জয় মা মনসা

অডিও মোড

00:00 00:00
গতি:
ভলিউম:
সন্ধ্যার আলো নেমেছে গাঁয়ের বুক জুড়ে। সোঁ সোঁ বাতাসে ঝোপঝাড় নড়ে ওঠে, আর দূরের বাঁশঝাড়ে শালিক ডাক দেয় ক্লান্ত কণ্ঠে। মেঘলা আকাশে সূর্যটা আগুন রঙের গোলা হয়ে ডুবে যাচ্ছে পদ্মার পাড়ে।

গ্রামের নাম শ্যামপুর। ছোট্ট নদী ভাঙা গ্রাম, কিন্তু গ্রামটা বিখ্যাত তার এক প্রাচীন বিশ্বাসের জন্য—মা মনসার পুজো।

প্রতি বছর আষাঢ়-শ্রাবণের সন্ধিক্ষণে গ্রামের একমাত্র বড় পুকুরপাড়ে বসে মনসা পূজো। শত বছর ধরে চলে আসছে এই প্রথা। বলা হয়, একবার মা মনসার রোষে গোটা গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছিল বিষধর সাপ। তখন এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ, হরিপদ শর্মা, নিজের কুঁড়েঘরে শুরু করেছিলেন মা মনসার পুজো। তাঁর নিষ্ঠা আর মন্ত্রপাঠে একরাতেই সাপগুলো নিখোঁজ হয়েছিল। সেই থেকে আজও শ্যামপুর মা মনসার গ্রাম।

গল্পটা কিন্তু এখনকার।

নীলু, গ্রামের এক চাষার মেয়ে। বয়স আঠারো-উনিশ, কিন্তু চোখে মুখে একরাশ তেজ। বাবার সাথে মাঠে কাজ করে, ধান কাটে, মায়ের সাথে নদীতে কাপড় ধোয়। কিন্তু নীলুর হৃদয়ে যে আগুন, তা শুধু দৈনন্দিন জীবনের সাথে যুদ্ধ করার না—সে বিশ্বাস করে, মা মনসা তাকে কিছু একটা করে দেখানোর জন্য পাঠিয়েছেন।

তার কপালে জন্ম থেকে একটা সাপের মত দাগ। লোকে বলে, “ও মনসার চিহ্নধারী মেয়ে”—কেউ কেউ ভয় পায়, কেউ পুজো দেয়।

একদিন, শ্যামপুরে আসে শহরের এক বায়োলজিস্ট—ড. অরিত্র সেন। তিনি সাপ নিয়ে গবেষণা করেন। গ্রামের আশেপাশে কিছু বিরল প্রজাতির সাপের খোঁজ পেয়ে এসেছেন।
তিনি যখন পুকুরপাড়ে ঘুরছেন, হঠাৎ একটা চন্দ্রবোড়া সাপ তার পায়ের কাছে এসে দাঁড়ায়।

গ্রামের লোক চিৎকার করে।
কেউ বলে,
—"মরল রে! মা মনসা রাগ করেছেন!"
কিন্তু ড. অরিত্র স্থির দাঁড়িয়ে থাকেন।
ঠিক তখনই, নীলু আসে। মাথায় ওড়না বাঁধা, হাতে একগুচ্ছ তুলসীপাতা আর গলায় মা মনসার লকেট।

সে সাপটার দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বলে,
—"ও মনসার বাহন, ওরে চলে যা। এখানে কারো ক্ষতি নয়।"

অদ্ভুতভাবে, সাপটা সরে যায়। অরিত্র হতবাক।

সে বলে,
—"তুমি কীভাবে করলে এটা?"
নীলু হাসে,
—"আমি কিছু করিনি। আমার মা করেছেন। মা মনসা।"

তখন থেকেই ড. অরিত্র লক্ষ্য করেন, নীলুর আশেপাশে কিছু একটা আলাদা অনুভূতি আছে। তিনি বোঝেন, বিজ্ঞান ছাড়াও এমন কিছু জগত আছে যা শুধু অনুভব করা যায়।

তবে ঘটনা মোড় নেয় সেই রাতে।

গ্রামে হঠাৎ খবর আসে, পুকুরপাড়ে আবার এক বালককে সাপে কাটেছে। সবাই ভয়ে পাগল। ওঝা এসে দেখে, ছেলেটার অবস্থা খারাপ।
তখনই নীলু ছুটে আসে। হাতে ধূপকাঠি, কপালে সিঁদুরের টিপ। মা মনসার গান গাইতে গাইতে সে পুকুরপাড়ে বসে পড়ে। মন্ত্র আওড়ায়—

“জয় মা মনসা, নাগেশ্বরী মা, করুণা করো মা।”

সবাই তাকিয়ে থাকে নিঃশব্দে। অরিত্র পর্যন্ত কিছু বলতে পারে না।

মাঝরাতে, বালকটা ধীরে ধীরে চোখ মেলে। সারা গ্রাম যেন নিঃশ্বাস ফেলে। সবাই চিৎকার করে ওঠে—
—"জয় মা মনসা!"

সেই রাতেই, এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে নীলু। এক বিশাল নদী, তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে এক সোনালী সাপ, যার ফণায় বসে আছেন এক দেবী—স্নিগ্ধ, চোখে আলো, হাতে পদ্ম।
—"নীলু," তিনি বলেন,
—"তুই আমার সন্তান। তোকে আমি পছন্দ করেছি, কারণ তুই বিশ্বাস করিস। তোর হাতেই থাকবে আমার শক্তি। কিন্তু মনে রাখিস, এই শক্তি শুধু সেবার জন্য। অহংকারের জন্য নয়।"

ঘুম ভাঙে নীলুর, কিন্তু হৃদয়ে সেই স্বপ্নের আলো।

পরদিন সকালেই গ্রামপ্রধান ঘোষণা করেন—
—"এবার থেকে মা মনসার প্রধান পূজারী হবে নীলু।"

গ্রামের অনেকেই মেনে নিতে পারে না।
—"মেয়ে হয়ে পূজারী? এটা তো ছেলেদের কাজ!"
—"এটা কি বিধানে আছে?"
কিন্তু পুরোহিত নিজে সামনে এসে বলে,
—"যার ভক্তি আছে, তাকেই মা মনসা বেছে নেন। সে ছেলে হোক বা মেয়ে, তাতে কী যায় আসে?"

নীলু ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে গ্রামের এক প্রিয় মুখ—যার কথা শুনলে সাপ ফিরে যায়, whose touch heals, whose prayer protects.

ড. অরিত্র ফিরে যান শহরে, কিন্তু নীলুর কথা লেখেন তার গবেষণাপত্রে—
"There are realms where science ends, and faith begins. And somewhere in the middle, stands a girl with fire in her soul—Nilu, the daughter of Manasa."

আজও, শ্রাবণ মাসের অমাবস্যায়, যখন শ্যামপুরের পুকুরপাড়ে ঢাক বাজে, ধূপ জ্বলে, আর নারকেল ফাটে—নীলু দাঁড়িয়ে থাকে সিংহাসনের সামনে, চোখে দীপ্তি, গলায় সেই মন্ত্র:

—“জয় মা মনসা, নাগেশ্বরী মা, আমার গাঁর মা, আমার প্রাণের মা।”
18 Views
2 Likes
0 Comments
0.0 Rating
Rate this: