মায়া পালিয়ে এসেছিল। না, নাটকীয় কোনো পালানো নয়। কারো হাত ধরে কিংবা কারো কাছ থেকে লুকিয়ে নয়। সে পালিয়েছিল একরকম শূন্যতা থেকে, যেটা শুরু হয়েছিল ঢাকার কোলাহলের ভেতর নিজের একাকিত্ব থেকে। চাকরি ছিল বনানীতে একটা ছোট আইটি ফার্মে, তবে কাজ ছিল বেশি, মর্যাদা কম, আর সম্পর্কগুলো ছিল যান্ত্রিক। সকালে বেরিয়ে রাতে ফিরলে মনে হতো সে যেন কোথাও নেই, কাউকে চেনে না, কেউ তাকে খুঁজেও না। তাই একদিন ব্যাগ গুছিয়ে পুরান ঢাকার একটা পুরনো বাড়িতে এসে উঠেছিল। বাড়িটার নাম “সুরঝা ভিলা”—১৮৯২ সালে বানানো হয়েছিল, একসময়ের নবাবদের তত্ত্বাবধানে থাকা এক দোতলা বাড়ি। এখন অবশ্য সেই জৌলুশ নেই। একপাশে থাকেন রহিমা খালা, বাড়ির মালিক, আর অন্যপাশটা তিনি ভাড়া দেন। ভাড়াটা কম, কারণ জায়গাটা পুরাতন, বিদ্যুৎ মাঝে মাঝে চলে যায়, আর কিছু ‘গুজব’ শোনা যায়—এই বাড়িতে কিছু অলৌকিক ব্যাপার ঘটে মাঝে মাঝে। মায়ার সেসব গুজবে বিশ্বাস নেই। বরং এই নীরব, ধুলোমাখা, ধ্বসে পড়া দেয়ালওয়ালা বাড়িটাই যেন তার মনের আয়না।
প্রথম দিনেই একটা ব্যাপার তার চোখে পড়ে—বাড়ির সিঁড়ির নিচে ছোট একটা কাঠের দরজা। দরজাটা যেন সাধারণ দরজা না, অনেকটা ছোটো, বাচ্চাদের জন্য বানানো হয়েছে যেন। এর সামনে জং ধরা একটা তালা ঝুলছে, আর উপরের কাঠে কুয়াশার মতো ফাটল। মায়া রহিমা খালাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “ওখানে কী আছে খালা?” খালা মাথা নাড়েন, “ওটা তো পুরান স্টোররুম। এখন তালা মাইরা রাখছি। ভেতরে ধুলা আর ইঁদুর। খোলার দরকার নাই মা।” কথাটা সহজ শোনালেও মায়ার কানে ঢুকে রইল একটা অদ্ভুত কৌতূহল। কী আছে সেই দরজার পেছনে? বাড়িটা রাতের দিকে অদ্ভুত নিঃশব্দ হয়ে যায়। বাইরে রাস্তার শব্দ শোনা যায়, দূর থেকে আজান আসে, কিন্তু ঘরের মধ্যে এমন নিস্তব্ধতা—যেন বাড়িটা নিঃশ্বাস নেয় না। সেই নিঃশব্দতার মধ্যে মাঝে মাঝে মায়া শোনে, কেউ যেন সিঁড়ির নিচে ধুপধাপ করে হাঁটছে। আবার একেক রাতে, দরজার নিচ দিয়ে বাতাস ঢোকে—কাঁচা মাটির গন্ধ, সোঁদা, একটু পচা পাতার মতো।
এক রাতে মায়া একটা স্বপ্ন দেখে। সে একটা মাঠে হাঁটছে। আলো অদ্ভুত, যেন সূর্য নেই, চাঁদ নেই, তবু চারপাশ ঝিকমিক করছে। হঠাৎ সামনে একটা দরজা। একদম সেই দরজার মতো—ছোট, কাঠের, তালা ঝোলা। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে একজন—চেহারা অস্পষ্ট। সেই মানুষটি নিচু গলায় বলে, “তুমি তো অনেক দেরি করে ফেললা…” মায়া জেগে ওঠে, শরীর ঘামে ভেজা। জানালার বাইরে তখনও বিদ্যুতের আলো ফ্ল্যাশ করে। পরদিন রাতে আবার সেই স্বপ্ন। সেই দরজা, সেই কণ্ঠস্বর। মায়া এবার ঘুম থেকে উঠে টর্চ নিয়ে নিচে নামে। দরজার কাছে গিয়ে বসে। তালায় হাত দেয়। ঠাণ্ডা, ধাতব, নড়েও না। ভেতর থেকে বাতাস আসছে—এই নিশ্চয়তা সে পায়।
পরদিন কাজ থেকে ফিরে সে চাবির দোকানে যায়। “এ রকম তালা খুলতে পারবেন?” দোকানদার দেখে বলে, “এটা তো অনেক পুরান জং ধরা তালা আপা। হয়তো নষ্ট হইয়া গেছে।” “তবুও খুলতে পারেন?” দোকানদার হেসে বলে, “আচ্ছা, চেষ্টা করি।” পরদিন সে তালা নিয়ে আসে, আর লোহার রড দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে তালা একসময় খচ করে খুলে যায়। ভেতরের দরজাটা সে প্রথম ধাক্কায় ঠেলতেই খুলে যায়। কিন্তু দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে তার সামনে তৈরি হয় এক অদ্ভুত দৃশ্য।
এটা কোনো গুদামঘর না। বরং দরজার ওপাশে আছে ঘাসে ভরা এক বিশাল মাঠ, দূরে নদী, মাঝে মাঝে শিস দিয়ে ওঠা হাওয়া। মায়া যেন চোখে বিশ্বাস করতে পারে না। এ কী করে সম্ভব? বাড়ির ভেতর এমন একটা জায়গা? সে এক পা বাড়িয়ে ভিতরে ঢোকে। তার পেছনে দরজাটা বন্ধ হয়ে যায়।
মায়া মাঠে হাঁটে। দূরে একটা কুঁড়েঘর দেখা যায়। ঘরের সামনে একটা পুরুষ বসে আছেন পিঁড়িতে। গায়ে সাদা ফতুয়া, মুখে চাপ দাড়ি, চোখে অদ্ভুত কোমলতা। লোকটা বলে, “তুমি তো অনেক দেরি কইরা ফেললা। আমরা তো অনেক আগেই তোমারে ডাক দিছিলাম।” মায়া বলে, “আপনি কে?” লোকটা উঠে দাঁড়ায়, “আমি তো তোমার ভেতরের সে অংশ, যারে তুই নিজেই ভুলে গেছিস। এই জায়গাটা—এটা তোর নিজেরই একখণ্ড মন, যেটারে তুই তালা মাইরা রাখছস।”
মায়া কিছুই বুঝতে পারে না। “আমি ঘরে ফিরতে চাই,” বলে সে। লোকটা বলে, “ফিরে তো যাইতে পারবি, কিন্তু মনে রাখিস—একবার এই দরজা খুললে, তুই কখনো আগের মতো থাকবি না।” হঠাৎ পেছনে তাকিয়ে দেখে দরজাটা নেই। মাঠ, নদী, কুঁড়েঘর—সবকিছু একটা কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে।
মায়া জেগে ওঠে। সে নিজের বিছানায়, ঘামে ভেজা গলা। কিন্তু দরজার তালা নেই! দরজাটা আধা খোলা। ভিতর থেকে এখনো সেই হাওয়া আসছে।
এরপর থেকে মায়া প্রতিরাতে দরজার ভিতর ঢোকে। একেকদিন একেক রকম দৃশ্য। কোথাও তার মায়ের শৈশব, কোথাও তার প্রথম স্কুলের দিন, কোথাও একা বসে থাকা সে নিজে। সে দেখতে পায় তার পুরোনো ভুল, পুরোনো ইচ্ছেগুলো, যেগুলো সে দাফন করেছিল নিজেরই অজান্তে।
একদিন সে দরজার ভিতরে দেখে একজন ছোট মেয়ে—৮ বছর বয়সী। সে বলছে, “তুমি তো আমাকে ছেড়ে দিছো। আমাকে ভুলে গেছো, অথচ আমিই ছিলাম তোমার সাহস।” মায়া তার হাত ধরে। বলে, “আমার দরকার তোদের, কিন্তু আমি জানতাম না কোথায় খুঁজবো।” ছোট মেয়েটি বলে, “তুই এখন জানিস। এই দরজা শুধু বাইরের না, ভিতরেরও। এইটা তোর ভিতরের দরজা।” সে বুঝে যায়—এই বাড়ি, এই দরজা, এই জগত সবকিছু তার নিজের মনেরই প্রতিফলন। এই বাড়িটা যেন এমন একটা জায়গা যেখানে নিজের সাথে দেখা হয়। জীবনের যেসব কথা চাপা থাকে, যেসব কান্না মুখ ফুটে বের হয় না, যেসব অপরাধবোধ বুকের ভিতরে জমা হয়—এই দরজা তাদের সামনে নিয়ে আসে।
এরপর একদিন রহিমা খালা এসে বলে, “মায়া, তুমি ঠিক আছো তো? তোমারে মাঝে মাঝে অদ্ভুত লাগে। তুমি কি সেই দরজাটার ভিতরে ঢুকছো?” মায়া চুপ করে থাকে। খালা বলে, “আমিও ঢুকছিলাম, অনেক বছর আগে। তারপর একদিন আর বের হইতে পারি নাই। আমার আত্মা সেইখানেই আটকা রইছে। এইখানে তো শুধু ছায়া।” মায়া তাকিয়ে দেখে—খালার গায়ের ছায়া মেঝেতে পড়ছে না।
সে চমকে ওঠে।
এরপর থেকে খালা আর তার সাথে দেখা করে না। শুধু দরজার ভিতরেই খালাকে মাঝে মাঝে দেখা যায়—চুপচাপ একটা ঘরের কোণে বসে থাকেন। মায়া জানে, সে আর একা না। তার ভিতরের দরজা এখন একবার খোলার পর চিরদিন খোলা। বাইরে যাই হোক, রাত হলেই সে ভিতরের জগতে ঢুকে পড়ে।
তার চাকরি চলে যায়, ফোনে মানুষজন আর যোগাযোগ রাখে না, কিন্তু মায়া আর আগের মতো থাকে না। তার চেহারায় একটা স্থিরতা আসে। দরজার ওপারে সে এমন অনেক কিছু দেখে—যা বাইরে কোনো শহর, অফিস, প্রেম বা সংসার দিতে পারে না। একরাতে, দরজার ওপাশে সেই মানুষটি—সাদা ফতুয়াওয়ালা লোকটা আবার আসে। বলে, “তুই কি এবার থাকবি?” মায়া কিছু বলে না। লোকটা হাসে, “থাকলে এই পৃথিবী তোর হইয়া যাইব। না থাকলে আবার তালা পড়ে যাইব।” মায়া এবার দরজা পেরিয়ে পুরোপুরি ঢুকে পড়ে।
সকালবেলা রহিমা খালার বাড়ির দারোয়ান এসে দেখে, মায়ার ঘরের দরজাটা খোলা, কিন্তু ঘরে কেউ নেই। বিছানা গুছানো, বইয়ের পাতা খোলা, আর নিচের সিঁড়ির নিচের দরজায় আবার সেই তালা—ঝুলছে, জং ধরা।
আর ভিতর থেকে হালকা বাতাসের সঙ্গে ভেসে আসে নদীর ঢেউয়ের শব্দ।
মায়ার চুপকথা
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
20
Views
2
Likes
0
Comments
0.0
Rating