" তৃষা... মামণি প্লিজ তুমি আমার কথাটা বিশ্বাস করো! ওই আয়ান মির্জা আর কোনোদিন ফিরবে না... ওকে তুমি ভুলে যাও। ওর জন্যে তো তুমি ছয়-ছয়' টা মাস ওয়েট করলে... ও ফিরলো কী! না মা... ও আর কোনোদিন ফিরবে না... কোনোদিন'ও না! তুমি শুধু শুধু ওর জন্যে অপেক্ষা করে নিজের সুন্দর জীবনটা নষ্ট করছো! প্লিজ মা.. রাতুলকে তুমি একটা সুযোগ দাও.. তুমি দেখবে.. ও তোমার এই অভিশপ্ত জীবনটা কত সহজে সুন্দরে সুন্দরময় করে তুলবে! তুমি ভুলেই যাবে যে.. আয়ান নামের একজন মানুষ কোনোদিন তোমার জীবনে এসেছিল।"
" না বাবা না.. এটা আমি কিছুতেই করতে পারবো না! আয়ানকে আমি ভালোবাসি... আমি ওর জন্যে শুধু ছয় মাস কেন.. ছয়' শ বছরও ওয়েট করতে পারি। আর তুমি ভুলে যেও না বাবা.. আয়ান এখনো আমার স্বামী এবং আমি এখনো তার বিবাহিতা স্ত্রী। এখনো তার আমার ওপর সম্পূর্ণ রকম অধিকার আছে। সে ছ' মাস হলো নিখোঁজ বলে.. আমি আবারো একটা বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়ব এটা তুমি ভাবলে কি করে! না বাবা.. এই তৃষা সরকার এখনো এতটাও নিচে নেমে যায় নি। সে ছ' মাস আগে যেভাবে আয়ান মির্জাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল... আগামী সাত জন্মও সেভাবে তাকে ভালোবেসে যাবে। "
" মা.. আমি বুঝতে পারছি তুমি আয়ানকে খুব ভালোবাসো। সে তোমার স্বামী। কিন্তু মা.. তুমি একটুখানি চিন্তা করে দেখো.. তোমার গোটা জীবন এখনো পড়ে আছে। যদি তুমি সেই জীবনটা সুন্দর করতে চাও, রঙিন করতে চাও.. তাহলে তোমার পাশে তোমার একটা মানুষের প্রয়োজন। তুমি তো সেই মানুষ হিসেবে ওই চিটার বাটপার আয়ান মির্জাকে ঠিক করেছিলে, কিন্তু ও তোমায় কত সুন্দরভাবেই না ঠকালো। বিয়ের দু'দিন পর অভাবের তাড়নায় তুমি নিজের দশ ভরি গহনা ওকে বিক্রি করতে দিয়ে একটা ব্যবসা শুরু করতে বললে, আর ও তোমার ওই গহনাগুলো নিয়ে কোথায় না কোথায় হারিয়ে গেল।যাই হোক, ওসব কথা এখন থাক... তৃষা মামণি, তুমি কি জানো, আমি শত শত ছেলে দেখার পর রাতুলকেই কেন তোমার উপযুক্ত জীবন সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছি.. কারণ, কেবলমাত্র সে'ই পারবে তোমার এই জীবনটা সুন্দর করে সাজাতে। তোমাকে চিরকাল সুখের চাদরে ঢেকে রাখতে।"
" আমার এত সুখের প্রয়োজন নেই বাবা! আমি এই দুখের সাগরেই খুব ভালো আছি। তুমি প্লিজ.. আমাকে আর সুখ নামক জিনিসটার দোরগোড়ায় দাড় করিও না। আমি এভাবেই ভালো আছি। আর চিরকাল এভাবেই ভালো থাকবো। তবে আমি জানি.. আমার আয়ান একদিন আমার কাছে ফিরে আসবেই। তাকে আসতেই হবে!"
তৃষার কথাগুলো শুনে সাহিদ সরকার হয়তো আরো কিছু বলতে চাইলেন, কিন্তু কেন জানি আর কিছু বললেন না। প্রচন্ড রকম রাগী রাগী ভাব নিয়ে তিনি বেড়িয়ে গেলেন তৃষার রুম থেকে! ঘর থেকে বের হতেই তিনি দেখলেন পারমিতা সিদ্দিকী দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। উনি রুম থেকে বের হতেই তিনি বিস্ময় দৃষ্টিতে ওনার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন.. " কিগো.. কি বললো মেয়েটা। ও কি রাজি এই বিয়েতে! "
সাহিদ সরকার খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে গম্ভীর গলায় বললেন.. " নাহ.. আবার সেই এক কথা! তার আয়ান তাকে ঠকায় নি। সে নাকি কোনো একদিন নিশ্চয়ই তার কাছে ফিরে আসবে। তাই সে কিছুতেই এই বিয়েতে করতে পারবে না।"
এই বলে পারমিতা সিদ্দিকী'কে পাশ কাটিয়ে সেখানে থেকে চলে গেলেন সাহিদ সরকার। উনি সেখান থেকে চলে গেলে, পারমিতা সিদ্দিকী কয়েক সেকেন্ড দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে বিসমিল্লাহ বলে ধীর পায়ে তৃষা'র রুমের ভেতর প্রবেশ করলেন। দেখলেন.. তৃষা জানালার রেলিং ধরে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি আবারো ধীর পায়ে তার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন। তৃষা একবার তার মায়ের দিকে তাকালো বটে, কিন্তু ওনার চোখে চোখ পড়তেই সে চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে আবার বাইরের দিকে তাকালো।
তৃষা'র কাছে এসে পারমিতা সিদ্দিকী তার মাথায় হাত রেখে নরম গলায় ডাকলেন.. " মা তৃষা! "
মায়ের গলা শুনে তৃষা বিরক্ত হয়ে মাথা ঘুরিয়ে ফিরে তাকালো ওনার দিকে। যথাসম্ভব নিজের রাগকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে বলল.. " কী?"
পারমিতা সিদ্দিকী খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে আবার নরম গলায় বলতে লাগলেন.. " মা.. তুই কেন এমন করছিস বলতো। আমরা তো তোর বাবা মা! তোর ভালোর জন্যই আমরা তোকে বলছি এই বিয়েটা করতে। তুই কেন আমাদের....
পারমিতা সিদ্দিকী'র কথা শেষ না হতে দিয়েই তৃষা বিরক্ত হয়ে চাপা স্বরে বলতে লাগলো... মা.. এতক্ষণ ধরে বাবা জ্বালাচ্ছিল,, এখন তুমিও কোথা থেকে এসে আবার সেই এক ক্যাসেটই বাজানো শুরু করে দিলে। আমার আর এসব একদম ভালো লাগছে না। তোমরা দু'জন প্লিজ এসব বন্ধ করবে.. নাকি আমি এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাব! কোনটা?"
" এসব তুই কি বলছিস মা! তুই এই বাড়ি থেকে চলে যাবি কেন? এটা তো তোরই বাড়ি। তুই এখানে থাকবি না তো কে থাকবে!"
" যদি এটা আমারই বাড়ি হয় তাহলে.. কেন আমি একটুখানিও এই বাড়িতে স্বাধীনতা পাচ্ছি না। কেন আমাকে বারবার ওই রাতুল রাহমানকে বিয়ে করবার জন্য জোর করা হচ্ছে? আমি বারবার করে বলছি.. আমি বিবাহিতা, আয়ান মির্জা আমার স্বামী। সে গত ছয় মাস হলো, নিখোঁজ হয়েছে। তাই বলে কি সে আর ফিরে আসবে না। সে অবশ্যই ফিরে আসবে। নিজের প্রেমের টানে আবার ঠিক তার তৃষা সরকারের কাছে ফিরে আসবে।
তবুও কেন আমাকে এই বিয়েটা করার জন্য জোর করা হচ্ছে! কেন?"
" কেন.. কারণ,, আমরা আমাদের মেয়েটাকে একটু সুখী দেখতে চাই। তার ঠোঁটের কোণে একটুখানি হাসি দেখতে চাই। তার নারকীয় জীবনটা স্বর্গীয় করে তুলতে চাই।"
" কিন্তু মা.. আমি কি এসব কখনো তোমাদের কাছে চেয়েছি... যে তোমরা এভাবে উঠে পড়ে লেগেছ.. আমার বিয়ের জন্য। একজন মানুষ তো নিজের সৎ সন্তানের সাথেও এমনটা করে না.. যেটা তোমরা দু'জন আমার সাথে করছো! .... মা প্লিজ.. তোমরা আমাকে একটু শান্তি দাও! আমি তোমাদের কাছে হাতজোড় করছি। প্লিজ.....
