" বাবা, তোমায় যা যা বললাম.. আর যেভাবে যেভাবে বললাম.. তুমি ঠিক সেইভাবেই সাহিদ সাহেবের কথা বলবে! তোমার কোনো কথা-বার্তা কিংবা কোনো আচরণ যেন ওনার কাছে সন্দেহ জনক মনে না হয়। উনি যাতে ভাবেন, আমরা যা বলছি সব সত্যি। বুঝতে পেরেছো!"
ছেলের কথায় আফজাল রাহমান ম্লান হেসে বলতে লাগলেন... " তুই কোনো চিন্তা নিস না রাতুল। আমি তোকে কথা দিচ্ছি, আমার কোনো কথাবার্তা বা কোনো বিহেভিয়ার সাহিদ সাহেবের কাছে সন্দেহজনক মনে হবে না। তুই আমাকে যেভাবে যেভাবে শিখিয়ে দিয়েছিস আমি ঠিক সেভাবেই ওনার সাথে কথা বলবো।"
" গুড, ভেরি গুড.. এবার চলো সাহিদ সাহেবের কেবিনের ভেতর। না জানি, কেন তিনি হঠাৎ.. তোমাকে আমায় এখানে নিয়ে আসতে বললেন।"
সাহিদ সাহেবের কেবিনের দরজায় নক করে রাতুল ক্ষীণ স্বরে বলল... " আসতে পারি স্যার।"
সাহিদ সাহেব হাতের ফাইলটার ওপর থেকে চোখ সরিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন... " আরে.. রাতুল তোমরা.. তোমরা চলে এসেছো। ওভাবে বাইরে দাঁড়িয়ে আছো কেন? এসো, এসো, ভেতরে এসে বসো।"
পারমিশন পেয়ে ধীর পায়ে কেবিনের ভেতর প্রবেশ করলো রাতুল আর আফজাল রাহমান। ভেতরে ঢুকে সোজা গিয়ে সাহিদ সাহেবের টেবিলের সামনের চেয়ার দু'টোতে দু'জনে বসে পড়লো। তারা চেয়ারে বসলে সাহিদ সাহেব মৃদু হেসে আফজাল রাহমানকে মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলেন... " কেমন আছেন আফজাল সাহেব?"
আফজাল রাহমানও মৃদু হেসে জবাব দিলেন... " জ্বী, আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি?"
" আমিও আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।" তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি আবার বললেন... " কি চা খাবেন নাকি কফি!"
" চা হলেই হবে! কিন্তু কফি হলে মন্দ হয় না।"
সাহিদ সাহেব এবার সবুজ নামের কাউকে ডাক দিলেন। দু' একটা ডাক দেবার পরই ছেলেটা এসে হাজির হলো। সে এলে সাহিদ সাহেব তাকে বললেন... " সবুজ যাও, তিনটা কফি নিয়ে এসো,, শিগগির।"
" জ্বী আচ্ছা স্যার।"
কথা টা বলে ছেলেটা কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলে সাহিদ সাহেব আফজাল সাহেবের দিকে খানিকটা ঝুঁকে এসে বললেন... " আচ্ছা আফজাল সাহেব, আপনারা কি তৃষাকে বিয়ের পর কানাডায় নিয়ে চলে যাবেন?"
" অবশ্যই না। আমরা এখন থেকে এই বাংলাদেশেই থাকবো। রাতুল প্ল্যান করেছে সে একটা নিউ কোম্পানি দেবে দেশে। তাই আমরা আর শুধু শুধু বিদেশে গিয়ে কি করবো বলুন!"
" হুঁ ,, আমার মনে হয় তাতেই ভালো হবে।"
" ধন্যবাদ। আচ্ছা সাহিদ সাহেব, বললেন না তো,, আপনি আমাকে এখানে আসতে বলেছেন কেন?"
" ওহ্ হ্যাঁ হ্যাঁ,, আপনাকে তো বলাই হয়নি। আচ্ছা আফজাল সাহেব, এখন আয়ানকে কি করা যায় বলুন তো? ওকে ছেড়ে দিলে তো রাতুল আর তৃষা'র সংসারে গিয়ে ঝামেলা বাঁধাবে। আর সারাজীবন ওকে বসিয়ে বসিয়ে খাইয়েই বা আমার লাভ টা কী?"
" উম.... সাহিদ সাহেব, আমার মনে হয় ওই আয়ানকে এই পৃথিবী থেকেই সরিয়ে দেওয়া উচিৎ। সে বেঁচে থাকলে আপনি, আমি, আমরা কেউই শান্তিতে বাঁচতে পারবো না।"
" আচ্ছা এটা করা কি ঠিক হবে? ওপরে তো একজন আছেন! উনি তো সবকিছুই দেখছেন! আমরা দুনিয়ার সকল মানুষকে ফাঁকি দিয়ে হয়তো আয়ানকে মেরে ফেলবো,, কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তো সবকিছুই দেখবেন।"
" সাহিদ সাহেব, এখন মনের মাঝে ওসব ধর্মীয় মানসিকতা আনা যাবে না! শুধু মনের মধ্যে ভাবনা আনুন, আপনার পথের কাঁটাকে আপনি চিরতরে সরিয়ে দেবেন।"
কিছুটা সময় মনে মনে কিছু একটা চিন্তা করে তারপর সাহিদ সাহেব বলতে লাগলেন... " আপনি ঠিক বলেছেন আফজাল সাহেব। এই সময় মাথায় ধর্মীয় ভাবনা নিয়ে ঘুরলে চলবে না, আজই ওই আয়ান মির্জাকে শেষ করে দিতে হবে। ও যদ্দিন এই পৃথিবীতে থাকবে, ততদিন আমাকে মাথার মাঝে একরাশ চিন্তা নিয়ে ঘুরতে হবে। তার চেয়ে বরং ওকে শেষ করে দেওয়াটাই বেটার হবে।"
পিয়ন মানে সবুজ নামের ছেলেটা এসে তিন কাপ কফি দিয়ে গেল। তিনজনে তিনটা কফির কাপ উঠিয়ে নিল। তারপর কফি কফি খেতে খেতে সাহিদ সাহেব এবং আফজাল সাহেবের কথা-বার্তা চলতে লাগল।
______________________________
সাহিদ সাহেবের কেবিন থেকে বেরিয়ে রাতুল তার বাবাকে মৃদু হেসে বলতে লাগল... " বাবা, আর জাস্ট কয়েকটা দিন ওয়েট করো। এরপর ওই কেবিনে বসে থাকবো আমি। এই রয়েল বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিজ হবে আমার। আমি হবো সাহিদ সরকারের গড়া রাজ্য এবং রাজত্বের রাজা। হা.. হা.. হা.. হা..!"
" জানিস রাতুল, আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না, আর মাত্র ক'টা দিন পরেই আমরা হতে চলেছি কোটিপতি। আর আমাদের কোনো ভাঙাচোরা বাড়িতে থাকতে হবে না। আমরা থাকবো রাজার হালে রাজপ্রাসাদে।"
" একদম ঠিক বলেছো তুমি বাবা, জন্মের পর থেকেই আমি একটা ভাঙাচোরা বাড়িতে বড় হয়েছি, লোককে দেখাতেই আমার লজ্জা করেছে যে এটা আমার বাড়ি। এখন, এখন আমি একটা রাজপ্রাসাদের মত বাড়ি তৈরি করে পৃথিবীর সব্বাইকে দেখিয়ে বলবো... দিস ইজ মাই হোম।
রাতুল এবং তার বাবা ভবিষ্যৎ নিয়ে কল্পনা করতে করতে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো।
____________________________
তৃষা আবার ফিরে গেলো এক বছর আগে। কল্পনা করতে লাগলো এরপর আয়ানের সাথে তার কি ঘটেছে! কি কাহিনী হয়েছে এরপর....!
..........Flash back..........
কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকতেই তৃষা দেখলো আয়ান মির্জা সকলের থেকে দূরে একটা জায়গায় একা একা মাথা নিচু করে বসে আছে। এটা দেখে তৃষা একটা অদ্ভুত ধরনের হাসি দিয়ে মনে মনে বলতে লাগলো... " কি আয়ান মির্জা, এখন কেমন লাগছে তোমার? মেয়েদের সাথে অসভ্যতামো করতে তোমার খুব মজা লাগে তাই না, এবার তার শাস্তির মজাটা কেমন পাচ্ছো তুমি!"
কথাগুলো বলে তৃষা কেন জানি আয়ানের দিকে এগিয়ে গেল। তার কাছে পৌঁছে তার পাশে বসে পড়লো সে।
কাউকে নিজের পাশে বসতে দেখে আয়ান মুখ ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখতে পেলো কালকের মেয়েটা। তাকে দেখে আয়ান কান্না মিশ্রিত স্বরে বলতে লাগল... " কেন তৃষা সরকার, কেন? কেন আপনি আমার সাথে এমনটা করলেন! কি ক্ষতি করেছিলাম আমি আপনার, যে আপনি এভাবে আমার জীবনটা তছনছ করে দিলেন। কি দোষ করেছি আমি?"
" কি দোষ করেছেন মানে! একটা মেয়েকে আপনি ইভটিজিং এর মত আকাশ পরিমাণ অপরাধ করেছেন আর বলছেন, কি করেছি আমি!"
" আপনাকে আমি আর কতবার বলবো, কাল আপনাকে আমি ইচ্ছে করে ধাক্কা টা দিই নি। ভুল করে হয়ে গেছে। তবু আপনি ভার্সিটির প্রিন্সিপাল স্যারকে গিয়ে বলেছেন,, আমি আপনাকে ইভটিজিং করেছি! আপনি জানেন, স্যার এটার জন্যে আমাকে কত বাড়ি শাস্তি দিয়েছেন.. কাল আমার পরীক্ষার ফরম ফিলাপের লাস্ট ডেট ছিলো, কিন্তু তিনি আমাকে বলেছেন.. আমি নাকি আর এই পরীক্ষা টা দিতে পারবো না।
কেন তৃষা সরকার কেন,, কেন আপনি আমার সাথে এমনটা করলেন? আপনি জানেন, আমার বাবা-মা কেউ নেই। তাই কত কষ্ট করে আমাকে পড়ালেখা করতে হয়! আমি সন্ধ্যার পর থেকে একটা লাইব্রেরীর দোকানে কাজ করি, রাত এগারোটায় সুযোগ পাই বাড়ি ফিরে গিয়ে বই পড়ার। রাত তিনটা চারটা অব্দি বই পড়ার পর মাত্র তিন ঘন্টার মত ঘুমাই। ঘুম থেকে উঠে সোজা প্রাইভেট চলে যেতে হয়। সারাক্ষণ এত পরিশ্রম করতে হয় যে, আমি নিজের শরীরের প্রতি একটু যত্নও নিতে পারি না। জন্মের পর থেকেই আমাকে দুঃখের সাগরে ভাসতে হচ্ছে। সুখ নামক বস্তুটার সাথে এখনো আমার পরিচয়ই হয় নি।"
কথাগুলো শুনে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তৃষা আয়ানের দিকে তাকালো। দেখলো আয়ানের চোখের কোণে জল এসে জমা হচ্ছে। তৃষা বিস্মিত হয়ে মনে মনে ভাবছে... ছেলেটার জীবনে এত দুঃখ। তাকে এত কষ্ট করে পড়ালেখা আর নিজের খরচ চালাতে হয়। কাল সত্যিই তাকে ছেলেটা ইচ্ছে করে ধাক্কা মারে নি,, জাস্ট ভুলবশত হয়ে গেছে। আর সে কিনা তাকে ভুল বুঝে প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে গিয়ে বিচার দিয়েছে যে সে তাকে ইভটিজিং করেছে। ছিঃ,, তৃষার এখন নিজের প্রতি নিজেরই ঘৃণা হচ্ছে। কাল কেন সে ছেলেটার কথা বিশ্বাস করলো না! সে যদি তার কথা বিশ্বাস করতো, তাহলে এখন নিজেকে নিজের প্রতি এতটা ঘৃণা লাগতো না।
তৃষা ভাবলো, ছেলেটার জন্য কিছু একটা করা উচিত। নইলে ছেলেটার জীবনটা ছন্নছাড়া হয়ে যাবে!
তৃষা এবার নিচু স্বরে আয়ানকে বলল... " আপনি চলুন আমার সাথে!"
অবাক হয়ে আয়ান তৃষাকে জিজ্ঞেস করলো... " কোথায় যাবো?"
" আপনাকে অত কথা বলতে হবে না, আপনি শুধু চলুন তো আমার সাথে।"
আয়ান আর তৃষাকে কোনরকম জেরা কিংবা জোর করলো না, সে তাকে কোথায় নিয়ে যাবে? বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো সে। সাথে তৃষাও। দু'জনে মিলে ভার্সিটির দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো।
তৃষা মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করে বলতে লাগল... " আল্লাহ, আমি এখন যেটা করতে চাচ্ছি, প্রিন্সিপাল স্যার তাতে যেন রাজি হয়ে যান। তিনি যেন আমার কথায় আর কোনোরকম অমত না করেন! প্লিজ গড, হেল্প।"
To Be Continued...............
জীবন সাথী (৪)
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
80
Views
9
Likes
2
Comments
5.0
Rating