বেস্ট ফ্রেন্ড বউ

অডিও মোড

00:00 00:00
গতি:
ভলিউম:
ঢাকার ভিড়জঞ্জালের ভেতর থেকেও কিছু সম্পর্ক কখনো কখনো এত নিখুঁতভাবে গড়ে ওঠে, যেগুলো সময়ের স্রোতেও ভাঙে না—আর কিছু সম্পর্ক খুব গভীর হয়ে ওঠে, তবুও নিজের স্থান খুঁজে পায় না।

রুদ্র আর অয়ন—দুই পাগলাটে বন্ধু। স্কুলের বেঞ্চে একসঙ্গে বসে শুরু হওয়া বন্ধুত্বটা একদিন এতটাই গভীর হয়েছিল যে তারা একে অপরের ভাই বলেই মনে করত। দু'জনেই পড়াশোনায় ভালো, দু'জনেই স্বপ্নবাজ। তবে একটা জিনিসে দু'জনের দারুণ পার্থক্য—রুদ্র মনের কথা মুখে বলতে পারে না, কিন্তু অয়ন পারতো।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় রুদ্রের জীবনে আসে মেয়ে—তানহা।

তানহা ছিল তাদের বিভাগের সবচেয়ে স্মার্ট, সবচেয়ে প্রাণবন্ত মেয়ে। ওর হাসি, চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যেত, এই মেয়েটা পৃথিবীটাকে নিজের মত করে ভালোবাসে। রুদ্র চুপিচুপি ভালোবেসে ফেলেছিল ওকে। কিন্তু কখনো বলার সাহস হয়নি। সেমিস্টার কাটতে থাকে, ক্লাস শেষ হয়, হোস্টেলের আড্ডা, গ্রুপ স্টাডি—সবই চলে আগের মতো।

একদিন, অয়ন রুদ্রকে বলল,
—"তুই জানিস, আমি একটা ব্যাপারে খুব কনফিউসড।"
—"কি ব্যাপার রে?"
—"তানহাকে ভালো লেগে গেছে। আমি সিরিয়াস। বলতে চাচ্ছি ওকে।"

রুদ্রের মুখের চেহারা মুহূর্তে বিবর্ণ হয়ে গেলেও, সে নিজেকে সামলে নিল। ধরা দিল না।
—"ওহ! দারুণ তো। ওরকম একটা মেয়ের সাথে তুই জাস্ট পারফেক্ট ম্যাচ। বল গিয়ে।"

অয়ন বুঝতেই পারল না রুদ্রের ভিতরে ঠিক কী ভেঙে পড়লো। সেদিন রাতে রুদ্র নিঃশব্দে কাঁদল। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু তবুও বন্ধুর ভালোবাসায় সে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে চায়নি।

অয়ন প্রপোজ করল তানহাকে। তানহা রাজি হলো।
রুদ্র সব আড়াল থেকে দেখল—হাসিমুখে অভিনন্দন জানাল, পাশে থাকল, ছবি তুলল, নেটওয়ার্ক খারাপ হলে রিচার্জ দিল, প্রেমে ঝামেলা হলে রফাদফা করল। কিন্তু নিজের অনুভূতির কথা মুখ ফুটে বলেনি। তানহা জানত না, অয়নের পাশে ছায়ার মতো যে ছেলেটা দাঁড়িয়ে থাকে, সে-ই চুপিচুপি ভালোবেসে গেছে তাকে।

পাঁচ বছর পর—রুদ্র ব্যস্ত চাকরিজীবী। ঢাকার একটা বড় এজেন্সিতে কাজ করে। অনেকদিন আর অয়নের সাথে তেমন যোগাযোগ থাকে না। হঠাৎ একদিন ফোন আসে।
—"রুদ্র... আমি অয়ন, কেমন আছিস রে?"
—"ভাইরে! তুই তো হারিয়েই গেলি!"
—"দোস্ত, বিয়েটা হচ্ছে আমার। তানহার সঙ্গে। তোর আসা চাই-ই চাই। তুই আমার বেস্টম্যান হবি, প্লিজ না করিস না।"

রুদ্র ফোনের অপর প্রান্তে নির্বাক। বুকের ভেতরে জমে থাকা দীর্ঘশ্বাসটা ঠেলেই সে বলল,
—"দোস্ত, তোদের বিয়েতে আমি না থাকলে কে থাকবে বল!"

রুদ্র এল বিয়েতে। তানহার চোখে পুরনো সেই চেনা উজ্জ্বলতা, সেই হাসি। কিন্তু এবার ওর চোখে ছিল একধরনের ‘ঘরবাঁধা’ শান্তি। রুদ্র জানে, আজ থেকে তানহা তার আর কিছুই না—শুধু বন্ধুর স্ত্রী।
বেস্ট ফ্রেন্ডের বউ।

সময় চলে যায়।

তানহা আর অয়নের সংসার জীবনে তিন বছর কেটে যায়। কিন্তু জীবনে সব সময় যেমনটা ভাবা হয়, তা ঘটে না। অয়নের কাজ চলে যায় এক দুর্ঘটনার কারণে—ছেলেটা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। নেশা, অবসাদ, নির্লিপ্ততা—সব মিলিয়ে একটা বিষণ্ন পরিবেশ তৈরি হয়। তানহা বহু চেষ্টা করেও ওকে আগের মতো ফিরিয়ে আনতে পারে না। একদিন রুদ্রকে ফোন করে তানহা—

—"তুমি কি আসতে পারো আমাদের বাসায়? ওর সাথে একটু কথা বলো। তোমার কথা শুনলে তোদের পুরনো দিনগুলো হয়তো মনে পড়ে যাবে ওর।"

রুদ্র যায়। বহুদিন পর বন্ধুর সাথে দেখা হয়।
অয়ন একেবারে বিধ্বস্ত। চোখে-মুখে হতাশার ছাপ।
রুদ্র বসে, ধীরে ধীরে কথা বলে, বোঝানোর চেষ্টা করে—
—"দোস্ত, তুই এমনটা করতে পারিস না। তুই হারিয়ে গেলে তানহার কী হবে? আমাদের স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ—সব তুই ছেড়ে দিতে চাস?"

অয়ন কাঁদতে থাকে। তারপর একটা অদ্ভুত কথা বলে—
—"দোস্ত, তুই জানিস? আমি অনেক আগেই বুঝেছি তুই তানহাকে ভালোবাসিস।"
রুদ্র থমকে যায়।
—"কী বলছিস এসব!"
—"হ্যাঁ। তুই কখনো বলিসনি, কিন্তু আমি দেখেছি। তোদের চোখে দেখেছি, তোদের ব্যবহারে বুঝেছি। আমি তোর মতো বন্ধুকে ঠকিয়ে কখনো সুখী হতে পারিনি রে। তাই নিজেকেও শেষ করে ফেলতে চাচ্ছি।"

রুদ্র কিছুক্ষণ স্তব্ধ। তারপর ধীরে বলল,
—"তুই ভুল ভাবছিস দোস্ত। হ্যাঁ, আমি তানহাকে ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু তুই ওকে ভালোবাসিস, ও তোকে ভালোবাসে। আমার ভালোবাসা থাকলেও, আমি তোদের ভালোর বাইরে কিছু চাইনি কখনো। দয়া করে নিজেকে শেষ করে দিস না। আমি থাকি তোদের পাশে। আমরা একসাথে সব কাটিয়ে উঠবো।"

রুদ্রের কথাগুলো যেন অয়নের মধ্যে একটা আলো ছড়িয়ে দেয়। সে ধীরে ধীরে আবার স্বাভাবিক হতে শুরু করে। তানহারও হাসি ফিরে আসে। কিন্তু সেই সন্ধ্যায়, তানহা একা রুদ্রকে বলল—
—"তুমি কি সত্যিই আমাকে ভালোবেসেছিলে?"
রুদ্র চুপ থাকে। তারপর একটু হাসে—
—"হ্যাঁ। এখনো বাসি। কিন্তু ভালোবাসা মানেই তো পাওয়া না, তানহা। অনেক সময় ভালোবাসা মানেই ছেড়ে দেওয়া, পাশে থাকা, প্রিয় মানুষের সুখে খুশি থাকা।"

তানহার চোখে জল আসে। সে মাথা নিচু করে বলে—
—"তুমি খুব ভালো একজন মানুষ, রুদ্র। আমি ভাগ্যবান, তোমার মতো একজন আমাকে ভালোবেসেছিল।"

তারপর, কিছু কথা আর বলা হয় না।

বছর কয়েক পরে, অয়ন ও তানহা বিদেশে সেটেল করে। রুদ্র আজও ঢাকায় একা থাকে। নতুন অফিস, নতুন কাজ, নতুন সহকর্মী... কিন্তু একা থাকাটা আজকাল আর কষ্ট দেয় না। কারণ, সে জানে, তার ভালোবাসা আজও কোথাও একটা বেঁচে আছে—সেই হাসিতে, সেই সংসারে।

আর রুদ্র? সে আজও একটা ছোট্ট ছবির ফ্রেম রেখে দিয়েছে নিজের ডেস্কে—
ছবিতে তিনজন মানুষ—রুদ্র, অয়ন, আর তানহা।
ছবির নিচে লেখা,
“বেস্ট ফ্রেন্ড, বেস্ট মেমোরি।”
27 Views
3 Likes
0 Comments
0.0 Rating
Rate this: