মনের মণিকোঠায়

অডিও মোড

00:00 00:00
গতি:
ভলিউম:
রৌদ্রছায়া মেশানো এক দুপুর। কাচের জানালায় ঠেকিয়ে রাখা এক কাপ ধোঁয়া ওঠা কফি ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়ে আসছিল। বসার ঘরের দেয়ালে ঝুলে থাকা পুরনো একটা ঘড়ির কাঁটা যেন সময়কে আর এগিয়ে নিতে চায় না, বা হয়তো কারো অপেক্ষায় তা স্তব্ধ হয়ে আছে।

নীলার চোখদুটো জানালার বাইরে স্থির। সে হাঁ করে তাকিয়ে আছে না-দেখা কোনো অতীতের দিকে। চোখে পরেছিল এক জোড়া পুরনো সোনালি পায়রার নকশা, যা একটা পুরনো চিঠির খামের ওপর আঁকা ছিল—সেই চিঠি, যা সে আজো খোলে না।

নীলা একজন রেস্টোরেটর—পুরনো ভগ্নপ্রায় শিল্পকর্ম আর দালানকোঠা মেরামত করে নতুন প্রাণ দেয়। সে এমন এক শিল্পী, যার তুলির কাজ ক্যানভাসে নয়, বরং ফাটলে-ধরা দেয়ালে, ইতিহাসের রঙ মিশিয়ে।

চার বছর আগে একবার সে এসেছিল পুরান ঢাকার এক ধ্বংসপ্রায় জমিদার বাড়িতে। সরকারি অনুমতি অনুযায়ী কাজ করার কথা ছিলো পুরনো স্থাপত্য রক্ষা করার জন্য। সেই বাড়ির নাম ছিল—আলীম মঞ্জিল। পলেস্তারা ঝরতে থাকা দেয়ালে আঁকা ছিল সূক্ষ্ম ফ্রেস্কো আর ফার্সি কবিতার পংক্তি, আর ধুলো ঢাকা আয়নার নিচে একটা নাম খোদাই করা—"ইলতেমাস"।

এই ইলতেমাস নামটা যেন কোনো রহস্যময় ছায়ার মতো প্রথম দিনের সেই সকালেই ঘিরে ধরেছিল নীলাকে। বাড়ির ভেতরে ঢোকার সময় এক বৃদ্ধ কেয়ারটেকার বলেছিলেন, “মেমসাহেব, এই বাড়িতে কাজ করতে গেলে অতীতের সঙ্গে বোঝাপড়া রাখতে হয়।”

নীলা তখন হেসেছিল। অতীতের সঙ্গে তার পরিচয় কম কই? পঞ্চাশ বছরের পুরনো প্রাচীর রং করার সময় তার মনে হয়, যেন সেই দেয়াল তাকে গল্প শোনায়। তবে ইলতেমাস ছিল অন্যরকম। অদ্ভুতভাবে অচেনা, অথচ আপন।

প্রথম দিনেই সিঁড়ির কোণে একটা মিনি লাইব্রেরি পেয়েছিল সে—পোকায় কাটা বই আর ধুলোয় ঢেকে থাকা এক টেবিল। আর সেখানেই, এক পুরনো ফ্রেমের ভিতর এক যুবকের ছবি। ধূসর ব্লেজার পরা, কাঁচের ফ্রেমে চশমা, আর কপালের মাঝখানে একটুখানি চিন্তার ভাঁজ।

ছবিটার নিচে লেখা ছিল: "ইলতেমাস রহমান, ১৯৬৮"

নীলার বুকের ভেতর কেমন একটা দোলা লেগেছিল। সে জানতো না কেন, কিন্তু মনে হচ্ছিল এই মুখ সে কোথাও দেখেছে, হয়তো স্বপ্নে, হয়তো কোনো হারানো জন্মে।

পরের কয়েক সপ্তাহ ধরে সে ঘরঘর করে আলীম মঞ্জিলের দেয়াল রং করতে থাকলো। একদিন ভাঙা আলমারির পেছনে একটা কাঠের বাক্স পেয়ে গেল—ভেতরে অনেকগুলো চিঠি, পুরনো সিল করা খামে। প্রত্যেকটার ওপরে লেখা ছিল এক নাম—“নুরিয়া”।

নুরিয়া? কে এই নারী?

চিঠিগুলোর তারিখ ছিল ১৯৬৫ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত। যুদ্ধের আগের বছরগুলো। কৌতূহল সামলাতে না পেরে নীলা একদিন একটা চিঠি খুলেই ফেললো।

"প্রিয় নুরিয়া,
আজ যখন তোমার গলা শুনলাম, মনে হলো আকাশ থেকে বাদল নেমে এলো। তুমি আমাকে বলেছিলে, আমি যেন কেবল ইট কাঠ পাথরের ভিতর বাঁচতে শিখি না—তোমার চোখে যেন জলের মতো স্বচ্ছ একটা জানালাও খুলে রাখি।..."

নীলার গলা শুকিয়ে এলো। এই তো সেই ভাষা, যে ভাষা সে তার নিজের মনের মণিকোঠায় লুকিয়ে রেখেছে বছরের পর বছর। কেউ যেন ঠিক তার ভাবনার কথাগুলো আগেই জেনে লিখে গেছে।

দিনের পর দিন সে চিঠিগুলো পড়ে যায়। জানতে পারে, ইলতেমাস ছিল একজন স্থপতি—ঢাকার ব্রিটিশ আমলের অনেক বিল্ডিংয়ের ডিজাইনার। আর নুরিয়া ছিল একজন সমাজকর্মী, মুক্তবুদ্ধির এক নারী, যে পাকিস্তান আমলে নারী শিক্ষার জন্য কাজ করতেন। তাদের প্রেম জমেছিল ধীরে ধীরে—শুধু চিঠির মাধ্যমে, দেখা সেভাবে কখনোই হয়নি। কারণ সমাজ, ধর্ম, সময়—সব ছিল তাদের বিরুদ্ধ।

শেষ চিঠিটা লেখা ১৯৭১ সালের ২২ মার্চ—

"নুরিয়া,
আমার শহর এখন বুনো আগুনে জ্বলছে। কাল রাতেও ট্যাঙ্ক চলে গেছে আমাদের মোড় দিয়ে। আমি জানি না তুমি কোথায়, কিন্তু বিশ্বাস করো, যদি বেঁচে ফিরি, তোমার জন্যই ফিরবো। যদি না পারি, আমার স্মৃতিগুলো এই দেয়ালের খাঁজে খাঁজে রেখে যাচ্ছি। তুমি একদিন যদি এসো, আমাকে খুঁজে পাবে।..."

নীলার চোখ ঝাপসা হয়ে যায়। এরপর আর কোনো চিঠি নেই। একটা নিঃশব্দ শূন্যতা যেন তাকে জড়িয়ে ধরে।

সে বুঝে যায়, ইলতেমাস ফিরে আসেনি। হয়তো শহীদ হয়েছে, হয়তো হারিয়ে গেছে সেই অস্থির সময়ের গহ্বরে। আর নুরিয়া? কে জানে, সে হয়তো আজও বেঁচে আছে কোনো বৃদ্ধাশ্রমে, কিংবা চলে গেছে একদিন চুপিচুপি।

তবু এই প্রেম, এই অপেক্ষা, এই সময়কে ছুঁয়ে যাওয়া শব্দ—সব কিছুই যেন আটকে আছে আলীম মঞ্জিলের দেয়ালে, চিঠির খামে, আর নীলার হৃদয়ের এক কোনায়।

পরের বছর, কাজ শেষ করে যাওয়ার সময়, নীলা সেই সব চিঠি সযত্নে রেখে যায় পুরনো বইয়ের তাকেই। শুধু শেষ চিঠিটা নিজের কাছে রেখে দেয়—স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে নয়, এক ধরণের উত্তরহীন প্রেমের সাক্ষী হিসেবে।

চার বছর পর, এই আজকের দুপুরে, সে জানালার পাশে বসে সেই চিঠিটাই পড়ছে আবার। বাইরে পাখির ডাক। হাওয়া বইছে ধীরে ধীরে। মনে হচ্ছে দূর থেকে কেউ ডেকেছে—ইলতেমাস?

সে হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়। ড্রয়ার থেকে খামে ভরা চিঠিটা বের করে জানালার বাইরের বাতাসে মেলে ধরে। যেন চায়, চিঠির শব্দগুলো বাতাসে মিলিয়ে যাক, ছুঁয়ে যাক সেই নারীর হৃদয়কে, যে একদিন হয়তো এসেছিল আলীম মঞ্জিলের সেই সিঁড়ি ধরে।

আর নীলা? সে হয়তো কারো ইলতেমাস নয়, কারো নুরিয়া-ও নয়। কিন্তু সে একজন পথিক, যার চোখে এখনো কুয়াশা ঢাকা অতীত জেগে ওঠে। এবং যার মনের মণিকোঠায় রয়ে গেছে কিছু অজানা নাম, কিছু অপ্রকাশ চিঠি, কিছু অপূর্ণ প্রেম।
29 Views
5 Likes
0 Comments
0.0 Rating
Rate this: