আঁধার রাতের গল্প

অডিও মোড

00:00 00:00
গতি:
ভলিউম:
⛔ মানুষ খেকো ঘর ⛔

১৯৯৯ সাল। বাগেরহাট জেলার চুলকাঠি গ্রামের কথা। জনমানববিচ্ছিন্ন এক প্রান্তিক এলাকা—বাঁশঝাড়ে ঘেরা, পিচঢালা রাস্তা পৌঁছায়নি, বিদ্যুৎ নেই, সন্ধ্যা নামলেই যেন এক অদৃশ্য অন্ধকার নেমে আসে। রাত হলেই গ্রামের মানুষ দরজা আটকে দেয়, আলো নিভিয়ে দেয়, যেন হাওয়ার ভিতরেই কিছু হেঁটে বেড়ায়—নিঃশব্দে, ক্ষুধার্ত অবস্থায়।

এই গ্রামের এক পাশে ছিল একটি কাঠের পুরনো ঘর। আর ঘরটিতে থাকত এক রহস্যময় পুরুষ—রতন বৈরাগী। গায়ে ফতুয়া, গলায় লাল তাবিজ, কপালে চন্দনের রেখা, আর চশমার নিচে হিংস্র দৃষ্টি। তবে যা বাইরে দেখা যেত, তার ভিতরটা ছিল আরও বেশি অন্ধকারে ঢাকা। কারণ রতন ছিল এক কালো জাদুর তান্ত্রিক।

রতনের বাড়ি থেকে প্রতিদিনই ধোঁয়া উঠত, কিন্তু রান্নার গন্ধ আসত না। রাতের বেলা অনেকেই শুনেছে সেখানে কাউকে কাঁদতে, আবার কাউকে হাসতে। কেউ দেখেছে সে রাত ৩টায় কাঁধে পুঁতির মালা নিয়ে শ্মশানে গিয়ে কিছুর সাথে কথা বলছে। কেউ বলে, ও নাকি কবর থেকে মৃতদেহ তুলে "ভোজ" দিত নিজের দেবতাকে।

এই ভয় আর সন্দেহের মাঝে গ্রামের একজন যুবক, নাসির উদ্দিন, হঠাৎ এক রাতে গলা চেপে মারা যায়। কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারে না। মৃতদেহ দেখে মনে হয়েছিল, যেন কেউ বুকের ওপর বসে ছিল। মৃত্যুর আগের দিন সে স্ত্রীর কানে বলেছিল—
"আমার ঘাড়ে বসে আছে রক্তমুখো একটা বস্তু... বলছে, রতন বলেছে তোকে নিয়ে যেতে।"

গোটা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে আগুনের মতো এই কথা। উত্তেজনা ছড়ায়। লোকজন জড়ো হয়ে রতনের ঘর ঘিরে ফেলে। পুলিশ আসে। তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। সরাসরি হত্যার প্রমাণ না থাকলেও গ্রামবাসীর চাপে তাকে দুমাস জেল দেয়া হয়।

কিন্তু রতন যখন ফিরে আসে... তখন সে আর আগের রতন ছিল না।

এবার তার মাথা ন্যাড়া, শরীরে খোঁচা খোঁচা ঘা, গলায় নতুন এক তাবিজ আর হাতে এক পুরনো তালপাতার বই। সে কারও সঙ্গে কথা বলে না। শুধু চেয়ে থাকে এক দৃষ্টিতে। এবং তারপরই ঘটল দ্বিতীয় মৃত্যু।

মোফাজ্জল হোসেন, যিনি একসময় রতনের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছিলেন, হঠাৎ একদিন চোখে অন্ধ হয়ে যান। তিন দিনের মাথায় তার গলায় পচন ধরে মারা যান তিনি। তার স্ত্রীর কথায়,
"ওর মুখ ঘুরে গিয়েছিল। পচে গেছিল। আমি লাশে হাত দিতে পারি নাই, যেই ছুঁয়েছি, হাত ফেটে গেছে।"

গ্রামের মানুষ নিশ্চিত হয়ে যায়—এই রতন ফের একবার কালো জাদুতে ফিরে এসেছে। এবার মানুষ চুপ থাকে না। এক রাতেই ৩০ জন যুবক রতনের ঘরে হানা দেয়। তাকে টেনে হিঁচড়ে বের করে এনে বেধড়ক মারধর করে। তার ঘর থেকে পাওয়া যায় এক বস্তা ভোঁতা ছুরি, রক্তমাখা কাপড়, পিশাচের মূর্তি, শুকনো হাড় আর একটা কাঠের বাক্স, যার ভিতরে লেখা ছিল—

“আমি যাকে ছুঁই, সে পঁচে যায়।”

রতন হাসপাতালে ভর্তি হয়। পাঁচ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে। কেউ আশা করেনি সে বাঁচবে। কিন্তু ছয়দিন পরে হঠাৎ সে উঠে বসে। তার চোখে লালচে জ্বালা, ঠোঁটে কাঁপন, আর কণ্ঠে একটাই বাক্য—
“তোমরা আমার শরীর ভেঙেছো। কিন্তু আমি আমার ঘরকে তন্ত্রময় করে দিয়ে এসেছি। এখন থেকে সেই ঘর আমার হয়ে যাবে। যে ওটাকে ভাঙবে, সে মারা যাবে। আমি দেখব...”

এর তিন সপ্তাহ পরে রতনের মৃত্যু হয়। কেউ জানে না কীভাবে। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলে—হার্ট অ্যাটাক। কিন্তু যারা দাফনে গিয়েছিল, তারা বলেছে লাশ নাকি নিজে থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছিল, চোখ খোলার চেষ্টা করছিল।

সেই ঘটনার পর রতনের ঘর ফাঁকা হয়ে পড়ে। কিন্তু তার সাথে আসল ঘটনা তখনো শুরু হয়নি।

প্রথমে যায় আবদুল লতিফ নামের একজন দিনমজুর। তাকে পাঠানো হয় ঘর ভাঙতে। দোতলার কাঠ নামাতে গিয়ে সে সিঁড়ি থেকে পড়ে যায়। তার ডান হাত ভেঙে যায়। হসপিটালে যাওয়ার আগে সে শুধু বলেছিল—
"আমি পেছনে কারো নিঃশ্বাস টের পেয়েছিলাম। তারপর দেখলাম... চোখ জ্বলে উঠেছে ঘরের।"

এরপর এক যুবক—আশিক মিয়া, খালি দরজা খুলেছিল। কিছুতেই সে বিশ্বাস করতো না এসব কথা। দরজা খুলেই সে খিঁচে পড়ে। দুদিন পরে মারা যায়। ডাক্তার বলেন—মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ। কিন্তু তার পেছনের লোকজন বলেছিল, ঘরের ভেতর থেকে একসাথে কয়েকটা শব্দ বের হয়েছিল—মানুষের না, জন্তুর না—কিন্তু ঘরের দেয়ালগুলো নাকি কাঁপছিল।

এরপর জব্বার মাস্টার, সাহস করে ঘরের একটা কাঠ নিয়ে রান্নাঘরের জন্য ব্যবহার করেন। তার স্ত্রী ছয়দিন জ্ঞান হারিয়ে ছিল। ঘরের ভিতর থেকে গন্ধ ছড়াতে শুরু করেছিল—কাঁচা মাংসের গন্ধ।

এই ঘটনার পর পুরো গ্রামে আতঙ্ক ছড়ায়। কেউ আর ঘরের দিকে চেয়ে থাকত না। বাচ্চাদের সেই রাস্তা দিয়ে যেতে দিত না মা-বাবারা। লোকজন বলত—ঘরের জানালায় নাকি রাত ২টার পরে আলো জ্বলে, আর কেউ কেউ ছাদে নাকি একটা ছায়া দেখতে পায়।

ঘরের ছাদে লাল রঙে লেখা পাওয়া যায় এক লাইন:

“আমি ফিরে আসব… আমার কামনা শেষ হয়নি…”

আজ ২০২৫ সাল। ২৬ বছর হয়ে গেছে রতন বৈরাগী মারা গেছে। কিন্তু চুলকাঠি গ্রামের সেই ঘর এখনো অক্ষত। মাঝে কয়েকবার চেষ্টা করা হয়েছে ভাঙার—প্রতিবারই কেউ না কেউ মরে গেছে বা উন্মাদ হয়েছে।

লোকজন এখন বলে—ঘরটা মানুষ খায় না, আত্মা খায়।

⛔ মানুষ খেকো ঘর ⛔ শুধু একটা ঘর নয়, একটা অশুভ শক্তির কেন্দ্র, এক জ্যান্ত অভিশাপ, যাকে কেউ আজও জয় করতে পারেনি। গ্রামের মানুষ ওকে ঘর বলে না—বলে, “ওটা রতনের শরীর... এখনো শ্বাস নিচ্ছে।”

এই গল্প বাস্তবের ছায়ায় তৈরি, কিন্তু ভয়টা অতিরিক্ত বাস্তব। কারণ কিছু ভয়... কল্পনার নয়।

বিঃদ্রঃ এখানে নাম বা সকল জায়গার নাম কল্পনার জগত থেকে নেওয়া
99 Views
0 Likes
1 Comments
5.0 Rating
Rate this: