সূরা আল মাউন

অডিও মোড

00:00 00:00
গতি:
ভলিউম:
সূরা মাউন

সূরা আল-মাউন হলো কুরআনের ১০৭ নম্বর সূরা, মক্কায় অবতীর্ণ একটি সূরা। এতে ৭টি আয়াত রয়েছে, এবং এটি মূলত সামাজিক দায়িত্ব, দয়া, ও মুনাফিকদের (ভণ্ডদের) আচরণ নিয়ে আলোচনা করে। "মাউন" শব্দের অর্থ ছোট ছোট জিনিসপত্র, যেমন সাধারণ উপকরণ বা সাহায্য, যা মানুষ একে অপরের প্রয়োজনে দিয়ে থাকে। এই সূরাটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, প্রকৃত বিশ্বাসী হতে হলে শুধু আল্লাহর ইবাদত করলেই হয় না, মানুষের প্রতি দায়িত্ব ও সহযোগিতাও অপরিহার্য।

অবতরণের কারণ:

এই সূরাটি এমন ব্যক্তিদের সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে যারা নিজেদের মুমিন বলে দাবি করত, কিন্তু তারা আসলে ছিল ভণ্ড। তারা আল্লাহর ইবাদত করলেও, দরিদ্রদের সাহায্য করা বা তাদের অধিকার রক্ষা করা নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহী ছিল না। এমনকি, তারা নিজেদের স্বার্থের জন্য নামাজ আদায় করত, যেন মানুষ তাদের ধার্মিক বলে মনে করে। সূরা মাউন এমন লোকদের প্রতি কঠোর সমালোচনা করে।




সূরা আল-মাউন: পূর্ণ ব্যাখ্যা

১. "আরা-আইতাল্লাযী ইউকাজ্জিবু বিদ-দ্বীন"

আল্লাহ প্রশ্ন করছেন, তুমি কি সেই ব্যক্তিকে দেখেছ, যে বিচার দিবসকে অস্বীকার করে? এখানে সেই ব্যক্তিদের কথা বলা হচ্ছে, যারা আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস করে না এবং আল্লাহর বিচারের দিনে জবাবদিহি করার কোনো ভয়ও পোষণ করে না। এই ধরনের লোকেরা সাধারণত অন্যায় ও অবিচার করে এবং সমাজের দুর্বল ও অসহায় মানুষদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে।


২. "ফা-যালিকাল্লাযী ইয়াদু'উল ইয়াতীম"

এমন ব্যক্তিই সেই, যে এতিমদের ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয়। এই আয়াতে দেখা যাচ্ছে, যারা আল্লাহর বিচার দিবসে বিশ্বাস করে না, তারা এতিমদের অধিকার নিয়ে কোনো চিন্তা করে না এবং তাদের সঙ্গে নির্মম আচরণ করে। ইসলাম এতিমদের অধিকার রক্ষা ও তাদের প্রতি সদয় আচরণকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়, এবং এই আয়াত থেকে বোঝা যায় যারা এতিমদের সঙ্গে নির্মম ব্যবহার করে, তারা প্রকৃত ঈমানদার নয়।


৩. "ওয়ালা ইয়াহুদ্দু 'আলা তা'আমিল মিসকীন"

এবং সে মিসকিনদের খাবার দেওয়ার জন্য উৎসাহিত করে না। এই আয়াতটিতে আরও বলা হচ্ছে, এই ধরনের লোকেরা গরীব ও অসহায় মানুষদের জন্য সাহায্য করা তো দূরের কথা, বরং অন্যদেরকেও তা করতে উৎসাহ দেয় না। প্রকৃত মুমিনরা দরিদ্রদের জন্য সহযোগিতায় সচেষ্ট থাকে, কিন্তু যারা ঈমানদার নয়, তারা তা করে না।


৪. "ফা-ওয়াইলুল-লিল-মুসল্লীন"

অতএব, দুর্ভোগ তাদের জন্য যারা নামাজ পড়ে। এই আয়াতটি প্রথমে কিছুটা আশ্চর্যজনক শোনাতে পারে, কারণ নামাজ পড়া তো ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। কিন্তু পরবর্তী আয়াতে এর ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।


৫. "আল্লাযীনা হুম 'আন সালাতিহিম সাহূন"

যারা তাদের নামাজের ব্যাপারে অসাবধানী। এখানে সেই সব লোকদের কথা বলা হচ্ছে যারা নামাজ পড়ে, কিন্তু মন থেকে পড়ে না বা অবহেলা করে। তাদের নামাজে কোনো ইখলাস (নিষ্ঠা) নেই, তারা তা শুধু লোক দেখানোর জন্য বা দায়সারাভাবে পড়ে। এর ফলে তাদের নামাজ আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না।


৬. "আল্লাযীনা হুম ইউরা'উন"

যারা লোক দেখানোর জন্য কাজ করে। এই আয়াতটি মুনাফিকদের (ভণ্ডদের) নিয়ে যারা ধর্মীয় কাজ করে, কিন্তু কেবল লোক দেখানোর জন্য। তাদের ইবাদত বা সৎ কাজের পেছনে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের কোনো উদ্দেশ্য থাকে না, বরং সমাজের চোখে নিজেদের ভালো দেখানোর চেষ্টা থাকে।


৭. "ওয়া ইয়ামনাউনাল মাউন"

এবং তারা সাধারণ সাহায্য দিতে অস্বীকার করে। এখানে "মাউন" বলতে বোঝানো হচ্ছে সাধারণ দান-সাহায্য বা ছোট ছোট উপকরণ, যেমন পানি, খাবার বা প্রয়োজনীয় সামগ্রী। এই আয়াতের মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে, যারা ন্যূনতম সাহায্য প্রদানেও কৃপণতা করে এবং সামান্যতম দয়া বা মানবিকতার প্রকাশ করে না, তারা প্রকৃত ঈমানদার নয়।


তাৎপর্য:

1. সামাজিক দায়িত্ব ও সহযোগিতা:
সূরা মাউন আমাদেরকে শেখায়, শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদত করাই যথেষ্ট নয়, বরং মানুষের প্রতি দায়িত্ব পালন ও দান-সাহায্য করাও ঈমানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এতিম ও দরিদ্রদের অধিকার রক্ষা করা, তাদের সাহায্য করা এবং মানবিক দায়িত্ব পালন করাই প্রকৃত মুমিনের পরিচয়।


2. ভণ্ডামির বিরুদ্ধে সতর্কতা:
এই সূরাটি মুনাফিকদের বিরুদ্ধে কঠোর বার্তা দেয়। যারা নামাজ পড়ে কিন্তু তা মন থেকে পড়ে না, যারা লোক দেখানোর জন্য ইবাদত করে, তাদের সতর্ক করা হয়েছে। আল্লাহর কাছে কেবল নিখাঁদ ইবাদত ও সৎ কাজই গ্রহণযোগ্য।


3. দারিদ্র্য ও দুর্বলদের সাহায্য:
ইসলামে গরিব, এতিম, এবং দুর্বলদের প্রতি সদয় আচরণ এবং সাহায্য করা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। যারা সমাজের এসব দুর্বল মানুষদের সাহায্য করতে অবহেলা করে, তাদের আল্লাহর বিচারে কঠিন শাস্তি পেতে হবে।





সূরা মাউন আমাদের শেখায় যে, আল্লাহর ইবাদতের পাশাপাশি মানুষের প্রতি দয়া, সহযোগিতা, ও দায়িত্ব পালন করা ইসলামের অন্যতম মূল নীতি। ভণ্ডামি এবং লোক দেখানো ইবাদতের প্রতি এই সূরাটি সতর্কবার্তা দেয় এবং প্রকৃত মুমিনদের দানশীল, সহানুভূতিশীল ও মানবিক হওয়ার আহ্বান জানায়।
128 Views
8 Likes
0 Comments
0.0 Rating
Rate this: