই নিঃশব্দ জীবনে হঠাৎ আলো আসে একদিন।
নিলয় নামের এক তরুণ গবেষক আসে পাহাড়ে, গাছপালার উপর থিসিস করতে। শহুরে হলেও তার চোখে ছিল এক অদ্ভুত ধৈর্য। প্রথম কয়েকদিন মৌ তাকে এড়িয়ে চলে। কিন্তু এক ঝড়জলে সন্ধ্যায়, পাহাড়ি পথে পড়ে গেলে মৌ তাকে উদ্ধার করে নিজের ঘরে এনে রাখে। নিলয় বিস্ময়ে দেখে, এত নির্জনে একা থাকা একটা মেয়ে কতটা আত্মনির্ভর, আর ভেতরে কতটা নরম।
তারপর শুরু হয় দূরত্বে তৈরি বন্ধুত্ব। নিলয় প্রতিদিন একবার করে মৌয়ের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে গান গায়। পুরনো রবীন্দ্রসংগীত, লতা মঙ্গেশকরের ধ্রুপদি সুর, অথবা তার নিজের লেখা কিছু সাদা পৃষ্ঠার গান। মৌ কিছু বলে না, তবে জানালার ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে দেখা যায় তার মুখে একটুকরো হাসি।
এক সন্ধ্যায়, যখন ঝর্ণার নিচে বসে দুইজনে পাহাড়ে সূর্য ডোবা দেখছে, নিলয় বলে,
"তুমি জানো? তোমার নীরবতা গান গাওয়া শিখিয়েছে আমায়। আগে শুধু গাইতাম, এখন বুঝি—কোনো শব্দ ছাড়াও কত কিছু বলা যায়।"
মৌ চমকে তাকায় তার দিকে। বহুদিন পর প্রথমবার বলে ওঠে,
"তুমি কী চাও, নিলয়?"
"তোমাকে—not as a lover, not as a muse. Just as you are—মৌ, পাহাড়ের মেয়ে, যাকে কেউ ভাঙতে পারেনি।"
মৌ কিছু বলে না। কিন্তু সেই সন্ধ্যায়, চার বছর পর প্রথম সে গান গায়। মৃদু স্বরে, পাহাড়ের বাতাসে মিশে যায় সেই সুর—
"একলা চলো রে…"
পাহাড় শুনে ফেলে সেই গান। ঝর্ণা যেন থেমে যায় শুনতে। আর দূরের মেঘেরা ছুঁয়ে আসে মৌয়ের চোখ।
**
তারপর কেটে যায় বছরখানেক। মৌ আর নিলয় একসাথে বানিয়ে ফেলে এক পাহাড়ি স্কুল—শুধু গান আর গল্প শেখানোর জন্য। শহরের ব্যস্ততা ছাড়িয়ে সেখানে এসে শিশুরা শেখে সুর, আর শেখে মৌয়ের মতো নিরবে বাঁচার সাহস।
মৌ আর ফিরে যায় না শহরে। তার কণ্ঠে আজও সুর ফিরে এসেছে, তবে সেই পুরনো চমক নেই। এখন তার গানে শুধুই সত্যি। পাহাড়ের মতো নীরব, ঝর্ণার মতো টলমলে। নিলয় আজও প্রতিদিন একটা গান মৌয়ের জন্য গায়—যেটা সে শুধু পাহাড় শুনতে পায়।
এবং গল্পের শেষে লেখা থাকে এক লাইনে—
"মৌ আজো পাহাড়েই আছে—নিজের রাজ্যে, নিজের মতো।"
পাহাড়ি মৌ
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
70
Views
6
Likes
0
Comments
0.0
Rating