এলাকা থেকে দূরে এক পুরানো জমিদার বাড়ি ছিল। সেদিকে কেউ পা রাখত না, কারণ সবাই জানত—বাড়ির মধ্যে কিছু অশুভ শক্তি বাস করছে। পুরানো গল্প শুনতাম, রাতের অন্ধকারে ওই বাড়ি থেকে কাঁপানো আওয়াজ শোনা যেত, এবং অনেকেই বলত, যারা ওই বাড়ির কাছে গিয়েছিল, তারা আর ফিরে আসেনি।
অথচ একদিন এক যুবক, সোহেল, শহরের নতুন বাসিন্দা হিসেবে বাড়ির পাশ দিয়ে হাঁটছিল। সোহেল ছিল একেবারে সাহসী, তার মনে ছিল এক অদ্ভুত আকর্ষণ। এমন এক বাড়ির প্রতি, যেটি কাউকেই কাছে আসতে দেয় না। সে সিদ্ধান্ত নিল, সে ওই বাড়ির ভিতরে যাবে, এবং সে এক রহস্য সমাধান করবে।
সোহেল জানত, তার এই সাহসী অভিযান অনেক বিপদে ফেলতে পারে, কিন্তু সে কোনো ভয় পায়নি। তার সঙ্গে ছিল রিমি, তার প্রিয় বন্ধু, যে ছিল খুবই যত্নশীল এবং সোহেলের বিপদ সম্পর্কে সবসময় চিন্তিত। রিমি কখনোই চাইত না সোহেল ওই বাড়ির দিকে যেতে, তবে সোহেল তাকে সঙ্গী হিসেবে চেয়েছিল। রিমি সোহেলের প্রতি অদৃশ্য এক টান অনুভব করত, যা তাকে তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কিছু বলার সুযোগ দেয়নি।
রাতে, যখন পুরো শহর নিস্তব্ধ ছিল, সোহেল এবং রিমি জমিদার বাড়ির দিকে রওনা হল। তাদের পা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির উপরিভাগ থেকে হালকা এক অদ্ভুত শীতলতা আসতে শুরু করল। এক মুহূর্তে তারা দুজনেই অনুভব করল, তাদের চারপাশে কোনো অদৃশ্য শক্তি ঘোরাফেরা করছে। বাড়ির দরজাটি খোলামেলা ছিল, যেন তাদের স্বাগত জানানো হচ্ছে।
এই ছিল তাদের প্রথম সন্ধান—অন্ধকারের ডাক, যা তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় ভয়ের যাত্রা শুরু করল।
জমিদার বাড়ির দরজা খোলামেলা ছিল, সোহেল এবং রিমি মনের অজান্তেই একটু পিছু হটে গিয়েছিল। কিন্তু সোহেল অবশেষে শক্ত মনোবলে দাঁড়িয়ে বলল, "আমরা এখানে এসেছি, রিমি, ভয় পাওয়ার কিছু নেই।"
রিমি কিছুটা অনিচ্ছা নিয়ে সোহেলের দিকে তাকাল। "কিন্তু সোহেল, তুমি কি জানো এই বাড়ির ইতিহাস? এখানে যাদের মৃত্যু হয়েছে, তাদের আত্মা হয়তো এখনও বেঁচে রয়েছে।"
সোহেল হেসে বলল, "এটা শুধুই গল্প। বাস্তবে এসব কিছুই নেই।"
এভাবে সাহসী হয়ে তারা দুজনে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করল। ভিতরে ঢুকতেই সর্দি খাওয়া এক ঠাণ্ডা বাতাস তাদের মুখে এসে লাগল। চারপাশে অসংখ্য পুরনো ছবি, ফার্নিচার এবং ধুলো জমে থাকা সিলিং ছিল। রিমি চোখে চোখ রেখে সোহেলকে বলল, "এটা ঠিক নয়, সোহেল। আমি কিছু অদ্ভুত অনুভব করছি।"
তারা একটি হলরুমে পৌঁছাল, যেখানে একটি পুরানো আয়না ঝুলছিল। আচমকা, সেই আয়নায় কিছুটা নড়াচড়া দেখা গেল। রিমি ভয়ে সোহেলের হাত ধরল। "সোহেল, দেখছো! কেউ এখানে আছে!"
হঠাৎ আয়নার মধ্যে একটি অদ্ভুত মুছে যাওয়া মুখ ফুটে উঠল—একটি মহিলা মুখ, যার চোখ দুটি গভীর অন্ধকারে ভরা। সোহেল চোখ চেপে ধরল, কিন্তু কিছুই না দেখে ফিরে গেল। "আমরা ভুল দেখেছি।"
কিন্তু রিমি কিছুটা আঁতকে উঠল। "না, সোহেল, এটা শুধু আমাদের ভুল নয়। এখানে কিছু ঠিক নয়।"
ওই মুহূর্তে, বাড়ির মধ্যে থেকে খসখস শব্দ শুনে তারা ঘাবড়ে গেল। সোহেল বলল, "শোনা যাচ্ছে, কেউ বাড়ির ভিতরে হাঁটছে!"
তারা একে অপরকে দেখে নীরবে এগিয়ে যেতে শুরু করল, তবে প্রতিটি পদক্ষেপে তাদের মনে হচ্ছিল যেন কিছু অদৃশ্য চোখ তাদের অনুসরণ করছে।
অন্ধকারে ঘুরতে ঘুরতে, সোহেল আর রিমি একটি পুরানো জানালা খুঁজে পেল। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে তারা দেখতে পেল, বাড়ির পেছনে একটা অন্ধকার বাগান রয়েছে। তবে, কিছু ছিল যা তাদের মনের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল—বাগানে দাঁড়ানো এক মহিলা অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখা গিয়েছিল।
"এটা কি ছিল?" রিমি শ্বাস টেনে জিজ্ঞেস করল।
সোহেল কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তখনই হঠাৎ তার শরীরে এক তীব্র শক অনুভূত হল। সে চমকে উঠে পিছনে তাকিয়ে দেখল, তার পিঠে কিছু তীক্ষ্ণ অনুভূতি হচ্ছিল। রিমি হতবাক হয়ে সোহেলের দিকে তাকাল। "তুমি... তুমি কী?"
সোহেল পেছনে হাত রেখে দেখতে পেল, তার পিঠে কিছু রক্তের দাগ। কিছু খোঁচানোর মতো ক্ষত ছিল। "কী হলো? কোথা থেকে এসব?"
রিমি প্যানিক হয়ে সোহেলকে ধরল, "আমরা চলে যাই। এখানে কোনো কিছু ঠিক নয়!"
সোহেল হালকাভাবে বলল, "না, এখন চলে গেলে আমাদের কোনো কিছুই জানা হবে না। আর ওই মহিলাটি—সে কে?"
তারা আবার বাড়ির ভিতরে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিল, কিন্তু এইবার তাদের মাঝে সন্দেহ ও আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল। তারা জানত, তাদের সামনে একটা বড় রহস্য অপেক্ষা করছে।
রাত গভীর হয়ে যাচ্ছিল, আর সোহেল ও রিমি বাড়ির ভিতরে আরও এগিয়ে যাচ্ছিল। তাদের পায়ের শব্দ বাড়ির ঘন অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ, তারা এক অদ্ভুত শব্দ শুনতে পেল—কেউ যেন তাদের পেছনে আসছে, কিন্তু কোনো মানুষ ছিল না।
"এটা কি?" রিমি গলায় আতঙ্ক নিয়ে জিজ্ঞেস করল।
"শব্দটা কোথা থেকে আসছে?" সোহেল বলল, তবে সে নিজেও বুঝতে পারছিল না। তারা আরও গভীরে গিয়ে একটি পুরানো কক্ষে পৌঁছাল, যেখানে অদ্ভুত এক জিনিস রাখা ছিল। এক কোণে একটি কাঠের বাক্স পড়ে ছিল।
"এটা কি?" রিমি জিজ্ঞেস করল, তার কণ্ঠে অবিশ্বাস।
সোহেল বাক্সটি খুলে দেখল। কিন্তু এক মুহূর্তেই কাঠের বাক্স থেকে একটা অদ্ভুত শক্তি বেরিয়ে এসে সোহেলের হাত থেকে বাক্সটি পড়ে গেল। বাক্সটি খোলার সাথে সাথে একটা ভয়ংকর শ্বাসরোধকারী গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল, আর তারা অনুভব করল, তাদের চারপাশে কোনো অদৃশ্য শক্তি ঘুরছে।
বাক্সের মধ্যে কিছু পাথরের মতো বস্তু ছিল, যার মধ্যে একটি পুরানো ছবি ছিল—এটা সেই মহিলা ছিল, যার মুখ আয়নায় দেখা গিয়েছিল।
তারা জানত, এভাবে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়, তারা যেন এক অন্ধকার গহ্বরে ঢুকে পড়েছে, যেখানে কোন এক দানব তাদের অপেক্ষা করছে।
চলবে........
জমিদার বাড়ির রহস্য
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
570
Views
8
Likes
3
Comments
4.9
Rating