বল্টু ও বল্টুর বালতি

অডিও মোড

00:00 00:00
গতি:
ভলিউম:
বল্টু ছিল এক গাঁয়ের বিখ্যাত... না না, বিখ্যাত না, বরং কুখ্যাত বোকা। তবে তার একটাই গুণ ছিল—সে সবকিছুতেই নিজের "বুদ্ধি" খাটাতে চাইত। গ্রামের লোকজন প্রায়ই তার বুদ্ধির পরিচয় পেয়ে দম ধরে হাসত।

একদিন সকালে বল্টু হঠাৎ করে গম্ভীর মুখে হাঁটতে হাঁটতে বাজারের দিকে রওনা হলো। হাতে একটা খালি লাল বালতি। পথে দেখা হলো রহিম চাচার সঙ্গে। চাচা জিজ্ঞেস করলেন,
— “এই বল্টু, বালতি হাতে করে কোথায় যাচ্ছিস?”
বল্টু চোখে চশমা চড়ানো ভাব নিয়ে বলল,
— “বুদ্ধি আনতে যাচ্ছি চাচা। শহরের দোকানে এখন বুদ্ধি সস্তায় বিক্রি হয় শুনেছি!”

চাচা থেমে গেলেন। মুখে হাসি চেপে রাখতে পারলেন না। গ্রামের আরও কয়েকজন শুনে চারপাশে জড়ো হয়ে হেসে উঠল। বল্টু তাদের পাত্তা না দিয়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে শহরের পথে হাঁটা দিল।

শহরে গিয়ে সে এক ইলেকট্রনিক্স দোকানে ঢুকল। দোকানের মালিক ব্যস্ত ছিলেন, তবুও বল্টুর মুখের দিকে তাকিয়ে হাসি আটকাতে পারলেন না।
— “কি লাগবে ভাই?”
— “এক বালতি বুদ্ধি দিন তো। যদি ডিসকাউন্ট থাকে, তাহলে একটু বেশি দিন।”

দোকানদার মুহূর্তেই বুঝে ফেলল বল্টু কী জাতের মানুষ। একটু দুষ্টুমি করার লোভ সামলাতে না পেরে সে বল্টুকে একটা পুরনো ফ্যানের পাখা ধরিয়ে দিল।
— “এইটা হচ্ছে বুদ্ধির যন্ত্র! এটা মাথার উপর ঘুরালে ঠান্ডা বুদ্ধি মাথায় ঢোকে।”

বল্টুর চোখ চকচক করে উঠল।
— “আচ্ছা ঠিক আছে, এটিই নেব।”

সে পাখাটা বালতিতে ভরে নিল আর গর্বিত মুখে গ্রামে ফিরে এল।

বাড়ি ঢুকেই বল্টু হাঁক দিল,
— “এই শুনো, আমি বুদ্ধি নিয়ে এলাম!”

তার বউ জরিনা দরজা থেকে বেরিয়ে এসে অবাক চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
— “এইটা কি এনেছো?”
— “বুদ্ধি! এখন থেকে আমি আর বোকা না!”

জরিনা চোখ কুঁচকে বলল,
— “বুদ্ধি খরচ করে কিনেছো?”
বল্টু বলল,
— “না, ইনভেস্টমেন্ট করেছি! ভবিষ্যতে আমি গাঁয়ের চেয়ারম্যান হলে, তখন তুমি বুঝবে এই বুদ্ধির দাম!”

জরিনা তো এবার হেসেই কাহিল। বল্টু ঘরে গিয়ে পাখাটা মাথার উপর রেখে ফ্যানের মতো ঘুরাতে লাগল। এরপর বলল,
— “এই ফ্যান দিয়ে আমি এখন থেকে ফ্রিজ ছাড়াই খাবার ঠান্ডা করব। বিদ্যুৎ বাঁচাব! এটা হাই টেক বুদ্ধি, টিকটকেও কেউ জানে না!”

জরিনা বলল,
— “তোমার মাথায় ফ্যান ঘোরে, আর আমার মাথায় চিন্তা!”

পরদিন বল্টু বাজারে গিয়ে তার ‘বুদ্ধির ফ্যান’ নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। সবাই এসে জড়ো হলো। একজন বলল,
— “এইটা কি?”
বল্টু বলল,
— “বুদ্ধি সঞ্চালক! এই ফ্যান চালিয়ে মাথার উপর রাখলেই বুদ্ধি জমা হয়। চাইলে পাঁচ টাকা দিয়ে একবার ব্যবহার করতে পারো।”

লোকজন তো ভীষণ আনন্দে! অনেকে টাকা দিয়ে ফ্যান মাথার উপর ঘোরায়, কেউ ভিডিও করে, কেউ সেলফি তোলে। বল্টুর একদিনেই পঞ্চাশ টাকা আয়! সে তো খুশিতে বলল,
— “এবার থেকে আমি বুদ্ধি বিক্রেতা! ডাক নাম ‘বুদ্ধি ভাই বল্টু’!”

একদিন এক ছোট বাচ্চা তার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল,
— “আঙ্কেল, আপনি কি সত্যিই বুদ্ধিমান?”
বল্টু গম্ভীর মুখে বলল,
— “আমি তো বুদ্ধিমান হবই! আমি প্রতিদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলি—‘তুই পারবি বল্টু!’ আর আয়না ভাবছে—এই লোকটা আমাকেও হাবা বানিয়ে দিচ্ছে!”

বাচ্চাটা হেসে গড়িয়ে পড়ল। পাশ থেকে একজন বলল,
— “বল্টু ভাই, আপনি না থাকলে এই গ্রামটা অনেক সিরিয়াস হয়ে যেত!”
বল্টু গর্ব করে বলল,
— “সিরিয়াস রোগের একমাত্র ওষুধ—বল্টু!”

এরপর থেকে যখনই কেউ মন খারাপ করে থাকত, তখন সে চলে যেত বল্টুর কাছে। আর বল্টু নতুন কোনো বুদ্ধির গল্প শুনিয়ে সবার মুখে হাসি এনে দিত।

গ্রামের মুরুব্বিরা বলতেন,
— “বল্টুর মতো মানুষ আসলে সমাজের অক্সিজেন—বোকা হলেও মনটা সোনার!”

আর বল্টু বলত,
— “আমি বোকা হতে পারি, কিন্তু আমি এমন বোকা, যাকে দেখলে মানুষ খুশি হয়। তেমন বুদ্ধিমান হতে চাই না, যাকে দেখলে মানুষ ভয় পায়।”

গল্পের শেষে সবাই জানে, বল্টু আসলে বোকা নয়—সে হাসির ছলে সবাইকে জীবনের আনন্দ শেখায়।

আর গাঁয়ের লোকজন এখনো বলে,
“বল্টু থাকলে গাঁয়ে হাসি থাকে, বুদ্ধি না থাকলেও চলে!”
100 Views
9 Likes
1 Comments
4.0 Rating
Rate this: