রাত প্রায় ১০টা। রফিক কাজ শেষ করে ঢাকার অফিস থেকে বেরিয়ে কমলাপুর স্টেশনে এসে পৌঁছালো। এক সপ্তাহ পর ছুটি পেয়েছে, গ্রামের বাড়িতে মা অসুস্থ, তাই দ্রুত ফিরে যাওয়া দরকার। টিকিট আগেই কাটা ছিল, ট্রেন ছাড়বে রাত ১১টায়। সে প্ল্যাটফর্মে এসে অপেক্ষা করতে লাগলো।
কমলাপুর স্টেশন সবসময়ই কোলাহলপূর্ণ, কিন্তু আজ একটু ভিন্ন লাগছে। যেন কেমন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। রফিক ভাবলো হয়তো নিজের ক্লান্তির জন্যই এমন মনে হচ্ছে। ট্রেন এল, সে তাড়াতাড়ি উঠে গেল। ভেতরে বেশিরভাগ আসন ফাঁকা, লোকজন কম। এক কোণার সিটে বসে পড়লো সে। জানালার বাইরে অন্ধকার, শুধু মাঝে মাঝে স্টেশনের আলো দেখা যায়।
ট্রেন চলতে শুরু করল। রফিক জানালায় মাথা ঠেকিয়ে আরাম করে বসলো। হঠাৎ তার পাশে এক বৃদ্ধ এসে বসলো। মুখে একরকম অদ্ভুত শান্তি, অথচ চোখে যেন দুঃখের ছায়া। বৃদ্ধ বললো, “কোথায় যাচ্ছেন বাবা?”
রফিক হালকা হাসি দিয়ে বলল, "গ্রামে, মা অসুস্থ।"
বৃদ্ধ একটু চুপ থেকে বললেন, “মায়ের টানে ফিরছেন। মা সবসময়ই সন্তানের অপেক্ষায় থাকে।” এরপর বৃদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর তিনি আবার বললেন, “আপনি কি জানেন, রাস্তায় মানুষ সবসময়ই একা থাকে না?”
রফিক একটু অস্বস্তি বোধ করলো। “মানে?”
বৃদ্ধ একটু হেসে বললেন, “সবকিছু যেমন দেখছেন তেমন নয়। এ পথে অনেক কিছু আছে যা আপনার চোখে ধরা পড়ে না। কিছু সত্তা থাকে, যারা অপেক্ষায় থাকে। তাদের কেউ কেউ দয়ালু, আর কেউ কেউ... নাহ, থাক, আর বলব না।”
রফিক বুঝতে পারল, এ বৃদ্ধ কিছুটা অদ্ভুত ধরনের। সে আর কথা বাড়ালো না, শুধু জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকল। ট্রেন তখন বেশ দ্রুতগতিতে ছুটছে।
হঠাৎ ট্রেনটা একটু ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল। আশেপাশে কেউ নেই, সব যাত্রী যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। পুরো কামরা ফাঁকা! বৃদ্ধও নেই! রফিকের বুকের ভিতর কেমন যেন একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। তার কপালে ঘাম জমতে শুরু করলো। সে উঠে দাঁড়াল এবং বাইরে তাকাল, কিন্তু কোথাও কিছু নেই—ট্রেন এক অচেনা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। শুধু গা ছমছমে অন্ধকার আর হালকা বাতাস।
"হ্যালো?" রফিক চিৎকার করে উঠলো। কোনো সাড়া নেই।
তারপর হঠাৎই, বৃদ্ধের সেই শান্ত কণ্ঠস্বর আবার শোনা গেল, "আমি তো বলেছিলাম, এ পথে সবকিছু যেমন দেখা যায়, তেমন নয়।"
রফিক পিছনে ফিরে তাকাল, বৃদ্ধটি আবার তার সামনে! কিন্তু এবার তার মুখটা সম্পূর্ণ বদলে গেছে। তার চোখ দুটো আগের মতো নেই—সেগুলোতে এক অদ্ভুত অন্ধকার ঘূর্ণি। মুখটা বিকৃত, যেন মাংসের ভেতর থেকে কিছু বের হয়ে আসছে। বৃদ্ধের চেহারা ধীরে ধীরে বদলে যেতে লাগলো, আর তার চারপাশের বাতাস যেন ঘন হয়ে আসছে।
রফিকের পায়ের নিচে শক্ত মাটি আর নেই। সে বুঝতে পারলো, এইটা মানুষ নয়, এতো জিন!
রফিক দ্রুত দরজার দিকে ছুটল। কিন্তু দরজা আটকে গেছে! কপালে ঘাম, বুকের ধুকপুকানি বেড়ে চলেছে। কী করবে? সে পকেট থেকে একটা তাবিজ বের করল, মা দিয়েছিল এই তাবিজ। তার কানে মায়ের কথা ভেসে উঠল, "যদি কখনও বিপদে পড়িস, এটা হাতে নে, আল্লাহর নাম নিস।"
রফিক তাড়াতাড়ি তাবিজটা শক্ত করে ধরে আল্লাহর নাম নিতে শুরু করলো।
বৃদ্ধের চোখ দুটো আগুনের মতো জ্বলে উঠলো, “তুই বাঁচতে পারবি না!” তার গলায় অশুভ গর্জন।
কিন্তু রফিক থামল না। আল্লাহর নাম নিতে নিতে সে প্রার্থনা করতে থাকল। এক মুহূর্তের মধ্যেই চারপাশের অন্ধকার কেটে যেতে লাগল। ট্রেনটা আবার চলতে শুরু করলো, আর বৃদ্ধটি মিলিয়ে গেল যেন কুয়াশার মতো।
রফিক চোখ মেলে দেখে, ট্রেন সেই পুরনো রাস্তায় ফিরে এসেছে। চারপাশে লোকজন আছে, সবাই স্বাভাবিক। রফিকের বুক থেকে ভার নেমে গেল।
কিন্তু তার মনে একটা প্রশ্ন ঘুরছিল—এটা কি সত্যিই ঘটেছিল, নাকি শুধুই তার মনের ভুল? তবে যাই হোক, তাবিজটা তখনও তার হাতে ছিল, আর তার মায়ের কথা তার মনে গেঁথে ছিল।
ট্রেন তখন গন্তব্যে পৌঁছাতে শুরু করেছে।
ট্রেনের ভেতর ভুতের খপ্পরে
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
150
Views
2
Likes
1
Comments
4.7
Rating