এক গ্রামে একটা পুরনো বাওড় ছিল, যেখানে লোকেরা যাওয়ার সাহস পেত না। গ্রামের লোকেরা বলত, রাতের বেলা ঐ বাওড়ে নাকি অদ্ভুত কিছু ঘটে। কেউ কখনো সেখানে গিয়েছিল, কেউ ফিরেও আসেনি। সবাই বলত, "ওই বাওড়ের পানি খুবই অশুদ্ধ, সেখানে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে পারে।"
তবে, গ্রামে এক যুবক ছিল, যার নাম ছিল রাহুল। সে ছিল খুবই সাহসী। ভূত-প্রেত, এসব কিছুই তার কাছে স্রেফ গল্পের মতো ছিল। একদিন, গ্রামে একটা খুনের খবর এল। হঠাৎ করে একজন পরিচিত ব্যক্তি, যার নাম ছিল বিক্রম, নিখোঁজ হয়ে গেল। বিক্রমও শোনা গিয়েছিল সেই বাওড়ের কাছেই শেষবারের মতো দেখা গিয়েছিল। রাহুল ঠিক করল, সে সেই বাওড়ে গিয়ে ঘটনা খতিয়ে দেখবে।
রাত ছিল গভীর। তার হাতে একটা টর্চ লাইট আর কাঁপা কাঁপা পা নিয়ে রাহুল বাওড়ের দিকে এগিয়ে চলল। চারদিকে অন্ধকার, মাঝে মাঝে একটা দু'টো পাখি চীৎকার করে উড়ে চলে যাচ্ছিল। যতই সে বাওড়ের কাছে পৌঁছাচ্ছিল, ততই যেন অদ্ভুত একটা শীতল হাওয়া তার শরীরকে ছুঁয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু রাহুল একটুও ভয় পেল না। তার মনে ছিল, “এগুলো সব মনগড়া ভয়, কিছুই হবে না।”
বাওড়ের তীরে এসে পৌঁছালে সে দেখতে পেল, পানি একদম স্থির, কোন তরঙ্গ নেই। পুরনো কাঠের একটি জিপসি ঘরটা থেকে হালকা একটা শব্দ আসছিল। রাহুল কাছে গিয়ে দরজা খুলল, কিন্তু ভেতরে গিয়ে দেখল কিছুই নেই, শুধু পুরনো কিছু চেয়ার আর একটা টেবিল পড়ে রয়েছে। রাহুল তখন বুঝল, কিছুটা রহস্য আছে এখানে।
হঠাৎ, একে একে টেবিলের উপর থাকা জিনিসপত্র পড়ে গেল। রাহুল মাটিতে বসে পড়ে গেল, ভয় তাকে ধরে ফেলেছিল। কিন্তু সে জানত, ভয় পেলে কিছু হবে না, তাই সে আবার সাহস করে উঠে দাঁড়িয়ে ঘরটা পরীক্ষা করতে লাগল। টেবিলের এক কোণে একটা পুরনো কাগজ পড়ে ছিল। কাগজটি তুলে সে পড়ল—
"তুমি যেদিন এ ঘরে আসবে, সে দিন তুমি আর ফিরে যাব না। এখানে যে বসবাস করে, তার প্রলয় নেমে আসবে। সে যা চায়, তা করতে পারে। তার মনের মাঝে কেবল অন্ধকার আর ক্রোধ থাকে। সে যখন হাসে, তখন পৃথিবী কেঁপে ওঠে। সে আসছে। তুমি আর কিছু করতে পারবে না।
তবে, তুমি কি জানো না, যে এখানে কেউ একবার হারিয়ে গেলে, সে আর ফিরে আসে না, কিংবা সে যে ফিরে আসে, তা শুধু অন্য এক পৃথিবী থেকে।"
এটা পড়ার পর রাহুলের শরীরটা কাঁপতে শুরু করল। তার মনে হতে লাগল, যেন কিছু একটা তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের কোণে একটা ছায়া দেখা গেল, যা ধীরে ধীরে বড় হচ্ছিল। রাহুল চমকে গিয়ে পিছনে তাকাল। কিন্তু কিছুই দেখা গেল না। তার সারা শরীরটা ঘামতে লাগল।
ঠিক সেই মুহূর্তে, টেবিলের এক কোণ থেকে একটা ভাঙা ঘড়ির আওয়াজ আসতে লাগল। ঘড়ির কাঁটা থেমে গিয়েছিল দুপুর তিনটায়, কিন্তু তখন সঙ্গত কারণে রাত দশটা বাজছিল। এই ভয়ংকর শব্দ তাকে আরও শিহরিত করেছিল। রাহুল একবার ঘড়িটা দেখে আবার সামনে ফিরল। কিন্তু সেই সময় এক অদ্ভুত কান্নার শব্দ কানে এলো। শব্দটা আসছিল পাশের বাওড়ের গভীর থেকে। সে সাহস করে এগিয়ে গেল, কিন্তু তখন তার পা যেন শেকল হয়ে গেল। সে না চাইলেও এক পা, দুই পা এগিয়ে চলল।
বাওড়ের পাড়ে গিয়ে সে দেখল, ঐ অদ্ভুত কান্নাটি আসছে এক মেয়ে, যার মুখ ছিল অন্ধকারে ঢাকা। সে মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেল, কিন্তু মেয়েটি এক অদ্ভুতভাবে ঘুরে তাকে চোখের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল। হালকা চেহারা, তবে তার হাসির মধ্যে ভয়ংকর এক সুর ছিল।
রাহুলের পা তলিয়ে যাচ্ছিল, সে বুঝতে পারল, এটা কোনো সাধারণ ভয় নয়, এখানে যা ঘটছে তা সব কিছুই বাস্তব। তার সামনে থাকা সেই অন্ধকার মুখটি ভেঙে গিয়ে এক বিশাল কঙ্কাল আকারে রূপান্তরিত হতে শুরু করল।
রাহুল আরও কিছু বলার চেষ্টা করছিল, কিন্তু তার গলা থেকে কোন শব্দ বের হচ্ছিল না। তার চোখে পানি চলে আসছিল। সে জানত, এখন আর কিছু করা সম্ভব নয়। তার চারপাশে সব কিছু গুটিয়ে আসছিল, আর সেই কঙ্কাল তার দিকে এগিয়ে আসছিল।
অবশেষে, রাহুল নিঃশব্দে আঁকড়ে ধরে একমাত্র শেষ চেষ্টা করে চিৎকার করল। কিন্তু তার চিৎকার শোনা গেল না, কারণ সেখানে কেউ ছিল না, কেবলমাত্র ভয়ে ভরা কোলাহল।
সকালে গ্রামবাসীরা যখন সেখানে পৌঁছাল, তখন শুধুমাত্র একটি পুরনো কাগজ পেয়েছিল, যাতে লেখা ছিল:
"এখানে ভয়াবহ এক আত্মা বাস করে, যারা তার কাছে চলে যায়, তারা আর ফেরত আসে না। কিন্তু, কখনো কখনো, তারা অন্য কোনো মানুষের মধ্যে সেঁধিয়ে যায়, তার শরীরের মধ্যে বাস করে, তার মাঝে। তাদের চিৎকার শোনে না কেউ, তাদের গল্প কেউ বলে না।"
আর কেউ কখনো রাহুলকে দেখতে পায়নি।
সেই রাতে, সে ভয়াবহ আত্মা আসল, এবং তারপর থেকেই কেউ আর সেই বাওড়ে পা রাখে না..
অন্ধকার রাতের অতিথি
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
137
Views
2
Likes
1
Comments
0.0
Rating