অপেক্ষার শেষ বিন্দু

অডিও মোড

00:00 00:00
গতি:
ভলিউম:
অপেক্ষার শেষবিন্দু

রাইমার ঘুম আসত না অনেক রাত পর্যন্ত। বিছানার এক কোণে গুটিসুটি মেরে পড়ে থাকত, চোখ থাকত ছাদের ফাঁকা জাগায়, যেন ঠিক সেই জায়গা থেকে প্রতিদিন একজন নামবে, ফিরে আসবে—তাহসিন।

চার বছর হয়ে গেছে। মানুষটা হঠাৎ করে চলে গেল। কোনো কিছু না বলে, না বোঝায়, এমনকি বিদায়টুকুও না জানিয়ে। শুধু একটা কাগজের টুকরো রেখে গিয়েছিল, খুব ছোট্ট:
“ভালো থেকো। আমি থাকলে তোমার জীবনে শুধু ছায়া নামবে।”

প্রথমে রাগ হয়েছিল রাইমার। যে মানুষটা প্রতিদিন কফির কাপের পাশে একটা চিঠি রাখত, তার এমন নীরব বিদায় মানা যায়? যে ভালোবাসত গভীরভাবে, চোখের ভাষায়, স্পর্শহীন আলিঙ্গনে—সে কীভাবে এইভাবে পালিয়ে গেল?

পরে রাগটা কষ্টে রূপ নিল, আর কষ্টটা অপেক্ষায়। রাইমা হয়তো জানত, তাহসিন কোনো দিন অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারবে না। কিন্তু সেটা সত্যি প্রমাণ করে কী হবে? সে তো ছিল না।

তবে জীবন থেমে থাকে না। রাইমা চাকরি পেল, নতুন শহরে গেল, নতুন মানুষদের মধ্যে হারিয়ে থাকার চেষ্টা করল। তবুও, সন্ধ্যায় যখন কেউ কফির মগ বাড়িয়ে দিত, মনের ভেতরে একটা গলা কেঁপে উঠত—“এটা তাহসিন না।”

একটা বিকেলে হঠাৎ পুরনো এক খামে একটা কবিতা পায় সে। সেই ছেঁড়া খামটা ছিল একটা পুরনো উপন্যাসের পাতায়। লেখা ছিল—

"তোমার হাসিতে বাসা বেঁধেছে আমার সকাল,
তোমার নীরবতায় হারিয়ে গেছে আমার দিন।
আমি ভালোবাসি, আজও—
শুধু পারিনি থাকতে তোমার পাশে, তোমার ছায়া হয়ে।”

চোখ বেয়ে অশ্রু নামে। সে জানে, তাহসিন ভুলে যায়নি। তাহলে কোথায় ছিল এতদিন?

পরদিন এক পোস্টম্যান আসে। তার হাতে একটা চিঠি, কোনো প্রেরকের নাম নেই। খোলার পর ভিতরে লেখা—

> “রাইমা,
আমি চলে গিয়েছিলাম কারণ আমার মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়েছিল। ওনার শেষ ইচ্ছা ছিল, আমি যেন সব দায়িত্ব কাঁধে নিই, সংসারের হাল ধরি। আমি জানতাম, তোমাকে সঙ্গে নিয়ে এই যুদ্ধে নামলে, হয়ত একসঙ্গে ভেঙে পড়ব। তাই তোমায় রক্ষা করতে চেয়েছিলাম—আমার জীবনের ছায়া থেকে।

আজ মা নেই। অনেক কিছু বদলে গেছে। কিন্তু যেটা বদলায়নি—তা হলো তোমার অপেক্ষা।

আমি ফিরছি রাইমা, যদি আজও অপেক্ষা করো।”



চিঠি ধরে কাঁপতে থাকে রাইমার হাত। সে জানে না, কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে। কিন্তু তার চোখে এখন কেবল একটাই ছবি—স্টেশন প্ল্যাটফর্মে তাহসিন দাঁড়িয়ে আছে, চোখে সেই পুরনো মায়া।

সন্ধ্যায় সে ছুটে যায় সেই পুরনো জায়গায়, যেখানে শেষবার তাহসিনের হাতটা ধরেছিল। আর সেখানে—দাঁড়িয়ে আছে সে। চার বছর পর, চোখে জল, মুখে একটা কাঁপা হাসি।

রাইমা এক পা, দুই পা এগিয়ে যায়… আর তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাহসিনের বুকে। কোনো কথা নেই, কোনো প্রশ্ন নেই, শুধু নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাস মিশে যাওয়া ভালোবাসার শব্দ—
"থেকে যাও এবার… চিরকাল।"

পাঠকদের উদ্দেশ্যে:

প্রতিটি সম্পর্কেই কিছু না বলা গল্প থাকে। কিছু না-বলা ভালোবাসা, কিছু অজানা ত্যাগ। আমরা অনেক সময় কেবল উপস্থিতিকে দেখি, কিন্তু অনুপস্থিতির পেছনের যুদ্ধটা বুঝতে পারি না।

“অপেক্ষার শেষবিন্দু” কেবল একটা ভালোবাসার গল্প নয়—এটা একজন মানুষের নীরব লড়াই, আরেকজনের নিরলস বিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি। কখনও কখনও ভালোবাসা মানে পাশে থাকা নয়, দূরে গিয়েও কাউকে রক্ষা করা। আর সবচেয়ে বড় কথা, যে ভালোবাসা সত্য, সে ফিরে আসে—হয়ত দেরি করে, কিন্তু ঠিক সময়মতো।

তাই, জীবনে যদি কাউকে ভালোবাসো—তাকে বোঝার চেষ্টা করো। প্রত্যেকের নিজস্ব যুদ্ধ থাকে। হয়ত সে তোমাকে ভালোবাসে ঠিকই, শুধু বলতে পারেনি।

ভালোবাসা যেন কেবল অনুভবেই আটকে না থাকে, ছুঁয়ে যাক দুটো প্রাণকে… চিরদিনের মতো।

66 Views
0 Likes
0 Comments
0.0 Rating
Rate this: