লাহোর শহরের ভেতর দিয়ে ছুটে চলা গাড়ির কাঁচের বাইরে তাকিয়ে ছিল পাখি ফারহানা। চোখে ছিল ঘুমঘুম ক্লান্তি, অথচ মনে এক অজানা আতঙ্ক। বাবার সরকারি বদলির সুবাদে মাত্র তিনদিন আগে ঢুকেছে এই রাজ্যে। নতুন এক শহর, নতুন এক সমাজ, আর সবচেয়ে বেশি—নতুন এক ‘বাবার স্বপ্ন’ পূরণের চাপ।
পাখি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাশ করা একজন মেধাবী তরুণী। সাহসী, আত্মসম্মানী আর স্পষ্টবাদী। সে চায় নিজের জন্য বাঁচতে, নিজের মতো করে নিজের একটা আলাদা পরিচয় গড়ে তুলতে। কিন্তু চারদিকে যেভাবে নিয়ম আর রীতিনীতির বেড়া, সে জানে—এই শহরে এসে তাকে সংগ্রাম করেই টিকে থাকতে হবে।
ওদিকে লাহোর শহরের সবচেয়ে বিখ্যাত ব্যবসায়ী পরিবারের একমাত্র উত্তরসূরি আকাশ চৌধুরী, শহরের মানুষের মুখে মুখে যার নাম।
চৌধুরী এন্টারপ্রাইজের ডিরেক্টর, বয়স মাত্র তেইশ, অথচ ব্যক্তিত্ব এমন যে মিটিংয়ে মুখ খুললেই ডাইরেক্টর বোর্ড চুপ হয়ে যায়।
কিন্তু তার ভেতরের গল্প কেউ জানে না।
আকাশের চোখে থাকে সবসময় এক ধরনের বিষণ্নতা, যেন কোনো এক অতীত তাকে কুরে কুরে খায় প্রতিদিন। মা নেই, বাবা নামমাত্র উপস্থিত। একাকীত্বই তার সবচেয়ে বড় সঙ্গী।
তবে পাখির মতো কেউ কখনো তার জীবন ছুঁয়ে যায়নি। এখনো না।
আজ ছিল লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ের মিড ইয়ার কালচারাল সেমিনার। সেখানে স্পেশাল গেস্ট হিসেবে আসছে শহরের নামী ব্যবসায়ী আকাশ চৌধুরী। আর একই প্রোগ্রামে নিজের একাডেমিক রিসার্চ প্রেজেন্ট করতে যাচ্ছে পাখি ফারহানা।
দুই ভিন্ন জগতের মানুষ, এক অদ্ভুত মুহূর্তে এক মঞ্চে দাঁড়াতে চলেছে—অজানা ভবিষ্যতের সূচনা হতে যাচ্ছে এখানেই।
---
সেমিনার হলে ভিড় জমেছে সকাল থেকেই। ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যস্ততা, ক্যামেরা সেটাপ, মিডিয়ার মাইক্রোফোন, আর অতিথিদের আসার প্রস্তুতি—সব মিলিয়ে এক জমজমাট পরিবেশ।
পাখি নীল কামিজ পরে, মাথায় হালকা ওড়না রেখে বুক ধুকপুক করতে করতে স্টেজের দিকে এগিয়ে গেল। তার হাতে নিজের গবেষণার স্লাইড, মাথায় ঘুরছে হাজারো চিন্তা।
ঠিক সেই সময় হলের আরেকপ্রান্তে ঢুকলো আকাশ চৌধুরী। কালো স্যুটে ধরা আকাশকে দেখে যেন পুরো হল স্তব্ধ হয়ে গেল এক মুহূর্তের জন্য। ছেলেরা ঈর্ষায় তাকালো, মেয়েরা বিস্ময়ে।
কিন্তু আকাশের দৃষ্টি স্থির।
তার চোখ এসে পড়ে স্টেজের এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা পাখির ওপর।
প্রথম দেখা।
দুজনে তাকায় একে অপরের দিকে।
কেউ কিছু বলে না। কিন্তু চোখের গভীরে লেগে থাকে এক ধরনের অদ্ভুত স্পর্শ।
পরিচয় তখনো হয়নি। তবুও যেন কিছু একটা বদলে গেল ভিতরে ভিতরে।
---
প্রেজেন্টেশন শুরু হলো।
পাখির কণ্ঠে আত্মবিশ্বাস ঝরে পড়ছিল, প্রতিটি লাইন পরিষ্কার, প্রতিটি যুক্তি শক্তিশালী। হলের সবাই মুগ্ধ।
আকাশ চুপচাপ বসে শুনছিল। অদ্ভুতভাবে মনোযোগ দিয়ে।
তার চেহারায় তখন আর সেই অভিজাত অহংকার নেই, বরং একটা অচেনা মুগ্ধতা।
প্রেজেন্টেশন শেষে করতালির ঝড় উঠলো।
কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই ঘটে গেল প্রথম সংঘর্ষ।
প্যানেল থেকে একজন প্রশ্ন করলো,
“আপনি বলছেন নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতাই নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়ন—কিন্তু বাস্তবে তো সেটা সমাজে ভিন্নভাবে দেখা হয়। আপনি কিভাবে এটাকে ব্যালান্স করেন?”
পাখি গলা শক্ত করে বললো,
“সমাজ পরিবর্তন হয় চিন্তার মাধ্যমে। ভয় পেয়ে চুপ থাকলে কিছুই বদলাবে না। আমি শুধু নিজের জন্য না, সকল নারীর জন্য বলছি—চুপ না থেকে কথা বলা শুরু করুন।”
হঠাৎ আকাশ বলল,
“সাহস ভালো, কিন্তু বাস্তবতা কি আপনি জানেন?”
পাখি চোখে চোখ রেখে বলল,
“বাস্তবতা জানি বলেই তো সাহস করছি।”
হল নিস্তব্ধ। দুজনের মাঝখানে ছড়িয়ে পড়ে বিদ্যুৎ।
প্রথম সংলাপেই বুঝিয়ে দেয়—এই সম্পর্কটা সহজ হবে না।
---
সেমিনার শেষে বাইরের করিডোরে আবার দেখা হয় দুজনের।
আকাশ এগিয়ে এসে বলে,
“তুমি... একটু অন্যরকম।”
পাখি উত্তর দেয়,
“আপনাদের জগতের মেয়েদের থেকে, না?”
আকাশ হেসে ফেলে,
“সোজা কথা বলো তুমি।”
পাখি বলে,
**“ঘুরিয়ে বলার সময় কই? জীবন ছোট।”
আকাশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“তুমি এখানে নতুন?”
পাখি মাথা নাড়ে,
“হ্যাঁ। তবে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে আসিনি।”
আকাশ তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে,
“তুমি আমায় অনেক প্রশ্ন করতে শেখাচ্ছো।”
পাখি চলে যেতে যেতে বলে,
**“জানার আগ্রহটাই তো বাঁচিয়ে রাখে মানুষকে।”
---
সন্ধ্যায় পাখি বাসায় ফিরে এলো, আর আকাশ ফিরলো তার নিজের রাজপ্রাসাদ-সম বড় বাসায়।
পাখি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল খুলে ফেলছে। সে জানে, আজকের দিনটা ছিল অন্যরকম।
কিন্তু এখনো সে জানে না, সামনে আরও কতকিছু অপেক্ষা করছে।
আর আকাশ… সে আজ নিজের ঘরে এসে চুপচাপ বসে আছে।
কারো কথা ভাবছে।
চোখে পাখির সেই আত্মবিশ্বাসী দৃষ্টি ভাসছে বারবার।
To Be Continued............
মেঘে ঢাকা তারা (১)
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
147
Views
11
Likes
1
Comments
5.0
Rating