ঢাকার আকাশে তখন শ্রাবণের শেষ বৃষ্টি। ধানমন্ডির গলিগুলো ভিজে ভিজে ঝিমিয়ে পড়েছে, আর মেসের জানালায় বসে রিদওয়ান কেবল তাকিয়ে ছিল বাইরের দিকে। দেয়ালে ঝুলে থাকা ঘড়িতে তখন রাত ২টা। লাইট নিভে গেছে রুমমেটদের, কিন্তু তার চোখে ঘুম নেই। মাথার পাশে রাখা সেই খামটা, যেটার ভাঁজে এখনো গন্ধ লেগে আছে নওরীনের হাতের।
চিঠির শেষ লাইন সে যতবার পড়েছে, ততবার মনে হয়েছে— ভালোবাসা শুধু থাকলেই হয় না, কিছু সময় আর পরিস্থিতির কাছে ভালোবাসাও কেমন অসহায়।
"আমি তোর কিছু ছেঁড়া পৃষ্ঠা হয়ে যাচ্ছি…"
এই বাক্যটার ভেতর কতোটা কান্না লুকিয়ে আছে, তা হয়তো কেবল নওরীন জানে। আর রিদওয়ান অনুভব করে।
---
এরপর বেশ কিছুদিন কেটে যায়।
নওরীনের প্রোফাইল নেই ফেসবুকে। মোবাইল নম্বর বন্ধ। এমনকি ইনস্টাগ্রামে তার সেই চা হাতে তোলা ছবিটাও নেই— যেটা একসময় ক্যাপশন ছিল “এক কাপ সাহচর্য চাই, কফির নয়।”
রিদওয়ান অনেক খুঁজেছে। লেকের পাড়ে গেছে বারবার, যেখান থেকে গল্পটা শুরু হয়েছিল। সেই বেঞ্চে বসে থেকেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কেউ আসে না। কেউ আর ফিরে আসে না।
অথচ প্রেম এমনই এক যাদু, যেখানে কেউ চলে গেলে ছায়াটাও ফিরে আসতে চায় না।
---
একদিন ক্যাম্পাসে, মিডটার্মের আগের দিন, তৃষা বলে, “দোস্ত, তুই ঠিক আছিস তো? চোখ দেখে মনে হচ্ছে, তুই ঘুমাস না একদম।”
রিদওয়ান শুধু মাথা নাড়ে। সে জানে, পৃথিবীর সবচেয়ে কষ্টের ব্যথাগুলো কোনো ফিজিক্স বা কেমিস্ট্রির সমীকরণে মাপা যায় না।
তৃষা তার কাঁধে হাত রাখে। “আমরা বন্ধু, জানিস তো? যদি কখনো কিছু বলতে চাস…”
“বললেই কি তৃষা?”— হালকা হাসে রিদওয়ান, “কিছু কিছু গল্প তো বলা যায় না। ওরা শুধু লেখা হয়ে থাকে নোটবুকে, কিংবা হয়তো চিঠির ভাঁজে।”
---
নওরীন তখন কানাডায়।
এয়ারপোর্টে বিদায় নেওয়ার সময় সে তার ছোট ভাইকে বলে, “ও যদি আসে, আর খোঁজ করে— তাহলে এই খামটা ওকে দিস। বলিস, আমি শুধু বলিনি, বরং লিখেও রেখে গেছি।”
ভাইটা কিশোর, বুঝে না অনেক কিছু। কিন্তু বোনের চোখে পানি দেখে সে শুধু মাথা নাড়ে।
আকাশে তখন উড়ছে এমিরেটসের বিমান। আর মাটিতে রয়ে যাচ্ছে এক অসমাপ্ত অধ্যায়।
---
মাস তিনেক পর।
একদিন মেসে ফিরেই রিদওয়ান দেখে, গেটের নিচ দিয়ে ঢুকে আছে একটা খাম।
হাতে তুলে নিতেই কেমন চেনা চেনা গন্ধ। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো একটা পাসপোর্ট সাইজ ছবি, আরেকটা ছোট চিঠি।
ছবিটা নওরীনের— চায়ের কাপ হাতে, স্কার্ফে মুখ ঢাকা। সে ছবির পেছনে লেখা—
“এই ছবিটার দিনেই তোকে প্রথম দেখি। জানিস, তুই না বলার পরেও আমি চা খেয়েছিলাম শুধু তোর পাশে বসার অজুহাতে।”
আর চিঠিতে:
“রিদওয়ান,
আজকে আমি হাজার মাইল দূরে বসে আছি। বরফ পড়ছে এখানে, জানালার কাঁচ ঘোলা হয়ে গেছে। তবু আমি জানি, তুই এখনো ধানমন্ডির লেকের পাশে বসিস মাঝেমধ্যে।
আমার প্রার্থনায় আজও তুই থাকিস। এমনকি চোখের পানির মতোই, প্রতিদিন।
তুই আমাকে ভালোবাসিস কি না, আমি কখনো জোর করে জানতে চাইনি। কারণ ভালোবাসা বললে কমে যায়। ওটা তো অনুভবের জায়গা— তুই বুঝেছিস, এতেই আমি ধন্য।
আমি জানি, তোকে জোর করে কিছু করতে বললে, সেটা ভালোবাসার অসম্মান হতো। তাই চুপচাপ চলে এসেছি। কিন্তু তুই যদি একদিন আসিস আমার দরজায়— আমি সব ছেড়ে ফিরবো।
ভালো থাকিস।
– তোর নওরীন”
---
চিঠির পরের লাইনগুলো পড়া হয়নি। চোখের কুয়াশায় অক্ষরগুলো ঝাপসা হয়ে যায়।
সেই রাতে রিদওয়ান আর ঘুমায় না। খামটা বালিশের নিচে রেখে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। আকাশে তারার ঝিকিমিকি নেই, শুধু শহরের আলো আর হঠাৎ হঠাৎ জেগে ওঠা কুকুরের ডাক।
সে নিজের মনের ভেতর একটা প্রতিজ্ঞা নেয়।
এই গল্প এখানে শেষ হবে না।
সে জানে, এখনো তার পকেটে নিজের স্বপ্ন আছে। এখনো তার হাতে সময় আছে।
---
ছয় মাস পর।
রিদওয়ান একটি রিসার্চ স্কলারশিপ পায়— টরন্টো ইউনিভার্সিটি থেকে।
তৃষা-রা পার্টি দেয়। মেসমেটরা চেঁচায়, “অ্যাই প্রোফেসর সাহেব! বিদেশ যাত্রা কবে?”
সে শুধু হাসে। তার চোখে তখন কানাডার বরফ ঢাকা পথ আর জানালার ওপারে বসে থাকা এক মেয়ে।
যে অপেক্ষায় আছে— হয়তো জানেও না অপেক্ষা কবে শেষ হবে।
---
অবশেষে সেই দিন আসে।
টরন্টো এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে রিদওয়ান সবার আগে দেখে— একটা স্কার্ফ পড়া মেয়ে। চায়ের কাপ হাতে নেই, কিন্তু চোখে সেই পুরনো জ্যোতি।
নওরীন।
সে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে। একফোঁটা অশ্রু তার চোখের কোণায় জমেছে। কিন্তু মুখে হাসি।
রিদওয়ান কিছু বলে না।
সে কেবল নিজের ব্যাগ থেকে একটা পুরনো নোটবুক বের করে।
নওরীনের হাতে দেয়।
প্রথম পাতায় লেখা—
“তুই বলেছিলি, ছেঁড়া পাতায় শুধু আমার নাম থাকবে।
আজ আমি তোর জন্য একটা নতুন অধ্যায় শুরু করতে এসেছি।”
চোখের জলে হাসে নওরীন।
আর হিমেল সেই সন্ধ্যায় তারা একসঙ্গে হাঁটতে থাকে— বরফের ওপর পা ফেলে, ঠিক যেভাবে একসময় লেকের পাড়ে হাঁটতো দুজন।
তাদের গল্প শেষ হয়নি।
শুধু নতুনভাবে শুরু হয়েছে।
চলবে.........................
শেষ চিঠি ( পর্ব ০২)
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
29
Views
3
Likes
0
Comments
5.0
Rating