মাই গার্লফ্রেন্ড

অডিও মোড

00:00 00:00
গতি:
ভলিউম:
সেওয়ান ইউনিভার্সিটির লিটারেচার ডিপার্টমেন্ট বরাবরই শান্ত, ছায়াময় আর কেমন যেন ধীর গতির। ক্যাম্পাসের শেষ মাথায় থাকা এই ভবনটার চারপাশে কচি বাঁশঝাড়, দুধারে ছড়ানো স্যাঁতসেঁতে বেঞ্চ। কিন্তু আজ এখানে অস্বাভাবিক কিছু ঘটেছে—সকাল থেকেই এখানে হইচই, মৃদু চিৎকার, আর কৌতূহলী দৃষ্টি।

কারণটা একটা মেয়ে। নাম হান সা-রি।

ঢেউ খেলানো চুল, চোখে সরাসরি তাকাতে গেলেই যেন কোনো অজানা রাজ্যের ঘূর্ণিতে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা হয়। শান্ত, তবু সাহসী হেঁটে আসে সে। সেওয়ানের সবচেয়ে বিখ্যাত প্রফেসর কাং মিন-হো'র একমাত্র মেয়ে। কিন্তু সে এখন ছাত্রী, সেই একই বিশ্ববিদ্যালয়ে।

অন্যদিকে, গল্পের নায়ক — জুনহো। লিটারেচার ডিপার্টমেন্টের থার্ড ইয়ার ছাত্র। সেওয়ানের সবচেয়ে সাধারণ, কেবলমাত্র একটি গুণ আছে তার—চোখে স্বপ্ন। কোনো বড় লেখক হওয়ার নয়, বরং একজন সত্যিকারের মানুষ হওয়ার।

তাদের প্রথম দেখা হয়েছিল লাইব্রেরির এক কোণে, একই বই নিয়ে টানাটানি করতে গিয়ে।

— “I think I reached first,” হালকা হেসে বলেছিল জুনহো।
— “You think wrong,” চোখ না তুলেই উত্তর দিয়েছিল সা-রি।

জুনহো কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিল। এইরকম ব্যবহার সেওয়ানে সচরাচর দেখা যায় না। অথচ সেই মুহূর্তেই মেয়েটিকে তার অন্যরকম লেগেছিল।

সা-রি ছিল নিজের জগতে। সে প্রেমে পড়ে না, কাউকে পাত্তা দেয় না। মানুষ তাকে দেখে পেছনে হাঁটে, তার ছায়াও যেন অচেনা ছায়াপথের আলো। জুনহো তার কাছে কিছুই না—একটা সাধারণ ছেলে, যার মায়ের রান্নার দোকানে রাতে গিয়ে সে কাজ করে, যাকে সবার সামনে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে কথা বলতে হয়।

কিন্তু কেমন করে যেন প্রতিদিন তাদের দেখা হতে লাগল—কখনও একই কফি লাইনে, কখনও ক্যাম্পাস ফেস্টে জুনহোর পারফরম্যান্সে সা-রির নিরব উপস্থিতি।

একদিন জুনহো সাহস করে বলেই ফেলল—

— “তুমি তো অনেক দূরের মেয়ে, হঠাৎ কেন এতো কাছে এসেছ?”
— “তুমি জানো না?” সা-রি গম্ভীর স্বরে বলল, “এটা আমার গল্পের প্লট।”

জুনহো হেসে উঠল, অথচ ভিতরে ভিতরে কেমন যেন একটা শিহরণ হল তার। যদি সত্যি এটা কোনো গল্প হতো, তবে চরিত্র হিসেবে সা-রি অনেক এগিয়ে। কিন্তু সে? সে তো কোনো গল্পের নায়কই না, সে তো শুধু ব্যাকগ্রাউন্ডে থাকা এক পাঠক।

তবে গল্প যখন শুরু হয়, তা তো সহজে থামে না।


---

সেদিন বৃষ্টির রাতে, জুনহো যখন ভেজা জামা গায়ে মায়ের দোকানে কাজ করছিল, হঠাৎই দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল সা-রি। ভিজে চুলে, চোখে অভিমান।

— “তোমার মা কি এখানে আছেন?”
— “হ্যাঁ, কিন্তু এখন ভেতরে। তোমার তো এখানে আসার কথা না…”
— “তোমার কথা তো কখনো বলা হয়নি আমার কোথায় যাওয়া উচিত,” চোখ তুলে বলল সা-রি।

মুহূর্তেই সবকিছু কেমন থমকে গেল। জুনহো দাঁড়িয়ে থাকল নিঃশব্দে, আর সা-রি সামনে এসে বলল—

— “তুমি জানো? আমি মাঝে মাঝে ভাবি, কেউ আমার গল্পটা লিখে দিচ্ছে। কেউ আমাকে চরিত্র বানিয়েছে, আর আমার কাজ শুধু অভিনয় করা।”

— “তুমি কি চাইছো আমি সেটা লিখি?” হঠাৎ করেই বলল জুনহো।

সা-রি তাকিয়ে রইল তার চোখে। উত্তর দিল না। যেন ওই চাহনিই যথেষ্ট ছিল।


---

পরবর্তী দিনগুলো ছিল অদ্ভুত সুন্দর। জুনহো আর সা-রি একসাথে হাঁটত, কথা বলত না বেশি, তবু মনের গভীরে শব্দ হয়ে বাজত একেকটি নিঃশব্দ অনুভব। ক্যাম্পাসের সবাই কানাঘুষো করত—“ওরা কি প্রেমে পড়েছে?”

কিন্তু সা-রি ছিল ভিন্ন। কোনোদিন ‘গার্লফ্রেন্ড’ শব্দটা নিজের জন্য ব্যবহার করেনি। তার প্রেম মানে কবিতা, চোখের দিকে চেয়ে থাকা, অথচ কিছু না বলা।

একদিন জুনহো জিজ্ঞাসা করেই ফেলল—

— “তুমি কি আমার গার্লফ্রেন্ড?”
— “তুমি কি আমার বয়ফ্রেন্ড?” পাল্টা প্রশ্ন করল সা-রি।

— “আমি হলে তুমি কেন বলো না?”
— “কারণ আমি কখনো কোনো সম্পর্কে নাম দিই না,” সা-রি চোখ সরিয়ে নিল, “নাম দিলে সেটা শেষ হয়ে যায়।”


---

কিন্তু সব গল্পে তো একটা বাঁক আসে, একটা ভুল বোঝাবুঝি, একটা টান।

একদিন হঠাৎ ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়ল ছবি—সা-রি আর আরেকজন ছেলে, হাত ধরে হাঁটছে এক কোরিয়ান রিসোর্টে। ছবিটা ভাইরাল, ক্যাপশনে লেখা — “প্রফেসরের মেয়ের বয়ফ্রেন্ড এই না কি?”

জুনহো কিছু না বলেই সরে গেল। সে কথা বলল না, সা-রির কোনো মেসেজে উত্তর দিল না।

আর সা-রি… সে তখন শুধু জানত, ছবিটা আগের বছরের, ছেলেটা ছিল তার কাজিন। কিন্তু ব্যাখ্যা তো তখন কেউ চায় না, সবাই শুধু ফলাফল চায়।

এক সন্ধ্যায় লাইব্রেরির সেই কোণে আবার দেখা হল। জুনহো বলল—

— “তুমি আমাকে নিয়ে খেললে কেন?”
— “আমি খেলিনি,” শান্ত গলায় উত্তর এল, “তুমি গল্প পড়তে জানো, কিন্তু বিশ্বাস করো না।”

— “তুমি কি তাহলে… আমার গার্লফ্রেন্ড ছিলে?”
— “আমি এখনো আছি,” বলে বেরিয়ে গেল সা-রি।


---

দিন কেটে গেল। জুনহো নিজের বইয়ে মন দিল, লেখালেখি শুরু করল। সা-রি নিরবে গ্যালারির কোণে বসে থাকত, তার কবিতা লিখত, মাঝে মাঝে জুনহোর ছায়া দেখে ফিরে যেত।

একদিন বিশ্ববিদ্যালয় ম্যাগাজিনে প্রকাশ পেল জুনহোর নতুন লেখা—“My Girlfriend” নামে এক ছোট গল্প।

সবার আগে সা-রি পড়ল সেটা। সেখানে লেখা ছিল—

> “সে কখনো আমার নাম বলেনি, কখনো আমাদের সম্পর্ককে কোনো সংজ্ঞা দেয়নি। তবু আমি জানি, তার চোখের ভাষা আমার চেয়ে ভালো কেউ বুঝতে পারত না। সে আমার গার্লফ্রেন্ড নয়, সে আমার গল্প।”



সেদিন সন্ধ্যায় ক্যাম্পাসের পেছনের বাগানে জুনহো বসেছিল একা। হঠাৎ পেছন থেকে গলা এল—

— “তুমি এবার নাম দিলে। 'গার্লফ্রেন্ড'।”

— “হ্যাঁ, কারণ এবার আমি গল্প লিখছি না। আমি সত্যি বলতে চাই।”

— “তাহলে বলো,” সা-রি হালকা হাসল।

— “আমি তোমাকে ভালোবাসি।”

সা-রি কিছু বলল না, কেবল তার পাশে বসে হাতে হাত রাখল। তারপর ধীরে বলল—

— “তুমি জানো? এবার আমিও গল্প লিখবো। তোমার নাম থাকবে প্রথম লাইনে।”
21 Views
3 Likes
0 Comments
0.0 Rating
Rate this: