শহরের বাইরে, একটা ছোট্ট গ্রাম। সেখানে সন্ধ্যে নামলেই গায়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়, যেন বাতাসেই এক চাপা ভয় মিশে আছে। মানুষ জন আটটার মধ্যে ঘরে ফিরে যায়, দরজা-জানালা বন্ধ করে দেয়। এই সময়েই নাকি পুরনো পাকা রাস্তার শেষ প্রান্তে থাকা পরিত্যক্ত বাড়িটা জেগে ওঠে। গ্রামের মানুষদের ধারণা, রাতে সেই বাড়িতে কিছু ঘটে—কিছু অস্বাভাবিক, কিছু অদ্ভুত।
তুহিন আর ইমন দুই বন্ধু, শহরের ছেলে। গ্রামের এসব কথায় তারা খুব একটা বিশ্বাস করত না। তারা শুধু গ্রামের শান্ত পরিবেশে কিছুদিন কাটানোর জন্যই এখানে এসেছিল। কিন্তু গ্রামের গল্পগুলো তাদের মনে কৌতূহল জাগিয়েছিল। তারা ঠিক করল, একদিন রাতে সেই বাড়ির রহস্য নিজের চোখে দেখবে।
একদিন রাতের দিকে, গ্রামের লোকজন যখন ঘুমোতে চলে গেছে, তখন তুহিন আর ইমন একসঙ্গে বের হল। রাত দশটা। চারপাশে থমথমে নীরবতা। বাতাসে হালকা শীতল একটা ভাব। দূরে, অন্ধকারের মাঝে, সেই পুরোনো বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। তারা ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল, আর যখন বাড়িটার কাছে পৌঁছল, তখন তাদের গায়ে এক অজানা শীতলতা বয়ে গেল।
বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে, তুহিন একটু থমকে গেল। দরজাটা সামান্য খোলা। ইমন হালকা হেসে বলল, "চল, কিছুই হবে না। এসব বাজে কথা।" তারা দুজনেই ভেতরে ঢুকল। ঘরের ভেতরটা অন্ধকার, চারদিকে ধুলো জমে আছে। কিন্তু একটা অদ্ভুত অনুভূতি তাদের ঘিরে ধরল, যেন তারা একা নেই।
তুহিনের হাত থেকে টর্চটা পড়ে গেল হঠাৎ। যখন সেটা তুলতে গিয়েছিল, দেখতে পেল ঘরের কোণে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। তার গা থেকে একটা ধোঁয়ার মতো কুয়াশা বের হচ্ছিল, কিন্তু মুখটা অন্ধকারে ঢাকা। তুহিন চমকে উঠল, আর ইমনকে ডাকল। ইমন এগিয়ে এসে দেখল সেই অদ্ভুত ছায়া। দুজনেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ।
"কে ওখানে?" তুহিন সাহস করে বলল। কিন্তু কোনো উত্তর আসেনি।
মুহূর্তের মধ্যে, ঘরের দরজাটা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেল। তারা পিছন ফিরে তাকাতে পারল না, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাদের জমিয়ে রেখেছে। সেই ছায়াটা এবার ধীরে ধীরে তাদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। ইমন কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, "আমরা চলে যেতে চাই।"
কিন্তু ছায়াটা কোনো শব্দ করল না। হঠাৎ করেই, ঘরের বাতাস ভারী হয়ে গেল। একটা গোঙানির শব্দ উঠল, আর সেই ছায়াটা তাদের আরও কাছে এসে দাঁড়াল। এবার তারা পরিষ্কার দেখতে পেল—ওটা কোনো মানুষ নয়। ওটার মুখ একেবারে সাদা, চোখদুটো ফাঁকা। তার ঠোঁট নড়ে উঠল, কিন্তু কোনো শব্দ বেরোল না। তারপর, হঠাৎ করেই একটা প্রচণ্ড কণ্ঠস্বর শোনা গেল, যেন ঘরের চারপাশ থেকে ভেসে আসছে।
"তোমরা এসেছ কেন?" সেই কণ্ঠস্বর ফিসফিস করে উঠল।
তুহিন আর ইমনের শরীর কেঁপে উঠল। তারা পেছনে ফিরে দরজার দিকে দৌড়াতে চাইল, কিন্তু তাদের পা যেন শিকল দিয়ে বাঁধা। তারা বুঝল, কিছু একটা তাদের আটকে রেখেছে।
হঠাৎ করেই ঘরের বাতি নিভে গেল। পুরো ঘরটা এক অন্ধকারে ঢেকে গেল, আর সেই ছায়াটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। কিন্তু তারা জানত, সেটা চলে যায়নি।
"তোমরা ফিরতে পারবে না," সেই কণ্ঠস্বর আবার উঠল। "যা শুরু হয়েছে, তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তোমরা এখানেই থাকবে।"
তুহিন আর ইমন নিজেদের মুক্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করছিল, কিন্তু তাদের শরীর আর মনের ওপর যেন এক অদ্ভুত ভারী চাপ নেমে এসেছে। তারা একে অপরের দিকে তাকাল, বুঝতে পারল, এই পুরোনো বাড়ির রহস্য শুধু গল্প নয়।
কিছুক্ষণ পর, বাইরে থেকে হালকা বাতাসের শব্দ শোনা গেল, যেন কিছু দ্রুত চলে যাচ্ছে। কিন্তু ঘরের ভেতরেই যেন সময় থেমে গেছে।
তুহিন এবং ইমন কোনোভাবে সেই অদ্ভুত শক্তির প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে, কিন্তু যতবারই তারা পালানোর চেষ্টা করে, ঘরের প্রতিটি দরজা আর জানালা বন্ধ হয়ে যায়। শেষে, তারা যখন সম্পূর্ণ অসহায় বোধ করতে থাকে, ঠিক তখনই তারা দেখতে পায় সেই ছায়া তাদের ঠিক সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তার চোখদুটো ফাঁকা, আর মুখে এক ভৌতিক হাসি। ছায়াটা এবার বলে, "তোমরা চলে যেতে চেয়েছিলে, কিন্তু এখন তোমরা এই ঘরের অংশ হয়ে গেছো।"
গল্পের শেষ লাইনে ইমন আর তুহিনের চিৎকার পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে যায়, এবং তারপর নিস্তব্ধতা নেমে আসে। বাইরে ভোরের আলো ফুটলেও, সেই ঘরের ভেতর আর কোনো কণ্ঠস্বর শোনা যায় না—শুধু হালকা বাতাসের শব্দ।
পরিত্যক্ত ঘর
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
148
Views
3
Likes
1
Comments
4.3
Rating