তোমার আমার প্রেম কাহিনী

অডিও মোড

00:00 00:00
গতি:
ভলিউম:
ঢাকার এক ব্যস্ত বিকেল। ধানমণ্ডি ২৭ নম্বরের মোড়ে জ্যাম দাঁড়িয়ে আছে গাড়ির দীর্ঘ লাইন হয়ে। কাঁচের ভেতর বসে এক ভদ্রলোক মোবাইলে টাইপ করছেন দ্রুত, কপালে চিন্তার ভাঁজ। হালকা পাকা চুল, মুখে তীক্ষ্ণতা, চোখে ক্লান্তি।

তার নাম—ফারহান তাহের। বয়স ৪২।

কর্পোরেট দুনিয়ার পরিচিত মুখ, ঢাকায় তিনটি বড় বিজনেস চালান। একজন স্বীকৃত উদ্যোক্তা, স্ত্রী নেই, দশ বছর আগে ডিভোর্স হয়ে গেছে। সন্তান নেই, পরিবার বলতে এক ছোট ভাই কানাডায় থাকে, আর তিনি নিজে একা থাকেন বনানীর একটি পেন্টহাউজে।

একে সবাই চেনে "সংযত মানুষ" নামে।

আজ তাঁর খুব একটা ইচ্ছে ছিল না বেরোনোর, কিন্তু যেতে হচ্ছে—একটা ওয়ার্কশপে, যেখানে অতিথি বক্তা তিনি, আর আয়োজক যে মেয়েটি, তাকে না করা সম্ভব হয়নি।

মেয়েটির নাম—মুহাইমিনা রেহনুমা। বয়স ২৭।

তরুণ উদ্যোক্তা, সামাজিক প্রকল্প চালায় শহরের নিম্ন আয়ের নারীদের জন্য। সাবলীল বক্তা, কনফিডেন্ট, চোখে সব সময় আগুনের মতো স্বপ্ন। তার মধ্যে ফারহান নিজের পুরনো দিনগুলোর ছায়া খুঁজে পেয়েছিলেন।

তারা পরিচিত হয়েছিল ছয় মাস আগে, এক কনফারেন্সে। মেয়েটির গলার স্বর ছিল মৃদু কিন্তু দৃঢ়, চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতো। তখনই ফারহান বুঝেছিল, সে আলাদা।

সেই “আলাদা” অনুভবটা, ধীরে ধীরে ছড়াতে শুরু করেছিল অজান্তে।
ওয়ার্ক মিটিংয়ের বাইরে একটা কফিশপ, বইয়ের আলোচনা, রাতের মেসেজে "আজ কী পড়লেন", "খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল আপনাকে"—এভাবে গড়ে উঠেছিল এক নীরব সখ্যতা।

কিন্তু কেউ কিছু বলেনি। বলা হয়নি কারণ সেই বয়স, সেই দূরত্ব, সেই সমাজ—সব কিছুই যেন দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

ওয়ার্কশপ শেষ হওয়ার পর মঞ্চের পেছনে মুহাইমিনা বললো,
“আপনি কী এতটাই ব্যস্ত, যে নিজের জন্য কিছু রেখে যান না?”
ফারহান চমকে তাকালো।
“তুমি এটা বললে কেন?”
“কারণ আপনার চোখে আমি সব সময় শূন্যতা দেখি। খুব যত্ন করে লুকানো শূন্যতা।”

সেদিন রাতে ফারহান প্রথমবার তাকে মেসেজ করলো—
“তোমার চোখ অনেক কিছু বোঝে। আমি অবাক হই।”
মুহাইমিনা রিপ্লাই দিল—
“সবচেয়ে বেশি বোঝে আমার নীরবতা।”

এরপর তাদের দেখা হতে লাগলো আরও ঘন ঘন। বইয়ের দোকানে, লেকের পাশে হাঁটতে হাঁটতে, পুরান ঢাকার এক ছাদে বসে চা খেতে খেতে।

একদিন হঠাৎ ফারহান বললো—
“তুমি জানো না, আমি কতটা ভয় পাই।”
মুহাইমিনা শান্তভাবে বললো,
“ভয় পাও বলেই তো ভালোবাসা আসল। নির্ভীকদের প্রেম টেকে না।”

ফারহানের চোখে জল চলে এলো সেদিন। নিজের অজান্তেই।

এভাবেই, তাদের "তোমার আমার প্রেম কাহিনী" গড়ে উঠতে লাগলো সমাজের চোরাস্রোতের বাইরে—যেখানে কোনো নাম নেই, তকমা নেই, কিন্তু গভীরতা আছে। ভালোবাসা আছে, কিন্তু দাবি নেই।

তবু সময় একদিন প্রশ্ন তো তোলে—এ সম্পর্কের পরিণতি কী?

মুহাইমিনা একদিন বললো—
“আপনি তো আমাকে নিয়ে ভাবতে পারবেন না, তাই না? এই শহরের কেউ যদি জেনে ফেলে, একজন তরুণী আর তার থেকে পঁচিশ বছরের বড় একজন পুরুষ একে অপরের ভেতর খুঁজে পায় প্রেমের ছবি, তখন?”

ফারহান চুপ। শুধু একটুখানি বললো—
“আমি চাই না তুমি সমাজের সামনে হারো।”

মুহাইমিনা হেসে বললো,
“কিন্তু আপনি তো আমায় আগেই জিতিয়ে দিয়েছেন, জানেন?”

এরপর কিছু দিন যোগাযোগ কমে গেল। মুহাইমিনা ব্যস্ত হয়ে পড়লো এক আন্তর্জাতিক প্রকল্প নিয়ে। ফারহান নিজেকে গুটিয়ে ফেললো। কিন্তু ভালোবাসা কি থেমে থাকে?

এক রাতে ফারহানের দরজায় কল বেল বাজলো। দরজা খুলে দেখে—মুহাইমিনা।

ভেজা চুল, কাঁপা চোখ, কণ্ঠে অস্থিরতা।

“আমি তোমাকে ভুলে থাকতে পারি না।”
ফারহান কাঁপা গলায় বললো,
“তুমি এখানে এসেছো কেন?”
“কারণ আমি বুঝেছি, ভালোবাসা কাউকে না বললে নয়। ভালোবাসা যদি গোপন থাকে চিরকাল, তবে সেটা তো গল্পই রয়ে যায়। আমি চাই, এই কাহিনীটা বাস্তব হোক।”

সেই রাতে তারা বসেছিল ছাদে। আকাশ ভরা তারা। মুহাইমিনা বলেছিল—
“তোমার আমার প্রেম কাহিনী একদিন সবাই জানবে। হয়তো মেনে নেবে না, কিন্তু অনুভব করবে।”
ফারহান বলেছিল—
“তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে সাহসী অধ্যায়।”


---

দু’বছর পর।

একটি ছোট্ট কফিশপ, শান্তিনগরে।

সাদা কুর্তি পরে মুহাইমিনা বসে আছে। সামনে ফারহান। মাঝবয়সী মানুষটির মুখে এখনো সেই অভিজাত গাম্ভীর্য, কিন্তু চোখে স্থির প্রশান্তি।

তারা আজ একসাথে একটি এনজিও চালায়—"প্রেম কাহিনী ফাউন্ডেশন"—যারা সমাজে বৈষম্য, বয়স, ধর্ম, পেশা ইত্যাদি নিয়ে প্রেমকে যারা অসম্ভব ভাবে, তাদের পাশে দাঁড়ায়।

কে কী বলেছিল, কে হাসে, কে মানে না—তাতে কিছু যায় আসে না এখন।

কারণ তাদের গল্প, “তোমার আমার প্রেম কাহিনী…”—এটা এখন শুধুই তাদের নয়, একটা সাহসের প্রতীক।
34 Views
4 Likes
0 Comments
0.0 Rating
Rate this: