গ্রাম চর জাঙ্গালিয়া অজানা ইতিহাস

অডিও মোড

00:00 00:00
গতি:
ভলিউম:
চর জাঙ্গালিয়ার আলোছায়া
লক্ষ্মীপুর জেলার মেঘনার কোল ঘেঁষে এক নিবিড় গ্রাম, নাম তার চর জাঙ্গালিয়া। এখানে প্রকৃতি যেন নিজ হাতে আঁকড়ে রেখেছে গ্রামীণ জীবনের প্রতিটি ধ্বনি, প্রতিটি শ্বাস।

সকাল বেলার প্রথম আলো যখন কচি পাতার ফাঁক দিয়ে ঝরে পড়ে, তখন পাখির কলকাকলিতে চারপাশ ভরে ওঠে। আমজাদিয়া রোড ধরে যেতেই দেখা মেলে নারকেল গাছের সারি, যার নিচ দিয়ে ছোট্ট খালটি কাঁচের মতো স্বচ্ছ জলে বয়ে যায়। এই খালের দুই পাড়ে কৃষকদের চাষাবাদের প্রাণচঞ্চল দৃশ্য, আর তাদের সঙ্গেই ছড়িয়ে আছে জীবনের সংগ্রামের গল্প।

দক্ষিণে আল বারাকা নূরানী মাদ্রাসার পাশে দাঁড়িয়ে আছে ছফর আলী মাঝি বাড়ি। ছফর আলী, যিনি এই গ্রামের এক সময়কার আলোচিত মানুষ ছিলেন, তার কাহিনী যেন এখনো বাতাসে ভেসে বেড়ায়। তার বাড়ির পাশেই ছিল সুলতানিয়া রোড, যেখানে বিকেলের সূর্য অস্ত যাওয়ার মুহূর্তে গ্রামের ছেলে মেয়েরা জমায়েত হতো।

ইতিহাস ও সংস্কৃতির মিশেলে গড়ে ওঠা এই গ্রামটি যেন জীবনের এক পরিপূর্ণ চিত্র কলা। কিন্তু মেঘনার স্রোত সবসময় শুভ ছিল না। এর ক্ষুধার্ত ঢেউয়ের কারণে অনেক পরিবার তাদের ভিটে মাটি হারিয়েছে। তবুও, এখানকার মানুষের মনোবল অটুট—প্রকৃতির প্রতিকূলতার মধ্যেও তারা তাদের অস্তিত্ব রক্ষা করে চলেছে। শেষ বিদায়😭

ওসমান গনি ছিলেন একজন পরিশ্রমী ও ধার্মিক মানুষ। তিনি হরামগঞ্জের পশ্চিমে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তবে জীবিকার তাগিদে তিনি তাঁর পরিবার নিয়ে চর জাঙ্গালিয়ায় চলে আসেন। এখানে এসে তিনি গ্রামের মানুষের সঙ্গে মিশে গেলেন এবং তাদের ধর্মীয় পথে পরিচালিত করার চেষ্টা করলেন। প্রতিদিন মসজিদে যেতেন, কোরআন তেলাওয়াত করতেন এবং সবসময় আল্লাহর পথে চলার উপদেশ দিতেন।

হাজিরহাট বাজারের পাশে লতি মুন্সির বাড়ি ছিল। তখন আশপাশে আর কোনো বাড়ি ছিল না। তখন এই এলাকা খালি জায়গায় ভরপুর ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ আসতে শুরু করল এবং বসতি গড়ে উঠল। চর জাঙ্গালিয়ায় গ্রামে প্রথম বাড়ি ছিল ছফর আলী মাঝি বাড়ি। তারপর লতি মুন্সির বাড়ি, হাজী বাড়ি, মিয়া বাড়ি, বারো মাঝির টেকের বড় বাড়ি, সুলতান দরবেশ বাড়ি, রাজা মিয়াগো বাড়ি, আলী মিয়ার বাড়ি, সানাউল্লাহ নূরী সাহেবের বাড়ি এবং আরও অনেক বাড়ি গড়ে উঠল।

সানাউল্লাহ নূরী ছিলেন ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা একজন সাংবাদিক, যিনি অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এছাড়াও এখানে অনেক খালি জায়গা ছিল আশপাশে, কিন্তু আস্তে আস্তে গ্রামের বসতির সংখ্যা বাড়তে শুরু করল। এখন চর জাঙ্গালিয়া একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রামে পরিণত হয়েছে।

এই গ্রামে পাঁচটি মসজিদ রয়েছে, যার মধ্যে আমজাদিয়া মসজিদ ছিল সর্বপ্রথম। এটি গ্রামবাসীর জন্য একটি পবিত্র স্থান হিসেবে পরিচিত। এখানে নিয়মিত নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। আমজাদিয়া মসজিদই ছিল সেই মসজিদ, যেখানে প্রথমে গ্রাম বাসীরা একত্রিত হয়ে ধর্মীয় কাজকর্ম শুরু করেছিল। পরে আরও মসজিদ গড়ে উঠলেও আমজাদিয়া মসজিদ ছিল প্রধান মসজিদ।

এছাড়াও, চর জাঙ্গালিয়া গ্রামে দুটি প্রধান রাস্তা ছিল, যা গ্রাম জীবনের কেন্দ্র বিন্দু হয়ে উঠেছিল। প্রথম রাস্তার নাম ছিল আমজাদিয়া রোড এবং দ্বিতীয়টি ছিল সুলতানিয়া রোড। এই রাস্তা দুটো ছিল গ্রামের ব্যবসা-বাণিজ্য, মসজিদে নামাজ পড়া, এবং স্কুল-কলেজে যাওয়ার মূল কেন্দ্র।

বয়স বাড়ে, শরীর দুর্বল হয়, তবে সে আল্লাহর পথে চলতে থাকে।

একদিন তাঁর পুত্র সফর আলী এসে বলল,
“বাবা, আপনি তো সব সময় আখেরাতের কথা বলেন,
কিন্তু আমরা কিভাবে সে পথে চলব?
আমরা কি সঠিক পথে চলতে পারব?”

ওসমান গনি পুত্রের প্রশ্ন শুনে শান্তভাবে বললেন,
“এ দুনিয়াতে যতই অর্জন করো না কেন,
মৃত্যুর পর কিছুই সঙ্গে নেয়া যাবে না।
তবে আল্লাহর পথে চললে মুক্তি আসবে।
যতই ধন-সম্পদ জমাও না কেন,
সব কিছু একদিন তোমাকে ছেড়ে যেতে হবে।
তবে আখেরাতের দিকে নজর দাও, শান্তি পাবে।
তাহলেই জান্নাতের পথ তোমার জন্য খোলা।”

রাতে অসুস্থ হয়ে পড়লেন তিনি।
সফর আলী এসে পাশে দাঁড়াল।
পিতার মুখে শান্তি ছিল।
“কাঁদো না, হাসি মুখে বিদায় দাও।”

ওসমান গনি শান্তি নিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।😭
কিন্তু তাঁর শিক্ষা সবার মনে রয়ে গেল।
সফর আলী বুঝতে পারল, আসল জীবন কিসে।
আল্লাহর পথে চললে মুক্তি পাওয়া যাবে।

সে প্রতিজ্ঞা করল,
পিতার পথ অনুসরণ করবে।
আল্লাহর কাছে মনের শান্তি চাইবে।
এবং জান্নাতের পথে যাবে।

তিন ছেলে ছিল সফর আলীর—
বড় ছেলে আব্দুর রাজ্জাক,
দ্বিতীয় ছেলে আব্দুল মান্নান, যাকে সবাই ‘মনু মাঝি’ নামে চিনত,
আর ছোট ছেলে তবু উল্লাহ, যিনি কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
বড় ছেলে এবং ছোট ছেলে কৃষি কাজে ব্যস্ত থাকলেও,
দ্বিতীয় ছেলে নৌকার মাঝি হিসেবে সারা গ্রামে পরিচিত ছিল।
গ্রামের মানুষের কাছে সফর আলী মাঝি বাড়ি এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এটি শুধু একটি বাড়ি নয়, বরং গ্রামজীবনের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত এক কেন্দ্র, যেখানে প্রতিটি মানুষের জীবনের সুখ-দুঃখের গল্প জড়িত। গ্রামবাসী এখানে আসে পোলিও খাওয়ানোর জন্য, স্বাস্থ্যসেবা এবং সুরক্ষা পেতে, যা এই বাড়ির গুরুত্ব বাড়িয়ে তোলে।

টিকে কেন্দ্র হিসেবে সফর আলী মাঝি বাড়ির অবদান অমূল্য। এই বাড়ি শুধুমাত্র একটি বাড়ি নয়, বরং এক ধরনের আশ্রয়স্থল, যেখানে গ্রামের মানুষ নিজেদের সমস্যা ও সুখ-দুঃখ নিয়ে আসে, এবং এখানে তা মীমাংসিত হয়। বাড়িটির নাম গ্রামের মানুষের কাছে গর্ব এবং বিশ্বাসের প্রতীক।

এখানে প্রতিটি কোণে ইতিহাসের ছোঁয়া, যা গ্রামের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির এক অমূল্য অংশ। এই বাড়ি গ্রামবাসীর জীবনে শুধু শারীরিক সুস্থতার ক্ষেত্রেই নয়, মানসিক ও সামাজিক শান্তিরও উৎস। সফর আলী মাঝি বাড়ি গ্রামে এক অমূল্য ধন, যেখানে সবাই একত্রিত হয়, একে অপরকে সাহায্য করে এবং নিজেদের জীবনকে সমৃদ্ধ করে।

এটি যেন গ্রামের আত্মা, যার সঙ্গে যুক্ত সকলেই একেবারে অপরিহার্য।
দুইশো বছর পরে কে থাকবে ঘরে,
কেউ জানে না ভাই, এ প্রশ্ন বড়।
এই উঠোন, গাছের ছায়া,
থাকবে শুধু স্মৃতির মায়া।

আমার দাদার দাদার কবর,
কোথায় যেন হারিয়ে গেল।
আমার কবর হারিয়ে যাবে,
মাটির নিচে শুয়ে থাকবে।

যে ধন-সম্পদ করলাম জমা,
থাকবে পরে মিছে মায়া।
সুদ-ঘুষে গড়া পাহাড়,
সবই হবে শেষ, কিছুই থাকবে না হাতে।

আসুন সবাই মিলে পথ ধরি,
সত্যের আলোয় জীবন গড়ি।
এই জীবন শেষে রবে আলো,
শেষে পাবো শান্তি, চিরকাল ভালো।

এক নজরে চর জাঙ্গালিয়া ইউনিয়ন

ক)ইউনিয়ন গঠনের ইতিকথাঃ


৭ নং হাজির হাট ইউনিয়ন এর মূল ভূখন্ড ১৮৫৪ইং সালে মেঘনার বুকে জেগে উঠে। জনৈক ইংরেজ পর্যটক অসংখ্য বাজপাখি উড়তে দেখে ১৮৮৮ ইং সালে চরটি চর জাঙ্গালিয়া নামে নামকরণ করেন। পরবর্তিতে ১৮৮৯ ইং সালে চর জাঙ্গালিয়া নামে একটি মৌজা গেজেটভুক্ত করা হয়। ১৯০৩-১৯০৫ইং সালে ডিস্ট্রিক্ট স্যাটেলম্যান্ট ডি এস জরিপে চর জাঙ্গালিয়া মৌজাটি বাকেরগঞ্জ জেলার ভোলা থানার অধীনে রেকর্ডভূক্ত হয়। নতুন এই চরে মেঘনা ও ভুলুয়া নদীর ভাঙ্গনে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাকের গন্জ (বরিশাল ) জেলার দৌলতখান থানা ও তৎকালীন শাহবাজপুরের (ভোলা ) এবং নোয়াখালীর জেলার লক্ষ্মীপুর থানাধীন ফরাশগন্জ,( হরামগঞ্জ) কুশাখালী থেকে আসা কিছু পরিবার কৃষিকাজ ও বসতিস্থাপন করে। ১৯১০ সালে নোয়াখালী জেলার উত্তর হাতিয়া, ১৯১৫ সালে থাক সার্ভে তৎকালিন বাকেরগঞ্জ ( বরিশাল ) জেলাধীন দৌলতখান থানা এবং ১৯১৭ সালে রামগতি থানার অধীনে চর জাঙ্গালিয়া মৌজা গেজেটভূক্ত করা হয়।


শেষে কথা

এই গল্পটি লেখা হয়েছে লক্ষ্মীপুর জেলার কমলনগর উপজেলার
৭ নং হাজিরা ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ড,
চর জাঙ্গালিয়া গ্রামের ছফর আলী মাঝি বাড়ির
ওসমান গনিকে নিয়ে।
গল্পটি আজ থেকে আড়াইশো বছর আগের
একটি ঐতিহাসিক কাহিনী থেকে নেওয়া।
322 Views
3 Likes
1 Comments
3.0 Rating
Rate this: