পাখি যখন বই প্রকাশ অনুষ্ঠানের শেষে করিডোর ধরে হাঁটছিল, চারপাশের কোলাহল তাকে স্পর্শ করছিল না। বুকের ভেতরে কেমন এক নিঃশব্দ আবেগ গুমরে উঠছিল। তার চোখে আজকের দিনটা ছিলো এক পূর্ণতার ছবি—যেখানে তার কণ্ঠ, কলম আর কাঁধের ওপরে সজাগ সাহস একসাথে দাঁড়িয়ে আছে।
আর তখনই আকাশ এসে পাশে দাঁড়ালো।
তার মুখে ছিল সেই চিরচেনা নীরব হাসি। চোখে আজ একটু বেশি স্থিরতা। পাখি বুঝতে পারলো—এই মানুষটা আর আগের মতো নেই। সে বদলেছে, শিখেছে, একধরনের পরিণতি এসেছে তার ভেতরে।
আকাশ বলল,
“তুমি বলেছিলে—ভালোবাসা মানে নিজেকে না হারানো। আমি ভাবতাম, ভালোবাসা মানেই তো একসাথে থাকা। আজ বুঝলাম, আসলে একসাথে থাকা মানে—একটা স্বপ্নকে একসাথে আগলে রাখা।”
পাখি এক চিলতে হাসি দিলো, তারপর বলল,
“ভালোবাসা তখনই টেকে, যখন তা স্বাধীনতার দেয়ালের ভেতরে আশ্রয় খুঁজে নেয়, শৃঙ্খলের মধ্যে নয়।”
আকাশের চোখ ভিজে উঠলো। খুব শান্ত গলায় সে বললো,
“তুমি পাশে থাকলে আমি আর নিজের ছায়াকেও ভয় পাবো না।”
পাখি একটু চুপ করে থেকে বলল,
“আমি তোমার পাশে থাকতে চাই, কিন্তু শর্ত একটাই—আমাদের ভালোবাসা যেন আমাদের আলাদা আলাদা আলো নিভিয়ে না দেয়।”
আকাশ মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মতি জানালো।
সেই মুহূর্তটা যেন লাহোর শহরের সবচেয়ে নিঃশব্দ, অথচ সবচাইতে জ্বলজ্বলে মুহূর্ত হয়ে রইলো।
---
তিন মাস পর
লাহোর শহরে বসন্ত এসেছে। রাস্তার পাশে গুলমোহর গাছে লাল ফুল ফুটেছে। পাখির জীবনে যেন সত্যিকার বসন্ত নেমে এসেছে। তার বই সাড়া ফেলেছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে রিসোর্স পারসন হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে।
আর আকাশ?
সে যেন এখন আর আগের সেই ক্লান্ত, বিষণ্ন তরুণ নয়। সে এখন পাখির ছায়ায় দাঁড়িয়ে নিজের আলো খুঁজে নিচ্ছে।
চৌধুরী এন্টারপ্রাইজে নতুন এক সংস্কারের ছোঁয়া লেগেছে। শ্রমিকদের পারিশ্রমিক বাড়ানো হয়েছে, নারী কর্মীদের জন্য আলাদা ফ্লোর, ডে-কেয়ার আর শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়েছে। এসব পেছনে থেকে চালাচ্ছে আকাশ চৌধুরী, আর উৎসাহ জোগাচ্ছে পাখির চিন্তাধারা।
একদিন সকালে আকাশ চৌধুরীর অফিসে হঠাৎ পাখি হাজির।
হাতে ছোট্ট একটা ব্রাউন প্যাকেট।
আকাশ অবাক হয়ে বলল,
“এই সকালবেলায়? কোনো খবর আছে?”
পাখি বসে বলল,
“তোমার নতুন প্রজেক্ট লঞ্চের আগেই এটা চাইছিলাম দিতেই।”
আকাশ প্যাকেট খুলে দেখলো, ভেতরে একটা ছোট্ট কাঠের ফ্রেম। তাতে লেখা:
> "ভালোবাসা মানে নিজের ভেতরের আলোকে জাগিয়ে তোলা—না যে কেউ আমাদের অন্ধকারে হারিয়ে যাক, বরং যাতে আমরা দুজনই আলো হই একে অপরের জন্য।"
আকাশ চুপচাপ বসে রইলো। তারপর ধীরে ফ্রেমটা টেবিলে রেখে বলল,
“তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে দামি ইনভেস্টমেন্ট।”
পাখি হেসে বলল,
“আর আমি বুঝলাম, মনের ব্যাংকে সবচেয়ে সেরা লাভ হয়—ভালোবাসা জমা রাখলে।”
---
আরো তিন মাস পর
পাখি এখন পুরোপুরি এক নতুন পরিচয় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার লেখা বই এখন সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। নারীদের স্বনির্ভরতা নিয়ে তৈরি করা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, “তারা”—তারই হাত ধরে গড়ে উঠেছে।
আর আজ এক নতুন দিন। পাখি আর আকাশ একসাথে বসে আছে এক শান্ত ছোট্ট রেস্টুরেন্টে। মোমবাতির আলো, চারপাশে সুরেলা স্যাক্সোফোনের সুর, আর মনের মধ্যে জমে থাকা প্রশ্ন।
আকাশ বলল,
“তুমি কি জানো, আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিল যেদিন, আমি বুঝতেই পারিনি আমার ভিতরে এত প্রশ্ন লুকানো ছিল?”
পাখি তাকিয়ে বলল,
“আর আমি বুঝিনি, এক অচেনা ছেলেকে দেখে কেন আমার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল।”
আকাশ বলল,
“তুমি কি এখনও ভয় পাও আমাকে হারাতে?”
পাখি উত্তর দিলো,
“না, বরং এখন ভয় পাই—তোমাকে পেয়ে যদি নিজেকে হারিয়ে ফেলি কিনা।”
আকাশ হাত বাড়িয়ে বলল,
“তুমি যদি এক পা এগিয়ে চলো, আমি বাকিটা হেঁটে আসবো। শুধু বলো, তুমি কি চাও?”
পাখি একটু চুপ করে থেকে বলল,
“আমি চাই না তুমি আমার জীবন হও। আমি চাই তুমি এমন একটা জায়গা হও, যেখান থেকে আমি নিজের জীবনকে আরও শক্ত করে দেখতে পারি।”
আকাশ ধীরে বলল,
“তাহলে আমি হবো তোমার জানালা, যেখান থেকে তুমি তোমার আকাশ দেখবে।”
পাখি হেসে ফেলল।
“তুমি ঠিক বলেছো, তুমি আমার জানালার আকাশ। সবসময় কাছেই থেকো, কিন্তু নিজের সীমারেখা রেখেই।”
আকাশের চোখে তখন সত্যিকারের শান্তি।
---
আরও ছয় মাস পর
লাহোর শহরের এক ঐতিহাসিক মিলনায়তনে আজ একটি বড় সম্মেলন চলছে। “নারী নেতৃত্ব ও সামাজিক পরিবর্তন” নিয়ে দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে নারী প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ।
প্রধান বক্তা—পাখি ফারহানা।
সে যখন মঞ্চে উঠলো, মিলনায়তন করতালিতে ফেটে পড়লো। আকাশ পিছনের সারিতে বসে, মাথা নিচু করে তার সাদা নোটবুকে লিখছে—"আজ পাখির ডানায় আলো লাগলো। আমি শুধু বাতাস হতে চেয়েছিলাম। সে আজ উড়ছে, আমি সুখী।"
পাখি বলতে শুরু করল,
“এই পথ সহজ ছিল না। কিন্তু আমি ভেঙে পড়িনি, কারণ আমি বুঝেছি—একটা মেয়ের সবচেয়ে বড় শক্তি তার চিন্তা। সেই চিন্তা যদি ভয়হীন হয়, তাহলে সে যেকোনো রোল মডেল হতে পারে।”
সমাপ্তি বক্তৃতার পর পাখি যখন মিলনায়তন থেকে বের হচ্ছিল, আকাশ এগিয়ে এসে বলল,
“তুমি উড়ছো আজ। আমি কি একটুখানি ছায়া হতে পারি তোমার আকাশের নিচে?”
পাখি থেমে বলল,
“তুমি তো বরাবরই ছিলে। আমি শুধু নিজেকে প্রস্তুত করছিলাম, যেন সেই ছায়ায় দাঁড়িয়ে নিজের আলোকে না হারাই।”
আকাশ বলল,
“তাহলে চলো। আমাদের গল্পের নাম বদলে দেই। ‘মেঘে ঢাকা তারা’ নয়, বরং ‘আলো জাগানো তারা’ হোক।”
পাখি মুচকি হেসে বলল,
“তাহলে চল, একসাথে লিখি আমাদের গল্প। শুরু নতুন, শেষ নেই।”
---
দুই বছর পর
ঢাকার একটি ছোট্ট পাঠাগারে, একসাথে বসে বই পড়ছে আকাশ ও পাখি। দেয়ালে টাঙানো পাখির ছবি—আজ সে একজন জাতীয় পর্যায়ে সম্মানিত গবেষক, লেখক ও নারী অধিকার কর্মী।
ছোট্ট এক মেয়ে এসে পাখিকে জিজ্ঞেস করলো,
“আপু, আপনি কি সত্যিই সেই ‘মেঘে ঢাকা তারা’র লেখিকা?”
পাখি মৃদু হেসে বলল,
“না, আমি সেই তারাটা, যে মেঘ কেটে আলো দেখিয়েছিল। আর পাশে ছিল একজন—যে আমাকে আকাশ দিয়েছিল।”
ছোট মেয়েটা হেসে চলে গেলো।
আকাশ বলল,
“তুমি এখন অনেকের তারকা। আমি কি এখনো সেই জানালায় আকাশ হয়ে আছি?”
পাখি চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি এখন আমার আকাশই না, আমার গল্পের প্রতিটা লাইন, শব্দ আর নিঃশ্বাস।”
তারা দুজন একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলো। বাইরের আকাশে তখন সূর্য ডুবে যাচ্ছে, কিন্তু সে আলোয় ঝলমল করে উঠেছে পাখির চোখ।
আর ঠিক তখনই আকাশ ফিসফিস করে বলল,
“তোমাকে পেয়ে আমি নিজের আলো খুঁজে পেয়েছি।”
---
শেষ নয়, শুরু এক অন্যরকম জীবনের...
যেখানে ভালোবাসা মানে সমানভাবে পাশে থাকা, ভরসা হওয়া, মুক্ত থাকা।
যেখানে আকাশ শুধু বিশালতা নয়, পাখির জন্য অনন্ত সম্ভাবনা।
সমাপ্ত............................
মেঘে ঢাকা তারা (৪)
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
30
Views
4
Likes
0
Comments
5.0
Rating