*
" ছেড়ে দাও.. আমাকে ছেড়ে দাও। কেন তোমরা আমার সাথে এমন করছো বলো তো! প্রায় ছয়টা হয়ে গেল তোমরা আমাকে এখানে বন্দি করে রেখেছে! ওদিকে আমার তৃষা যে আমার জন্যে ওয়েট করছে। সে আজও আমার প্রতীক্ষায়। আমি ফিরবো বলে.. সে আজও আমার জন্য ওয়েট করছে। প্লিজ.. তোমরা আমাকে ছেড়ে দাও। প্লিজ..."
কুকড়াতে কুকড়াতে এক দমে কথাগুলো বলে উঠলো রশি দিয়ে বাঁধা একটা চেয়ারে বসে থাকা ছেলেটি। তার কথাগুলো শুনে তার আশেপাশে ফ্লোরে বসে থাকা লোকগুলো অট্টহাসিতে মেতে পড়লো। খানিকক্ষণ হাসার পর একটা লোক চাপা স্বরে বলে উঠলো.. " এই শোনো সবাই.. কি বলছে ও! ওর জন্য নাকি তৃষা আপা এখনো ওয়েট করছে। সে নাকি আজও তার প্রতীক্ষায়। আরে গর্দভ.. আগামী কাল রাত্রে তৃষা আপা আর রাতুল স্যারের বিয়ে। বিয়েটা অবশ্য খুব ধুমধাম করে হচ্ছে না কিছু সমস্যার কারণে! কিন্তু বিয়েটা হচ্ছে এটা সত্য। আর একটা ভেরি ভেরি ইম্পর্ট্যান্ট কথা, রাতুল স্যারকে কিন্তু নিজের বর হিসেবে তৃষা আপাই বেছে নিয়েছে। সে জানে, একমাত্র রাতুল স্যারের সাথেই সে খুব ভালো থাকবে। আর তুই কিনা বলছিস.. তৃষা আপা আজও তোর প্রতীক্ষায়।"
এই বলে লোকটা আবার অট্টহাসিতে মেতে পড়লো। সাথে বাকি লোকগুলোও অট্টহাসিতে মেতে পড়লো। তাদের অট্টহাসির মাঝেই ছেলেটা চিৎকার করে বলতে লাগলো.. " মিথ্যে.. সব মিথ্যে.. আমার তৃষা এই কাজ কোনোদিনও করতে পারে না। আমি তাকে খুব ভালো করেই চিনি। সে আর যাই করুক.. আমাকে, আর আমার ভালোবাসাকে সে কোনোদিনও ঠকাবে না। বুঝতে পেরেছো!"
হাসি থামিয়ে আরেকটা ছেলে বলে উঠলো.. " ও আচ্ছা.. তাই বুঝি।"
ছেলেটা আবার ফ্লোরে বসে থাকা ছেলেদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে কড়া গলায় বললো.. " হ্যাঁ তাই.. কোনো আপত্তি আছে তোমাদের।"
এবার সবগুলো লোকের মধ্যে যে লিডার সে বলতে লাগল.. " হুম আছে, অবশ্যই আছে। খুব বড় ধরনের একটা আপত্তি আছে। আচ্ছা মি. আয়ান মির্জা, একটা কথা.. তোকে আমরা কত ভয় দেখাচ্ছি.. কত মার মারছি.. সারাটা দিন চেয়ারের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখছি, রাত্রীবেলা বিছানা বালিশ ছাড়া ফ্লোরে শুতে দিচ্ছি,, তবু তোর শিক্ষা হচ্ছে না। তাও তুই তৃষা আপার কাছে ফিরে যেতে চাচ্ছিস! কিন্তু কেন?"
" সেটা আপনাকে কেন বলবো আমি!"
" আমাকে বলতে হবে না। যা বলার তুই সাহিদ স্যারকেই বলিস। উনি একটু আগে ফোন করেছিলেন... তিনি একটু পরই এখানে আসছেন। তুই এখন যত পারিস.. দোয়া-দরুদ পড়.. উনি যা রেগে রেগে কথাগুলো বলছিলেন.. আমার মনে হচ্ছে আজ তোর সাথে খুব খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে। তবে একটা কথা বিশ্বাস কর.. আমাদের তোর জন্যে খুব খারাপ লাগলেও কিছুই করার নেই.. বুঝেছিস। উই আর ভেরি সরি!
লিডারের কথাগুলো বলে আবার অট্টহাসিতে মেতে পড়লো। সাথে সাথে অন্য সবাই ও অট্টহাসিতে মেতে পড়লো।
To Be Continued............
জীবন সাথী (১)
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
188
Views
14
Likes
3
Comments
5.0
Rating