বিকেলটা অদ্ভুত নিস্তব্ধ ছিল। নীলার চোখের সামনে দিয়ে শহরের মানুষগুলো হেঁটে যাচ্ছে—কারো গন্তব্য আছে, কারো নেই। তবে তার ঠিকানাটা যেন এখনো কোথাও স্থির হয়নি।
চারপাশে জীবন থেমে নেই, শুধু তার ভেতরের গল্পগুলো থেমে গেছে।
হঠাৎই পেছন থেকে কাঁধে টোকা।
– "তুমি এখনো এখানেই আসো?"
চেনা কণ্ঠ। চেনা নিঃশ্বাস।
নীলা ধীরে ঘুরে দাঁড়াল।
– "তোমাকে এখানে ভাবিনি রুদ্র।"
– "তুমি জানো, গল্পগুলো কোথাও হারায় না, নীলা। ওরা অপেক্ষা করে... ঠিক এমন একটা বিকেলের জন্য।"
নীলার ঠোঁটে একটা অম্লান হাসি ফুটে উঠল।
– "গল্পগুলো তো হারিয়ে গেছে অনেক আগেই। তুমি পেছনে ফেলে চলে গেলে, আমি পেছনে রয়ে গেলাম।"
– "আমি কোথাও যাইনি, শুধু সময়টা সরে গিয়েছিল আমাদের থেকে।"
দুজনে পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করল শহরের পুরনো পার্কটা ধরে—যেখানে একসময় তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্পে হারিয়ে যেত।
নীলা একটু থেমে বলল,
– "তুমি এখন কেমন আছো?"
– "ভালো থাকার অভিনয়টা শিখে ফেলেছি। আর তুমি?"
– "আমি এখন কফির মধ্যে চিনি দেই না। মিষ্টি ভালো লাগে না আর।"
রুদ্র হেসে ফেলল।
– "তোমার সেই তুমুল হাসিটা কই গেল?"
– "তোমার গল্প না থাকলে হাসিটাও কেমন শুকিয়ে যায় রে।"
স্মৃতির পালা একে একে ভিড় জমাতে লাগল।
ছোট্ট একটা ক্যাফে ছিল ওদের—প্রিয় ঠিকানা। রুদ্র লিখত গল্প, নীলা কফির কাপ হাতে শুনত আর মন্তব্য করত।
একদিন নীলা বলেছিল,
– "তুমি যেদিন আমাকে নিয়ে গল্প লিখবে, জানব আমি সত্যিই তোমার গল্পের নায়িকা হয়ে গেছি।"
রুদ্র বলেছিল,
– "তুমি তো আমার প্রতিটা গল্পের ছায়া, নীলা। শুধু নামটা দিই না কখনো।"
সেই গল্পগুলোই কি আজ তাদের আলাদা করে দিল?
রুদ্র থামল। একটা পুরনো বেঞ্চের দিকে ইশারা করে বলল,
– "চলো, এখানে বসি। যেইখানে আমরা শেষ গল্পটা শুরু করেছিলাম, মনে আছে?"
– "মনে রাখলে কষ্টটা বাড়ে রুদ্র। তবুও মনে পড়ে।"
দুজনে চুপচাপ বসে থাকে কিছুক্ষণ। শব্দহীনতা মাঝে মাঝে অনেক শব্দের চেয়েও জোরালো হয়ে ওঠে।
রুদ্র বলল,
– "তুমি কি জানো, আমি এখনো লিখি?"
– "লিখো? কাকে নিয়ে?"
– "তোমাকেই। প্রতিটা চরিত্রে একটু করে তুমি আছো। কখনো চোখে জল নিয়ে বসে থাকা মেয়েটা, কখনো অভিমানী প্রেমিকা, কখনো বিদ্রোহী একাকী।"
নীলা চোখ নামিয়ে বলে,
– "তুমি তো আমায় ফেলে চলে গিয়েছিলে।"
– "না নীলা, আমি তোমায় হারিয়ে ফেলেছিলাম সময়ের ভিড়ে। চাকরি, দায়িত্ব, আর নিজের না-পারার ভয় আমাকে পিছিয়ে রেখেছিল।"
– "আর তুমি ভাবলে আমি সেই ভয়টাকে বুঝব না?"
– "তুমি তো সব বুঝতে। সেই যে বলতেছিলাম, ‘তোমাকে ছাড়া লিখতে পারি না’, সেটা আজও সত্যি।"
নীলার চোখ ভিজে ওঠে।
– "তুমি যদি জানতে, আমি প্রতিদিন তোমার গল্পগুলো খুঁজি। জানিনা কেন... একটা আশা ছিল, কোনো গল্পের শেষে তুমি লিখবে—‘এই গল্পটা আমাদের’।"
রুদ্র পকেট থেকে একটা পুরনো খাম বের করে দিল।
– "তোমার জন্য রেখে ছিলাম। হয়তো তোমার কাছে ফেরার সাহস ছিল না এতদিন। আজ মনে হলো, সময়টা ফিরিয়ে আনা যাবে না, কিন্তু গল্পটা শেষ করা যায়।"
নীলা হাত কাঁপতে কাঁপতে খামটা খুলল। ভেতরে এক পাতা লেখা...
> "গল্পগুলো আমাদের
তুমি ছিলে, আছো, থাকবে...
প্রতিটা লাইনে তুমি হেঁটে বেড়াও।
আমি যদি না-ও থাকি একদিন, গল্পটা থাকবে।
কারণ গল্পগুলো আমাদের, আর আমরা গল্পের।"
নীলা চোখের পানি লুকিয়ে ফেলতে চাইল, পারল না।
রুদ্র বলল,
– "চলো, আজ নতুন একটা গল্প শুরু করি। এবার নামটা থাকবে... 'নীলা'।"
– "আর গল্পের শেষে?"
– "সেখানে লেখা থাকবে, 'এটা আমাদের গল্প, আর এটা কখনো শেষ হয় না।'"
নীলা ধীরে মাথা নাড়ল।
একটা পুরনো গল্পের শেষ লাইনে, আজ নতুন গল্পের শুরু হলো।
গল্পগুলো আমাদের
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
44
Views
8
Likes
0
Comments
0.0
Rating