আমার বিয়ের পরদিন সকালে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটলো।আমার শ্বাশুড়ি মা কোনো কিছু নিয়ে রাগ হয়ে তার বাবার বাড়ি চলে গেলেন।আমার শ্বশুড় এই নিয়ে খুব কথা শোনালো তাকে।রাগ অবশ্য আমারও হয়েছিল খানিকটা।বউ ভাতের অনুষ্ঠান।ছেলের মা বাড়িতে নেই।বিষয়টা কেমন দৃষ্টিকটু না?
পরে অবশ্য মা ফিরে এসেছিল।দুপুরের আগেই হাতের ব্যাগটা শক্ত করে খাঁমচে ধরে মা আবারো এই বাড়ির চৌকাঠে এসে দাঁড়িয়েছিলেন।আমি সেদিন ফ্যালফ্যাল করে তার দুই চোখ দেখলাম।এতো ফ্যাকাশে কোনো মানুষের চোখ হতে পারে?
মা আসতেই বাবা বললেন,'এ্যাই নিলু! রান্নাঘরে যাও তো।গিয়ে দেখো সব হলো নাকি।'
মা রোবটের মতো হেঁটে রান্নাঘরে চলে গেলেন।আমার মন চাইল জিজ্ঞেস করতে,'মা আপনার কি মন খারাপ?'
পরে অবশ্য আর জিজ্ঞেস করা হয়নি।আমি নতুন বউ।পারিবারিক ভাবেই আসিফের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে।বিয়ের পরেই সবকিছুতে এতো আগ্রহ দেখানো আমার সমীচীন মনে হয় নি।
আসিফের পোস্টিং ছিলো যশোরে।আমরা থাকতাম রাজশাহী।বিশাল দূরত্ব।যাওয়া আসাতেই অনেকটা সময় লেগে যেত।বিয়ের পর সপ্তাহ খানেকের মতো আমরা রাজশাহী ছিলাম।তারপরই দু'জন চলে এলাম যশোরে,দুই রুমের একটি ছোট্ট বাসায়।বাসাটা আসিফই বিয়ের একমাস আগে ঠিক করেছিল।
আমাদের সংসার ভালোই যাচ্ছিলো।আসিফ পেশায় ডাক্তার।প্রচুর ব্যস্ততায় দিন যায় তার।বাড়ি ফিরতে ফিরতে মাঝে মধ্যে বেশ রাত হয়।সে বাড়ি ফিরলেই আমি খেতে বসতাম।আমরা দু'জন রাত করে আড্ডা দিতাম।দু'জনের সংসার অনেকটা বাবুই পাখির সংসারের মতো কাটছিলো।
আমি প্রায়ই আমার বাড়িতে ফোন দিতাম।আম্মু আব্বুর সাথে বেশ সময় নিয়ে কথা হতো।আসিফ মহা ব্যস্ত মানুষ।বাড়িতে ফোন দেওয়ার সময় তার হতো না।তার বড় ভাই মানে আমার ভাসুর কানাডায় স্যাটেল।তার স্ত্রী,দুই সন্তানসহ সে আলবার্টায় থাকে।দেশে ফোন দেওয়ার মতো সময় আরিফ ভাইয়ার কখনই হয়ে উঠে না।আমার বিয়েতেও সে আসেনি।আসিফের কাছ থেকে শুনতে পেয়েছিলাম,এই কথা জানার পর নাকি আমার শ্বাশুড়ি খুব কান্না করেছিলেন।
যাই হোক।জীবন চলছিল জীবনের মতো।বছর যেতেই আমাদের ঘরে সুখবর এলো।আমি যেদিন মাকে ফোন দিয়ে সেই কথা জানাই,মা শুনতে পেয়েই বাচ্চাদের মতো কেঁদে দিলেন।খুব জোরাজুরি করছিলেন রাজশাহী চলে আসার জন্য।
আমার তখন দুর্বল শরীর।রান্নাঘরে গেলেই মাথা ঘুরতো।কোনো কাজ ঠিক মতো করতে পারতাম না।আসিফকে বললাম,'আমাকে তোমার মায়ের কাছেই রেখে আসো আসিফ।আমি আর পারছি না একা একা সব সামলাতে।'
আমরা রাজশাহী ফিরে গেলাম পরের সপ্তাহেই।সদর দরজায় আমাদের দু'জনকে দেখে মার সেকি আনন্দ! মনে হলো আমরা আসাতে তিনি আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছেন।
সেদিন মা খুব খাতির যত্ন করল আমাদের।আসিফ বেশিদিনের ছুটি আনেনি।সে চলে গেল পরদিন সকালে।ঘরে রইলাম কেবল আমি,মা আর বাবা।আসিফের একজন বড় বোন আছে।তিনি স্বামী সন্তান নিয়ে ঢাকায় থাকেন।দুই বছরেও তার এই বাড়িতে আসার সুযোগ হয় না।
আমি দিনের বেশিরভাগ সময় আমার ঘরেই কাটাতাম।ঘর মোছা আর কাপড় ধোয়ার কাজ রাফিয়া খালাই করতো।আর রান্না সব মা নিজের হাতেই করতো।আমাকে সত্যি বলতে তেমন কিছুই করা লাগতো না।
আমি বেশ কিছুদিন যাবত লক্ষ্য করছি মা প্রায়ই আমার দরজার সামনে এসে দাঁড়ান।ভেতরে আসেন না।তবে উঁকি দিয়ে কিছুক্ষণ দেখে তারপর আবার চলে যান।আমি নিজেও সংকোচে তাকে কিছু বলতাম না।একদিন অবশ্য জিজ্ঞেস করেছিলাম,'মা! কিছু বলবেন?'
ওমনি মা ঘরে চলে এলো।প্রথমে কিছুটা ইতস্তত করছিলো।শেষে সমস্ত জড়তা দূরে ঠেলে বলল,'শাম্মি! তুমি কি অবসর?আমার সাথে একটু কথা বলবে?'
আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম,'এমন করে কেন বলছেন মা?অবশ্যই কথা বলব।বসুন আপনি।'
মা সেদিন সত্যি সত্যি আমার সাথে লম্বা সময় কথা বললেন।আমি ধৈর্যশীল শ্রোতার মতো পুরোটা শুনলাম।মনে হলো মা তার জীবনে অনেক গুলো বছর প্রাণ খুলে কথা বলেনি।অন্যভাবে বলতে গেলে কেউ তাকে সেভাবে প্রাণ খুলে কথা বলার অনুমতিই দেয়নি।
এরপর থেকে মা রোজ রোজ আমার ঘরে আসতেন।কখনো আমার মাথায় বিলি কাটতে কাটতে গল্প করতেন,কখনো বা মাথায় তেল দিতে দিতে গল্প করতেন।কখনো আবার আমার এলোমেলো কাপড় গুলো কথার ফাঁকেই ভাঁজ করে দিতেন।তার জীবনের নানারকম গল্প শুনে কখনো আমরা খিলখিল করে হাসতাম।কখনো আবার অদ্ভুত বিষন্নতা আমাদের আচ্ছন্ন করে রাখতো।
আমি প্রতিদিন একটু একটু করে নিলুফা নামের সেই চমৎকার মানুষটিকে চিনতে পারছিলাম।যার ভেতর হাজার হাজার বাক্য,হাজার হাজার অনুভূতি জমা হচ্ছিল,অথচ প্রকাশ করার মানুষের অভাবে সেই অনুভূতিগুলো প্রতিনিয়ত পি/ষ্টন হচ্ছিল।
মা কে দেখতাম প্রায়ই অন্যমনস্ক হয়ে কিছু ভাবতো।পরে ধীরে ধীরে বুঝেছিলাম মা তার সন্তানদের মিস করতো,তাদের কথা তার খুব মনে পড়তো।বাড়ির কালো রঙের টেলিফোনের সামনে মা ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতো একটা ফোন কলের আশায়।অথচ কানাডায় থাকা সেই ব্যস্ত ছেলের সময় হতো না চব্বিশ ঘন্টার মাঝে পাঁচ মিনিট বাঁচিয়ে মাকে ফোন দেওয়ার।
আমি খেয়াল করলাম বাড়িতে মায়ের তেমন গ্রহণযোগ্যতা নেই।সবার তার প্রতি আচরণ দেখে মনে হতো রসাইঘর সামলানো বাদে মায়ের আর কোনো কিছুতেই হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই।বাবাও গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ে মায়ের মতামত নিতেন না।আমি ব্যাপারটার গভীরে যেতেই বুঝলাম মায়ের শিক্ষাগত যোগ্যতায় সামান্য পিছিয়ে থাকাই বাড়িতে তার অবহেলার প্রধান এবং একমাত্র কারণ।
মা ছিলেন একেবারে নীল পদ্মের মতো কোমল এবং স্নিগ্ধ।অথচ সন্তানদের অবহেলায়,স্বামীর ভৎসনায় মা কেমন ক্ষয়ে যাচ্ছিলেন একটু একটু করে।অথচ এই চমৎকার মানুষটিকে আমি ততোদিনে বাড়াবাড়ি রকমের ভালোবেসে ফেলেছি।মা ছাড়া তখন আমি এক মুহূর্তও থাকতে পারতাম না।বাড়ি থেকে ফোন করে বলল,আমি যেন শেষের দুই মাস সেখানেই থাকি।আমি জেদ ধরলাম।বিরোধ করে বললাম,আমি আমার শ্বশুড়বাড়িতে আমার শ্বাশুড়ির কাছেই থাকবো।
মা সেদিন ভেজা চোখে আমায় কতোক্ষণ দেখলেন।শেষে জড়ানো কন্ঠে বললেন,'তুমি খুব লক্ষী মেয়ে শাম্মি।বাবু হওয়ার পর তুমি চলে গেলে আমার ভীষণ কষ্ট হবে।আমি বোধহয় সঙ্গীর অভাবে ম'রেই যাবো।'
আমি সে কথা গায়ে মাখি নি।আমার মনে তখন অন্য পরিকল্পনা চলছে।এক বিকেলে মা কে বললাম,'মা তাড়াতাড়ি রেডি হন তো।আমাদের দশ মিনিটেই বের হতে হবে।' মা অবাক হয়ে জানতে চাইলেন,'সেকি! কোথায় যাবো আমরা?'
আমি সে কথা শুনিনি।কেবল নীল পাড়ের একটা সুতির শাড়ি পরিয়ে মাকে নিয়ে এক প্রকার ছুটতে ছুটতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম।মা হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন,'সেকি! তুমি বাচ্চা মানুষ।তুমি শাড়ি না পরে আমায় পরিয়েছো কেন?'
আমি সে কথারও উত্তর দেইনি।কেবল তার হাত টা শক্ত করে চেপে ধরে গলির মোড়ে একটা রিকশা নিয়েছিলাম।মা বলেছিলো তার নাকি রিকশায় করে শহর ঘুরতে ভালো লাগে,সেই সাথে মাথায় গাজরা গুঁজে একাকী রাস্তায় কারো হাত ধরে হাঁটতে ভালো লাগে।আমার শ্বশুর মশাই তার স্বল্প শিক্ষিত স্ত্রীর জন্য ঐটুকু সময় খরচা করতে অপরাগ করলেন।আমি ভেবে নিয়েছিলাম নিলুফা ইয়াসমিনের সেই ছোট্ট স্বপ্ন টুকু আমিই পূরণ করবো।
রিকশায় উঠার পর মা কিছুক্ষণ অভিভূত হয়ে রাস্তাঘাট দেখলেন।শহরের অলিগলি দিয়ে লাল রঙের রিকশাটা একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছিল।মা বাচ্চাদের মতো ঠোঁট ভেঙে বললেন,'তুমি এতো ভালো কেন শাম্মি?'
আমি সেই কথার জবাবে কেবল একগাল হাসলাম।ফুলের দোকান থেকে একটা সুন্দর গাজরা কিনে তার খোঁপায় গুজে দিয়ে বললাম,'আমি খুব সাধারণ মা।আপনি অসাধারণ বলেই সবাইকে আপনার অসাধারণ লাগে।'
সেদিন আমরা দীর্ঘসময় হাতে হাত রেখে পার্কের মেটে রাস্তায় হাঁটলাম।মা দুঃখ করে বলল আসিফ হওয়ার পর তিনি তার অন্য নাম রাখতে চেয়েছিলেন,কিন্তু বাবা রাখতে দেয় নি।আমি সেদিনই সিদ্ধান্ত নিলাম আমার বাচ্চা হলে তার নাম মা ই রাখবে।
যথাসময়ে আমার আর আসিফের ঘর আলো করে একটি কন্যা সন্তান পৃথিবীতে এলো।তার দিদুমণি ভালোবেসে তার নাম রাখলো চিত্রলেখা।এতো সুন্দর নাম আমি এর আগে শুনিনি।
চিত্র হওয়ার পর আমার যশোরে ফেরার দিন ঘনিয়ে এলো।মায়ের মুখ সময়ের সাথে সাথে বিষন্ন থেকে বিষন্নতর হতে লাগলো।আমি আসিফ কে অনুরোধ করলাম এবার যেন আমরা মা আর বাবা দু'জনকে নিয়েই শহরে ফিরি।অর্থবিত্ত তো আমাদের ভালোই আছে।একটা বড় বাড়ি ভাড়া নিলে মন্দ হয় না।
মা প্রস্তাব শুনতেই শুরুতে না করে দিলেন।অথচ কয়েকবার অনুরোধ করতেই কেমন নরম হয়ে গেলেন।কেবল কন্ঠ নামিয়ে বললেন,'তোমার বাবাকে রাজি করাতে পারো নাকি দেখো।'
বাবাকে রাজি করাতে আমাদের বেশ বেগ পোহাতে হলো।অবশেষে অনেক অনুনয়ের পর তিনি আমাদের সাথে যেতে রাজি হলেন।দুই সপ্তাহ রাজশাহী থাকার পরেই আমরা গাড়িভর্তি লাগেজ নিয়ে যশোরের রাস্তায় রওয়ানা দিলাম।
আমি ইদানীং লক্ষ্য করছি মায়ের গায়ের রংটা কেমন আগের চেয়ে উজ্জ্বল হয়ে গেছে।তার চোখে মুখে আগে যেই নিদারুণ ক্লান্তি ভাব দেখা যেত,সেটাও গায়েব।তাকে দেখলে মনে হয় তার বয়স দশ বছরের মতো কমে গেছে।
আমরা যশোরে এসেছি একমাসের মতো হয়েছে।মা এখানে আসার পর থেকেই প্রবল উৎসাহে একটার পর একটা কাজ করে যাচ্ছেন।চিত্রলেখার সমস্ত যত্ন তার দিদুমণিই করে থাকে।কেবল ঘুমানোর সময় আর খাওযার সময় সে তার মায়ের কাছে আসে।নয়তো পুরোদিন সে তার দিদুমণি আর দাদাভাইয়ের কাছেই থাকে।আমি আর মা রোজ বিকেলে নিয়ম করে ঘন্টাখানেকের মতো ছাদে আড্ডা দেই।
নয়নতারা মায়ের প্রিয় ফুল।আমাদের ছাদে একটা নয়নতারা গাছ আছে।সেখান থেকে মাঝে মাঝে হালকা বেগুনি রঙের নয়নতারা ফুল ঝরে পড়ে।আমি অতি সন্তর্পণে সেই ফুল মায়ের খোঁপার ভাঁজে গুজে দেই।মা কখনো প্রাণ খুলে হাসেন,কখনো আবার আবেগ আপ্লুত হয়ে অন্যমনস্ক হয়ে যান।আমি দুই চোখ মেলে সেই মমতাময়ীর স্বরূপ দেখি।কি আশ্চর্য! আমাদের মন ভালো থাকলে কি আমাদের বয়স কমে যায় নাকি?
******সমাপ্ত*****
নীলপদ্ম
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
85
Views
0
Likes
0
Comments
0.0
Rating