রাত্রি তখন গভীর। গ্রামের আকাশে চাঁদের আলো মৃদু ছায়া ফেলছে। নারিকেল গাছের পাতা নড়ছে হাওয়ায়, আর সেই হাওয়ার ধাক্কায় নড়ছে রুকাইয়ার বুকের ভেতরের কষ্টটাও। সে দাঁড়িয়ে আছে জানালার ধারে, চুপচাপ। তার চোখে এখন ঘুম নেই — আছে শুধু প্রশ্ন, ভয় আর কিছুটা গোপন স্বপ্ন।
রুকাইয়া আলিয়া মাদ্রাসা থেকে সদ্য ফাজিল পাশ করেছে। গ্রামের সবাই তাকে ‘হুজুরের মেয়ে’ বলে চেনে, কারণ তার বাবা আব্দুল হাকিম সাহেব স্থানীয় মসজিদের ইমাম। রুকাইয়ার ইচ্ছে ছিল উচ্চশিক্ষা নিয়ে ইসলামি স্কলার হওয়া, কিন্তু মেয়েদের ক্ষেত্রে স্বপ্নগুলো অনেক সময় বাস্তবের দেয়ালে আটকে যায়।
এক মাস হলো তার বিয়ের কথা পাকা হয়েছে। পাত্র শহরের বড় একজন ব্যবসায়ীর ছেলে, আমিনুর। ভালো, শিক্ষিত, নামাজি, কিন্তু রুকাইয়ার মন যে এখনও থেমে আছে আরেক নামের কাছে — মারুফ।
মারুফ ছিল রুকাইয়ার ছোটবেলার বন্ধু। একই সঙ্গে কুরআন শরীফ পড়া, একই মাদ্রাসায় ক্লাস। মারুফ এখন কলকাতায় একটি মাদ্রাসায় দাওরায়ে হাদীস পড়ে। বছরখানেক আগে সে রুকাইয়াকে চিঠি পাঠিয়েছিল —
“তুমি যদি চাও, আমি আমার পড়া শেষ করে ফিরে আসব, হাকিম চাচার কাছে প্রস্তাব পাঠাব।”
রুকাইয়া চিঠির উত্তরে কিছু লেখেনি। কারণ তখন সে জানত না, তার বাবার চোখে ‘মুফতি সাহেব’ হওয়া মানে যতই ভালো হোক, জামাই হিসেবে দেখতে হবে আর্থিক অবস্থাও।
কিন্তু এখন, বিয়ে ঠিক হওয়ার পর হঠাৎ একদিন মসজিদের বাইরে মারুফ এসে দাঁড়াল। রুকাইয়া দূর থেকে দেখেছিল তাকে — চোখে ক্লান্তি, মুখে একরাশ ব্যথা।
সেই রাতে বাবার কাছে রুকাইয়া বলল,
“আব্বা, আপনি যদি একবার মারুফ ভাইয়ের কথা ভাবতেন... তিনি তো দীনদার, শিক্ষিত…”
আব্দুল হাকিম গম্ভীর গলায় বললেন,
“আমার মেয়ে রাজা-বাদশাহদের মতো হোক, হাদীস পড়া ছেলেকে আমি জামাই করব না — এমন কথা কখনও বলিনি। কিন্তু, মা, বিয়ে শুধু মনের নয়, সংসারের বিষয়ও।”
রুকাইয়া চুপ করে গেল। কারণ জানত, সে বাবার অনুগত সন্তান। কিন্তু সে জানত না, কেন তার বুকটা হু হু করে কেঁদে ওঠে আজকাল।
বিয়ের ঠিক আগের রাত। ঘরের কোণে সেজে বসে আছে রুকাইয়া। সবাই বলছে, "মাশাআল্লাহ, কি চমৎকার দেখাচ্ছে!" কিন্তু তার নিজের মনে হচ্ছে, যেন সাজের নীচে চাপা পড়ে যাচ্ছে এক জীবনের স্বপ্ন।
হঠাৎ খবর এলো — মারুফ এক চিঠি রেখে গেছে।
চিঠিটা খুলে রুকাইয়া পড়ল:
> “রুকাইয়া,
তুমি জানো, আমি তোমাকে ভালোবাসি — কিন্তু তার থেকেও বড় যে জিনিস, সেটা হলো তোমার ইজ্জত, তোমার সম্মান, আর তোমার বাবার সম্মান। আমি জানি, আজ তোমার বিয়ে। আমি দোয়া করি, আল্লাহ তোমার ঘরকে জান্নাতের মত করে দিক।
আমি দূরে থেকে সবসময় তোমার দোয়াগো…
— মারুফ”
রুকাইয়ার চোখে তখন জল, আর মনে শান্তি। কারণ সে জানে, সব প্রেমকে বিয়ের ফুল হতে হয় না — কিছু প্রেম দোয়ার মালা হয়েও রয়ে যায় চিরকাল।
ঐ রাতের পরে রুকাইয়া কখনও মারুফকে দেখেনি। কিন্তু প্রতিবার ইফতারে, তারাবির নামাজে, কিংবা কুরআন পড়তে বসলে তার মনে পড়ে সেই এক চিঠি, এক মানুষ, আর এক আত্মত্যাগের কথা।
আর সে জানে, বিয়ের ফুল শুধু সেজে উঠা নয়, কখনও কখনও ত্যাগও ফুল ফোটায়।
হুজুরের মেয়ে
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
58
Views
7
Likes
1
Comments
0.0
Rating