মুনিহারা থমথমে মুখ নিয়ে চলে যেতে নিলে সাইয়ারা বলে উঠলো।
- অহন গিয়া কথডি তো আমার মা-বাপের কানো লাগাইবাই তাই না। আইচ্ছা লাগাইনগা।
মুনিহারা কিছু না বলে চলে গেলো।
- মাথাত সবসময় বদ বুদ্ধি ঘুরে না।
ফাওযীয়ার কথায় সাইয়ারা হেসে মাছগুলো ধুতে চলে গেলো।
গ্রীষ্মের ছুটি শেষ নায়লারাও চলে গেছে। অর্ধবার্ষিক পরীক্ষার ঘোষনা করা হয়েছে। সাইয়ারা বাসায় এসে পড়ার টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা বাক্স বের করলো। বাক্স থেকে যে টাকাটা পেলো তা পর্যাপ্ত নয়। কিছু টাকার ঘাটতি পড়েছে। পরীক্ষারও বেশি দিন নেই ফিও জমা দিতে হবে। সাইয়ারার হাতে যে কাজগুলো আছে তার টাকা পরীক্ষার আগে পাওয়া যাবে না। তাই ঘাটতি টাকাটা বাবার কাছ থেকেই নিতে হবে। রাতে খাওয়ার পর থেকেই সাইয়ারা ছোট উঠানে দাড়িয়ে আছে। বাবা-মায়ের ঘরের যেতে চাইলেও সাহস পাচ্ছে না। এমন না যে সে ভয় পাচ্ছে বা বাবার কাছে টাকা চাইলে তিনি দেবেন না। আসলে বাবার কাছ থেকে কিছু চাইতে গেলে সাইয়ারার মধ্যে জড়তা কাজ করে। অনেক্ষণ দাড়িয়ে থাকার পর সাইয়ারা মনে মনে ঠিক করে ফেললো প্রধান শিক্ষিকাকে বলে কিছু টাকা কম দিয়ে পরীক্ষাটা দিবে। সাইয়ারা যখন চলে যাবে তখন জামীর দরজা বন্ধ করার জন্য দরজার কাছে আসলে সাইয়ারাকে দেখতে পেলেন। সাইয়ারার নাম ধরে ডাকতেই সে থেমে গেলো। ঘুরে দাড়ালো বাবার দিকে। দৃষ্টি তার নত।
- কিছু কইবি।
সাইয়ারা আমতা আমতা করে বললো....
- আসলে...আসলে বাবা।
সাইয়ারা অনেকটা বাতাস নিজের মধ্যে টেনে নিয়ে বলল....
- কিছু না বাবা।
বলে সাইয়ারা চলে গেলো। জামীর মেয়ের চলে যাওয়ার পরও কিছুক্ষণ বাইরে তাকিয়ে কিছু ভাবছিলো তারপর দরজা বন্ধ করে ভেতরে চলে গেলো।
- সাইয়ারা কেইল্লেগ্গা আইছিলো।
- জানি না। কিছু লাগে মনো অয়। তুমি কাইল্কা দেইখ্খো কি লাগে?
সাইয়ারার মা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।
প্রতিদিনের নিয়মেই শুরু হলো সাইয়ারার দিন। ঘর থেকে বেরিয়ে মা-জেঠিকে কাটা-কুটির করছে। সাইয়ারা রান্না বসিয়ে দিলো। সবজি কাটা শেষে মাজেদা চলে গেলো। ফাজেলা কাটা সবজিগুলো ধুয়ে দিচ্ছে। রান্নার সময় এতোটুকুই তাদের কাজ। সবজি ধোয়া হয়ে গেলে রান্নাঘরে রেখে ফাজেলা যাবার জন্য পা বাড়ালো। কয়েক কদম এগোলে কিছু একটা মনে পড়ে থেমে গেলো। রান্নাঘরের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলো....
- তর কি কিছু লাগবো।
মায়ের কথায় বিষ্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো....
- না ত। কেইল্লেগ্গা।
- কাইল্কা রাইতে যে হেই উঠানে গেছিলি।
সাইয়ারা মুচকি হেসে করুণ চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল....
- কে আমি কি হেইনো যাইবার পারি না।
সাইয়ারার কথায় ফাজেলা কিছুটা ক্রুদ্ধ হয়ে বললো....
- দেখ সবসময় ত্যারা ত্যারা কতা কইবিনা।
রাগ দেখিয়ে মা চলে গেলো।
*আর যাইতামনা। আমার লাইগ্গা তুঙ্গর অসুবিধাত পড়ুন লাগতো না।*
সাইয়ারা হাসলো হাসিটা মলিন, কষ্ট মিশ্রিত।
সাইয়ারা আজ একটু তাড়াতড়ি স্কুলে চলে এসেছে। প্রধান শিক্ষিকার বদরুন্নেসার কক্ষের সামনে দাড়িয়ে নম্রভাবে সালাম বিনিময় করে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি চাইলো। প্রধান শিক্ষিকা অনুমতি প্রদান করলে সাইয়ারা ভেতরে প্রবেশ করে কুশল বিনিময় করলো। সাইয়ারা এলোমেলো দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকিয়ে আমতা আমতা করে বললো....
- ম্যম একটা কথা ছিলো।
বদরুন্নেসা হাতের কাজ রেখে সাইয়ারার দিকে তাকিয়ে তাকে পরখ করে শান্ত গলায় বললো....
- কী হয়েছে তোমার।
বদরুন্নেসার শান্ত কন্ঠে সাইয়ারা যেন আশ্বস্ত হলো।
- আসলে ম্যম আমার কাছে যতগুলো প্রাকটিক্যাল আর অ্যাসাইনমেন্টের কাজ আছে সেগুলো সব শেষ হয়নি। কাজ শেষ না হলে...
সাইয়ারার কথা শেষ করার আগেই বদরুন্নেসা তাকে থামিয়ে দিলো।
- বলতে হবে না সাইয়ারা। তুমি যতটুকু পারো টাকা পরিশোধ করে পরীক্ষায় বোসো বাকিটা সুযোগ পেলে দিও। আমি তোমার এডমিট কার্ড দিয়ে দেওয়ার জন্য বলে দেবো। এখন যাও ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।
সাইয়ারা বদরুন্নেসাকে একটা মুচকি হাসি উপহার দিয়ে বেরিয়ে গেলো। বাইরে বেরিয়ে একটা স্বস্তির শ্বাস নিয়ে মুচকি হেসে ক্লাসে চলে গেলো। বিকালে বাসায় ফেরার সময় গেইট খোলার জন্য হাত বাড়িয়েও খুললো না। হাটা শুরু করলো পুকুর পাড়ের দিকে। রাতের রান্না শেষ করে সবকিছু গোছানোর সময় ফাজেলা সাইয়ারাকে বললো....
- পরীক্ষার কতা কইছোস না কে?
মায়ের কথা শুনে বুঝলো মুনিহার কাছ থেকে শুনেছে। তারা একই শ্রেণিতে পড়ে। তাই স্কুলের ব্যাপারগুলো সাইয়ারা না বললেও মুনিহার মাধ্যমে জানতে পারে ফাজেলা। শান্ত করে বললো....
- দেরি আছে।
- পরীক্ষার ফি লাগতো না।
সাইয়ারা হাত ধুতে ধুতে বললো....
- লাগতো না। আছে আমার কাছে।
কথাটা বলেই সাইয়ারা ঘরে চলে গেলো। ফাজেলা ক্রদ্ধ হয়ে কিছু বলতে গিয়েও বললো না।
সাইয়ারার পরীক্ষ শেষ হয়ে গেছে। কিছুদিন হলো সাইয়ারাকে শুধু রান্না করার সময় দেখতে পায় ফাজেলা। সে কখন স্কুলে যায় কখন ফেরে বুঝতে পারে না। আগে সাইয়ারার স্কুলে যাওয়া-আসার সময় তাকে দেখতে পারতেন ফাজেলা। কিন্তু সেই দিন থেকে বাড়ির পেছনের রাস্তাটায় সে ব্যবহার করে। এনিয়ে তাকে প্রশ্ন করা হলে সে এমনি বলে এড়িয়ে যায়। আজকে পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হয়েছে। প্রতি বারের মতো এবারও এক বিষয়ে অকৃতকার্য হয়েছে সাইয়ারা। এটাও এখন তার জীবনের স্বাভাবিক একটা বিষয়। ছোট বেলায় সে পড়ালেখায় ভালো ছিলো। কিন্তু এখন পড়ালেখায় অনেক খারাপ হয়েগেছে সে। আজকে স্কুল তাড়াতাড়ি ছুটি দিয়ে দিয়েছে। মন খারাপ নিয়ে বাড়ি ফিরলো সে। বাড়িতে ঢুকেই সামনে পড়লো দাদি জালসান আর ছোটো ফুফু হিশমার।
- কি রে এইবারও ডাইল মারছোস।
সাইয়ারা দাদির কথায় কিছুটা অবাক হলো। সে তো কাউকে বলে নি আজকে রেজাল্ট দিবে। তবে কি মুনিহা বলেছে। সেটা কিভাবে হয় সে তো মুনিহার আগেই চলে এসেছে।
- আর কি আশা করো মা। এই ছেড়ি আবার কবে পাশ করছিল।
বলেই তারা হাসতে শুরু করলো। তাদের কটু কথা তার জীবনের রোজকারের ঘটনা। আগে খারাপ লাগলেও এখন সব গা সওয়া। এই বাড়িটায় তার একদম থাকতে ইচ্ছে করে না। কোনো উপায় নেই তাই এখানেই থাকতে হয়। নইলে কবেই চলে যেত।
- কি রে মুহো রাও নাই কে।
কন্ঠ অনুসরণ করে সামনে তাকালো সাইয়ারা। মেজো ফুফু হামুদা ও সেজো ফুফু হারিয়াকে দেখে মনে মনে বললো....
*এরা কখন এসেছে। দুই মা মেয়ে কি কম ছিলো যে এই দুইটা এসে হাজির হয়েছে।*
- কি যে কও না বুজি। এর কুনু যোগ্যতা আছে পরীক্ষাত পাশ করার। এইডা কি আর আমরা পাশ কইরা বাপ-মায়ের মুহো হাসি ফুডাইয়াম।
সেজো ফুফুর কথা শুনে সাইয়ারা মনে মনে বললো....
*হ। পাশ তো করছিলাই। খালি আমরা দেখছিনা দেইখ্খা।*
কিছু না বলে সাইয়ারা তার ঘরে চলে গেলো। সাইয়ারাকে তাদেরকে উপক্ষা করতে দেখে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো হারিয়া।
- দেখছো দেখছো মা। কেমন অহংকার দেহায় এইটুক ছেড়িয়ে।
- কী আর অইবো। মা শিক্ষা না দিলে যা অয় আর কী।
ঘর থেকে বেরোনোর সময় দাদির কথাটা শুনতে পারলো সাইয়ারা। সে প্রতিত্তোরে বললো....
- আমার মায়ে না হয় কিছু শিহাইছেনা। ছুডু থেইক্কা তো তুঙ্গর কাছেই আছিলাম শিহাইছোনাকে কিছু।
সাইয়ারার কথায় দাদি আরো রেগে গেলো।
- হে তর এত্তো বড় সাহস। আমার মুহে মুহে তর্ক করছ। দারা আইউক তর বাপ।
সাথে ফুফুরাও আরো অনেক কথা বললো। যাই হোক তাদেকে রাগিয়ে দিয়ে সাইয়ারার অনেকটা ভালো লাগছে। তখন মাজেদার আগমন।
- কী রে আবার ফেল করছোস নাকি। পাশ করবিই কেমনে পড়ালেহা করছ।
সাইয়ারা মনে মনে জেঠিকে “ফালতু মহিলা” সম্মোধন করে বললো....
- আমি না অয় পড়ালেহা না কইরা ১ বিষয়ে ফেল করি। পড়ালেহা কইরাও তো আইন্নের ঝিয়ের মতো ৪ বিষয়ে ফেল করি না।
সাইয়ারার কথায় মাজেদা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। কিছু কথাও শুনিয়ে দিলো সাইয়ারাকে। তাতে সাইয়ারার কিছু যায় আসেনা। তার কাছে আরো কিছু কাজ এসেছে কলেজের স্টুডেন্টদের থেকে এগুলো শুরু করতে হবে এখন। সাইয়ারা খাওয়া দাওয়া করে কাজে বসে গেলো।
আছরের আজান পড়ে যাওয়ায় সাইয়ারা জরুরি কাজ শেষ করে রাতের রান্না করতে চলে গেলো। তার পরীক্ষা ফল খারাপ হয়েছে। আজকে এটা নিয়ে বাসায় অনেক কান্ড হতে পারে তাই সাইয়ারা আগে থেকেই প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করতে চাইছে। সন্ধ্যার আগেই রাতের রান্না শেষ হয়ে গেলো। মাগরিবের আজানের কিছুক্ষণ পর সাইয়ারা আবার তার কাজ শুরু করলো। কালকে আরো কিছু খাতা আসতে পারে। তার আগের কিছু খাতা এখনো বাকী। আবার আজকেও কিছু এসেছে। এখন থেকে রাত জেগে কাজ করতে হবে নইলে পড়ে বেশি চাপ পড়ে যাবে। মাগরিবের আজানের অনেক্ষণ পরে সাইয়ারার মেজ বোন সানজা এসে খবর দিলো বাবা এসেছে তাকে যেতে বলেছে। সাইয়ারা যাচ্ছে বলে সানজাকে পাঠিয়ে দিলো। সাইয়ারা ভালো করে ওড়না দিয়ে নিজেকে ঢেকে সামনের উঠানে গেলো।
- পরীক্ষার ফলাফল কী অইছে।
- ভালো হয়নি।
- ***চ্চা তোরে কী খাওন ফিন্দুনের মধ্যে কম দেওয়া অয় তাও পাশ করবার পারছ না কে।
সাইয়ারা কিছু বললো না। চুপচাপ দাড়িয়ে রইলো।
চলবে...
জানি ঠিকই দেখা হবে (পর্ব-৩)
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
610
Views
14
Likes
1
Comments
3.7
Rating