জানি ঠিকই দেখা হবে (পর্ব-২)

অডিও মোড

00:00 00:00
গতি:
ভলিউম:
বিকালে বাসায় ঢোকার সময় দেখলো সবাই উঠানে বসে আছে। সেখানে বাবার উপস্থিত। সাইয়ারাদের গেইটটা বাড়ির একপাশে| গেইট দিয়ে ঢুকতেই সামনে পড়ে সিমেন্টে আস্তরণ করা দেয়াল উপরের টিনের চাল। পাশ দিয়ে একটা সরু রাস্তা। দেখে বোঝায় যায় এটা ঘরের পেছনের দিক। যার জন্য সাইয়ারা আসলেও তারা দেখতে পায়নি। বাবার গম্ভীর মুখটায় জানান দেয় এতক্ষণে তার কানে কথাটা চলে গেছে। সাইয়ারার ঘরটা পেছনের দিকে হওয়ায় এখান দিয়ে ঘরে যেতে হলে তাকে তাদের সামনে দিয়ে যেতে হবে। আছরের ওয়াক্ত হয়ে গেছে এখন এখানে যাওয়ার চেয়েও জরুরি কাজ আছে তার। তাই তাকে পুকুর পাড় দিয়ে ঘরে যেতে হলো। সাইয়ারা নিজেকে গুছিয়ে কাজটা শেষ করলো। নায়লা তাকে বাড়ির পরিস্থিতির কথা বলে আটকাতে চাইলেও কথা না শুনেই ওড়না দিয়ে মাথা ও ‍শরীর ভালো করে ঢেকে সাইয়ারা ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। বেরোনোর সাথে সাথেই মুনিহার সামনে পড়ে যায়। সাইয়ারাকে দেখা মাত্রই মুনিহা তার বাহু ধরে টানতে শুরু করলো। যেন সে সাইয়ারাকে না জেল থেকে পালানো কোনো আসামিকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। সাইয়ারা হেচকা টান দিয়ে মুনিহা হাত থেকে তার বাহু ছাড়িয়ে নিলো। মুনিহার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে হাটা শুরু করে। পিছু পিছু আসে নায়লাও। ঘরের পেছনে এসে থেমে যায় সে। সাইয়ারা ভালো করেই জানে আজকে কি হতে চলেছে। সাইয়ারাকে দেখেই মাজেদা চেচাতে শুরু করলো।
- উুই যে আইছে। ইট্টু হলুদ বাইট্টা দিবার কইসলাম। কিরুম কইরা আমার সামনে দিয়া গেলো গা। অনেক অহংকারী অইয়া যাইতাছে দিন দিন। একটা কুনু কাম হেরে দিয়া অই না। আজকে সামনে দিয়া গেছে গা। কবে না মুহের উপরে কতা কইয়া বইয়া থাহে।
জেঠির কথা শুনে সাইয়ারার কিছুটা রেগে গেলো। সে মনে মনে বললো।
*না আমাকে দিয়ে কাজ হয় না। আপনাকে দিয়ে হয়। কাজের যা বাহার। তামশা।*
জামীর মেয়ের ব্যাপারে এসব শোনার পর থেকেই রেগে ছিলেন। মাজেদার পুনরায় বলা কথাগুলো তার ক্রোধ আরো বাড়িয়ে দিলে। সে কর্কশ কন্ঠে বলে উঠলো।
- কি রে তর জেডি তরে কী করতে কইছিলো।
জামীরের গালিটা সাইয়ারার গায়ে লাগলো না। সে বাবার থেকে গালি শুনে অভ্যস্থ। তাই সে চুপচাপ দাড়িয়ে রইলো। সে জানে তার বাবা এখন তাকে ‍ধমক দেবে। বাবা সাইয়ারার উপর রেগে গেলে কী কী বলে সব তার মুখস্থ। সত্যিই সাইয়ারাকে চুপ করে থাকতে দেখে বাবার রাগ আরো বেড়ে গেলো। ধমকের সুরে বললো....
- কী কইছি তরে।
সাইয়ারা মুখে একটু ভয়ের ভাব এনে বললো....
- হলুদ বেটে দিতে।
- দিছোস না কে? সারাদিন কি করছ বাসাত।
সাইয়ারা ছোট করে উত্তর দিলো।
- স্কুলের সময় হয়ে গিয়েছিলো।
সাইয়ারার উত্তরে জামীরের ধমকের আওয়াজ আরো উচ্চ হলো।
- ***চ্চা তর বইনের থেইক্কা তর স্কুলো যাওয়া বড়ো অইলো। একদিন স্কুলো না গেলে কী অইতো তর।
এখন সাইয়ারার কোনো কথায় কষ্ট না লাগলেও রাগ হয় খুব। তবু নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্ট করে সে। সাইয়ারাকে আরো বকা খাওয়ানোর জন্য মুনিয়া কাদো কাদো কন্ঠে জামীরকে তার হাত মুখ দেখিয়ে বললো....
- দেহো কাকা কত্তডি র্যা শ বাইরোইছে।
জামীর মুনিহার দিকে ইশারা করে সাইয়ারাকে বললো....
- দেখ কী অইছে ছেড়িডার আর তুই স্কুলো যাইবারগা পারলি। তুই কি মানুষ না পিশাচ।
সাইয়ারা মনে মনে বললো।
*হ্ আমি পিশাচ। পারলে ওরে আমি চুত্রাপাতা লাগাইয়া দিয়াম।*
ফাজেলা মুনিহার বাহু ধরে তাকে সরিয়ে নিলো। তারপর সাইয়ারাকে বললো....
- মাঝে মাঝে তো দেরি কইরাই যাস। আজকে ইট্টু দেরি অইলে কী অইতো? কতহন লাগতো হলুদ বাইট্টা দিতে।
মায়ের কথার জবাবে সাইয়ারা বললো....
- কে জেডির ইট্টু হলুদ বাইট্টা লইলে কি অইতো। এইটুকও করবার পারলো না।
সাইয়ারা কথায় শুনে মাজেদা আহাজারি করতে লাগলো।
- আল্লাহগো সামান্য ইট্টু হলুদ বাইট্টা দিবার কইছিলাম দেইখ্খা। ইত্তানি একটা ছেড়িয়ে কী কয় আমারে।
বলে কান্না করার ভান করতে থাকে মাজেদা। জামীর সাইয়ারাকে চর মারতে গেলে তাকে কেউ আটকে দেয়। জামীর ছোটার জন্য ঝটফট করতে থাকে আর চিৎকার করে বলতে থাকে।
- ***চ্চা এই শিখতাছস স্কুলো যাইয়া। যাওন লাগতো না তর স্কুলো।
- শান্ত হও জামীর। অনেক উত্তেজিত হয়ে গেছো তুমি। এবার শান্ত হও।
লোকটির কথায় ধীরে ধীরে শান্ত হলো জামীর। সাইয়ারার কাধে কেউ হাত রাখলে ঘুরে তাকিয়ে বোরকায় আবৃত প্রিয় একজনকে দেথে খুব খুশি হলো। খাম্মু বলে জড়িয়ে ধরলো ফাওযীয়াকে। বাড়ীর পরিস্থিতি স্বভাবিক হলো ফাওযীয়া ও এনায়েতকে দেখে। ফাওযীয়া সাইয়ারাকে নিয়ে সাইয়ারার ঘরে নিয়ে যায়। সাথে নায়লাও যায়। বাড়িতে ঢোকার সময় দূর থেকে মেয়েকে উঠানের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফাওযীয়া আর এরফান। সরু রাস্তাটা দিয়ে এগোতে এগোতে তাদের চোখে পড়ে মেয়ের অশ্রুশিক্ত দৃষ্টি। এতেই বুঝে যায় সাইয়ারার বিপদের কথা। সবাই সবার ঘরে চলে যায়। জামীর এরফানের সাথে খোশগল্পে মেতে উঠে। কথা-বার্তার এক পর্যায়ে এরফান জামীরকে বলে....
- মেয়েটা ‍পেছনের দিকে একা একা থাকে ‍মেয়েটাকে তো এদিকে নিয়ে আসতে পারো।
জামীর মিনমিনিয়ে বলে....
- এইনো আর জায়গা কই। আর ছেড়ির অইনো সমস্যা অইলে কইতোই তো।
এরফান মনে মনে বললো।
*হয়তো পারতো যদি তোমরা তাকে কাছে রাখতে। বাবা হয়েও তুমি তোমার মেয়েকে বুঝতে পারো না যে মেয়েটা তোমাদের নিজের অসুবিধা বলতে চায় না বা তোমরা তার অসুবিধার গুরুত্ব দাও না।*
- তোমার বড় ভাইয়ের ছেলেটাতো বড় হয়েছে। সে তো থাকতে পারে। তার আর সাইয়ারার ঘরটা অদল-বদল করে দিতে পারে।
এরফানের মতামতটা মটেও ভালো লাগেনি জামীরের। সে বললো....
- ছেড়াডা তো বড় অইছে হের নিজের একটা ইচ্ছা-অনিচ্ছা আছে না। অহন কি আর আমরা হেরে জুর করবার পারি। তাছাড়া হেই দিগে সাইয়ারা মা-জেডিরা কাম কাজ করে।
জামীরের কথায় এরফান খুব হাসি পেল। নিজেকে সামলে মুচকি হাসলো সে।
- তাহলে তোমার বড় ভাইয়ের মেয়েটার ঘরে তো থাকতে পারে। শুনেছি সে একাই থাকে।
- পারে হয়তো। কিন্তু হের ঘরডাও ছুডু হের জিনিসপত্র রাইখ্খা সাইয়ারার জিনিসপত্র আটতো না।
জামীরের কথা শুনে এরফান মনে মনে খুব হাসলো আর বললো।
* হায়রে মানুষ অন্যের ছেলের সুবিধা-অসুবিধা ঠিকই বোঝে শুধু বোঝ না নিজের মেয়েকে। বুঝবেই বা কিভাবে তোমাদের মাঝে অনেক দুরুত্ব। যা তোমরা সবাই মিলে তৈরি করেছো। ভুগতে হচ্ছে শুধু সাইয়ারাকে। অবহেলা আর অতিরিক্ত শাষন মানুষকে পাথর বানিয়ে দিতে পারে। একদিন না এর ফল তোমাদের ভোগ করতে হয়।*
এরফান আর কথা বাড়ালো না। তার ভালো লাগছে না এমন চিন্তা-ভাবনার মানুষের সাথে কথা বলতে।
- সাইয়ারা তু্ই এসব বন্ধ করবি। বড় হয়ে গেছিস না। মার খাবি কিন্তু।
ফাওযীয়ার কথায় কান দিচ্ছে না সাইয়ারা। তার খালা আর খালু এসেছে দেখে সে রান্নার ব্যবস্থা শুরু করে দিয়েছে। ফাওযীয়া তাকে না করছে সে শুনছে না। ফাওযীয়াও তার উপর রেগে পাশ থেকে বটি নিয়ে মাছ কাটা শুরু ‍করে দিয়েছে। টাটকা মাছ একটু আগে পুকুর থেকে ধরে এনেছে সাইয়ারা। খালাকে মাছ কাটতে দেখে সাইয়ারা বটিটা নিয়ে নিতে চাইছে কিন্তু ফাওযীয়া দিচ্ছে না।
- খাম্মু বডিডা দেও আমি করবার পারবাম।
- না দিতাম না। তুই আমার কথা শুনছোস।
সাইয়ারা ফাওযীয়ার কাছে হার স্বীকার করলো।
- আইচ্ছা আমি অহন রানতাম না। হুদা চা বানাইয়াম। অহন তো দেও।
ফাওযীয়া মাছ কাটা বন্ধ করে বললো....
- আইচ্ছা তুই চা বানা অতহন আমি এইডি কাডি। এমনে তো তুই করছই। আজকে ইট্টু কম করলে কিছু অইতো না।
সাইয়ারা কিছু বলতে গেলে ফাওযীয়া তার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো। তাই সাইয়ারা আর কিছু বললো না। কিছুক্ষণ পর ফাজেলা এসে তার আপাকে মাছ কাটতে দেখে সাইয়ারাকে বকতে শুরু করলো। ফাওযীয়া তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো....
- ছেড়িরে বকবি না। আমি নিজেই মাছ কাটবার লইছি। আমি আইছি কহন আর তুই অহন আইছোস আমার সাথে দেহা করবার।
ফাওযীয়ার কথায় ফাজেলার মুখটা কালো হয়ে গেলো। ফাজেলার চিৎকার শুনে মাজেদা আর মুনিহাও সেখানে চলে এলো কী হয়েছে দেখতে। এসেই ঠেস দিয়ে দিয়ে কথা বলতে শুরু করলো তারা।
- আঙ্গর বাড়িত্তে মানুষ আইলে আমরা কাম করবার দেই না। আর হেরাও কাম করবার বইয়া পড়ে না। হে গোর একটা স্টেটাস আছে। না মা।
মেয়ের কথায় মাজেদা মাথা নেড়ে সায় দিলো। মায়ের হাতে চায়ের ট্রে ধরিয়ে দিয়ে বাবা আর খালুকে দিতে বললো। ফাজেলা চলে গেলো। তারপর মুনিহাকে বললো....
- অতো স্টেটাস-ফিস্টেটাস আঙ্গর পুষায় না। আমরা সাধারণ মানুষ।
মুনিহা মুখ বেকিয়ে বললো....
- স্টেটাস সবার লাইগ্গা না। হুদা ভি আই পিগর লাইগ্গা। যেইডা আমরা।
মুনিহা আর মাজেদার মুখে ফুটে উঠে অহংকারের হাসি। তাদের কথায় সাইয়ারাও বাকা হাসি দিলো। সাইয়ারার হাসি দেখে নায়লা বুঝে গেলো এখন সাইয়ারা এমন জবাব দেবে যা মুনিহাদের জন্য মোটেও খুশির হবে না। তাই সেও মুচকি হাসলো।
- তোরা কি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ভি আই পির বড় ভি আই পি। আইচ্ছা ক তো বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ভি আই পি কেডা?
সাইয়ারার কথায় মুনিহা চুপ করে গেলো।
- কইবার পাইলি না তো। আইচ্ছা আমি কইতাছি।
সাইয়ারা বাকা হাসি দিয়ে বললো....
- বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ভি আই পি অইলো কু*ত্তা। হেরে দেখলে সবাই জায়গা ছাইড়া দেয়। বিশ্বাস না অইলে চল দেহাইয়া আনি।
অপমানে মাজেদা আর মুনিহার মুখ থমথমে হয়ে গেলো।
- তরা কি হের থেইক্কাও বড় ভি আই পি।
সাইয়ারার, নায়লা ও ফাওযীয়া স্বমস্বরে হেসে উঠলো।
চলবে....
[বি.দ্র: এখানে জরুরি কাজটা হলো সালাত। সালাত হলো আল্লাহর কাছে পৌছানো, কিছু চাওয়ার মাধ্যম। আমরা কিছু করলে বা কোথাও গেলে সেটা কাওকে বলতে যায় না। কারণ সেটা আমাদের ব্যাক্তিগত ব্যাপার। এর থেকেও ব্যাক্তিগত হলো ইবাদত। তাই গল্পে সরাসরি সালাত/ইবাদতকে তুলে ধরবো না। “ওয়াক্ত” বা “জরুরি কাজ” দিয়ে বোঝাবো। যেহেতু গল্পটা সামাজিক তাই গল্পের স্বার্থে কোনো কোনো জায়গায় গা*লি ব্যবহার করতে হতে পারে।]
688 Views
14 Likes
1 Comments
4.9 Rating
Rate this: