আমি মুখে দিদিমার তৈরি আমের আচার নিয়ে হাঁটছি মেলার মাঠের পাশ দিয়ে,যাচ্ছি আমরা তিন বন্ধুর আড্ডাস্থল খানবাবুদের পুকুরপাড়ে থাকা বেলগাছটার নীচে। অনেকেই বলেন বেলগাছে নাকি ভূত থাকে,তবে আমাদের দলের লিডার গদাইদা ওরফে গদাধর শর্মা - র ভূতের ভয় নেই তেমন,অবশ্য যে ছেলে ইতিহাসের শিক্ষক মোহনবাবুর রক্তচক্ষুকে ভয় করে না,সে ভূতকে ভয় পাবে কোথা থেকে! তাই মনে সামান্য ভয় থাকলে বেলতলাকেই আড্ডাস্পট হিসেবে মেনে নিতে হয়েছে।অবশ্য জায়গাটা মন্দ নয়,পুকুরপাড়ের স্নিগ্ধ পরিবেশ,চারদিক খোলা ,সুতরাং গদাইদার মেজকাকু কিংবা আমাদের বাড়ির কেউ এলে পালিয়ে যাওয়া সহজ;তাছাড়া মরসুমের সময় বিনামূল্যে বেল-ও পাওয়া যায়। তো আজ বেলতলাতে হাজির হয়ে দেখি গদাইদা ও আমাদের দলের অন্য সদস্য বাবলু সেন এর মুখটা খুবই গম্ভীর।যে ছেলে একই ক্লাসে তিন বার ফেল করেও চিন্তিত হয় না,সেই গদাই শর্মা কি কারণে এত চিন্তিত ! জিজ্ঞেস করলাম - কি হয়েছে? ' কিছু হয়নি , তবে এবার হবে , গদাইদার শ্রাদ্ধ ' -- বাবলু বক্তব্যের ভঙ্গিতে মন্তব্য করলো।
--- দেখ বাবলু,বেশি বাড়াবাড়ি করিস না,নাহলে কিল মেরে তোর কোরমা বানাতে সময় লাগবে না । এমনিতেই মেজাজ খারাপ, তার মাঝে...
--- বাদ দাও তো ওর কথা , আমি বললাম। মেজাজটা কেন খারাপ সেটা বলো তো, দেখি কোনো সমাধান দিতে পারি কি না ।
এই কথায় ভয়ানক রেগে উঠলেন গদাইদা । দাঁত খিঁচিয়ে বললেন, যে ছেলে অঙ্কের সহজ প্রশ্ন সমাধান করতে পারে না সে কি না সমাধান করবে গদাই শর্মার সমস্যা । বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল ' আমি তো শুধু অঙ্কেই কিছুটা কাঁচা, বাকি বিষয়গুলোতে টেনেটুনে হলেও পাস তো করি , তোমার মতো একই ক্লাসে তিনবার... ' , কিন্তু বললেই যে কিলটা পড়বে সেটা আমার শরীরের পক্ষে মোটেই সুখকর হবে না । তাই বললাম - পণ্ডিতমশাই কি কান মলে দিয়েছেন ? হঠাৎ করে আমাদের আর্মি কমান্ডারের মতো গুরুগম্ভীর গদাইদা যেন বাচ্চা ছেলের মতো কাঁদ কাঁদ হয়ে বললেন , ' মেজকাকু বলেছে এইবার পাস না করলে পলাশপুর কারখানার কাজে পাঠিয়ে দেবেন , বল হারু ( অর্থাৎ আমি অর্থাৎ হারুকিশোর দাশগুপ্ত ) , এ কি আমার মতো নিষ্পাপ শিশুর প্রতি অন্যায় নয় ? শিশুশ্রমিক আইনগুলো কি সব হারিয়ে গেছে ? ' এতক্ষণে ব্যাপারটা আমার বোধগম্য হলো। মনে মনে বললাম --- শিশুশ্রমিক আইন শিশুদের জন্য,তুমি ক্লাস নাইনে পড়লে কি হবে , তোমার বয়স তো সতেরো । কিন্তু মুখে বললাম --- এ তো ঘোর অন্যায় । গদাইদা আমার কথাটা যেন শুনতেই পেলো না ,বললো --- বুঝলি,এবছর যেমন করেই হোক, পাস করতেই হবে।
কিছুক্ষণ আমাদের আলোচনা চললো কীভাবে পরীক্ষার পাস করা যায় এই বিষয়ে । আলোচনার সিদ্ধান্তটা নিম্নরূপ :-
অর্থনীতি , ইংরেজি ( বাবলু পাস মার্কের ব্যবস্থা করবে)
বাংলা,বিজ্ঞান ( হারুর দায়িত্ব )
ভূগোল ( গদাইদার গতবৎসরের টুকলি আছে )
কিন্তু হতচ্ছাড়া ইতিহাস আর গণিতের কি হবে? গদাইদার কণ্ঠে ভয় মিশ্রিত রাগ।কি লাভ হয় ইতিহাস চর্চা পড়ে, ক্রিকেট,কাবাডি এসব খেললে শরীরচর্চা হয়, দুটো সাবজেক্ট স্পোর্টস এর উপর রাখলেই তো হয়; কিন্তু না, বসে বসে শিবাজীর চৌদ্দ গোষ্টির নাম মুখস্থ করো,যত্তসব। ' ইতিহাস আমাদের অতীত থেকে শিক্ষা ... '
এতটুক বলে থামতে হলো। কারণ গদাইদার মেজাকাকুর দখ শোনা যাচ্ছে ' গদাধর , অ্যাই গদাধর ' । সুতরাং সেদিনকার মতো আলোচনা ভঙ্গ হলো ।
যথারীতি পরীক্ষার দিন উপস্থিত । অর্থনীতি, ইংরেজী,বিজ্ঞান এবং ভূগোল পরীক্ষা নির্বিঘ্নেই কেটেছে। পাস করে নেব। কাল গণিত,তারপর বাংলা , তারপর ইতিহাস । যেহেতু ক্লাসের পেছনদিক থেকে প্রথম তিনজন ছাত্র হলাম যথাক্রমে গদাইদা,আমি ও বাবলু,তাই পরীক্ষায় বাবলু আমার আগে ও গদাইদা আমার পিছনে থাকে।অঙ্ক পরীক্ষার দিন যে যা পারি করে নিলাম। একটি অঙ্কের উত্তর জিজ্ঞেস করলাম গদাইদাকে -
--- বারো নম্বর প্রশ্নের উত্তরটা কত ?
--- ১২৪০
--- সে কী! আমার যে ৬৫৯ এসেছে ।
যেহেতু এই ক্লাসে এখন পর্যন্ত অঙ্কে গদাইদার সর্বোচ্চ মার্ক বত্রিশ,তাই বাবলুকে জিজ্ঞেস করলাম , প্রত্যুত্তরে জানলাম তার উত্তর এসেছে জিরো অর্থাৎ শূন্য।তিনজনের মধ্যে কারটা শুদ্ধ তা জানার জন্য পাশের ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম ,তবে যা উত্তর শুনলাম তা মোটেই আশা করিনি।অন্যান্য ছাত্রদের মাধ্যমে স্পষ্ট হলো আমরা তিনজন ব্যতীত সবার উত্তর এসেছে ' x+2y ' ; রেগেমেগে পুরো অঙ্কটি কাটতে গিয়েও কাটলাম না,ভাবলাম এত কষ্ট করে করেছি , চারের মধ্যে দুই তো নিশ্চয় দিবেন।
বাংলায় আমি যথেষ্ট ভালো । তাই পরীক্ষা ভালোই হলো।একশো-র মধ্যে সাতচল্লিশের উত্তর করেছি। আমার ঠিক পেছনে বসা গদাইদা আমার পুরো খাতাটার হুবহু নকল করেছেন, তাই তার উত্তর করার সংখ্যাটাও সাতচল্লিশ ।বাবলু আমার আগে বসায় বার বার পিছন ফিরে তাকাতে সমস্যা হয়,তাই সে চল্লিশের উত্তর করতে পেরেছে।যায় হোক,বাংলা নিয়ে চিন্তা না করলেও চলবে।
বিপত্তি বাঁধল ইতিহাস পরীক্ষায়।ঘুম থেকে উঠতে বেশি দেরি হওয়ায় গদাইদা কিছু না খেয়েই পরীক্ষায় এসেছেন,মেজাজটা জিলিপির কড়াইয়ের মতো গরম। তার উপর পরীক্ষক হিসেবে উপস্থিত হলেন অত্যন্ত কড়া শিক্ষক কঙ্কনকিশোরবাবু ।
পরীক্ষার চল্লিশ মিনিট যেতে না যেতেই পিঠে একটা ধাক্কা খেয়ে পিছনদিকে তাকাতেই দারোগার মতো প্রশ্ন ছুড়লেন গদাইদা --- জাহাঙ্গীরের বাবার নাম কি রে ? --- কোন জাহাঙ্গীর ? জকিগঞ্জের না গাছতলাহাটের জাহাঙ্গীর ? --- আরে,মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর । গদাইদা খেঁকিয়ে উঠলো। আমি বললাম --- তা আমি কি করে বলবো ? আমি কি তখন ছিলাম নাকি ? স্যার আমাদের দিকে কড়া চোখে চেয়ে আছেন দেখে চুপ করে গেলাম ।পরীক্ষা শেষ হবার কয়েক মিনিট আগে গদাইদাকে ঝটপট কয়েকটা উত্তর দেখিয়ে দিলাম । স্যারের কান খুব পাতলা ,তাই খুব ধীরে কথা বলতে হচ্ছিল ।
পরীক্ষা থেকে বের হয়ে গদাইদা জিজ্ঞেস করলেন --- হ্যারে হারু,ইতিহাসের পরীক্ষায় মোগলাই , বিড়ি এসব কথা থেকে এলো? আমি জিজ্ঞাসু চোখে প্রশ্ন করলাম --- এসব কোথায় পেলে ? --- তবে তুই যে বললি ' মোগলাই বিড়িদের কাছে বক্সিং-এ হেরে যাওয়ায় ভারত স্বাধীন হলো ' ।
আসলে হয়েছিল কি,আমি বলেছিলাম," মোগলরাই ব্রিটিশদের কাছে বক্সারের যুদ্ধে হেরে যাওয়ায় ভারত পরাধীন হলো।" কিন্তু গদাইদা বোধহয় সঠিকভাবে শুনতে পাননি; তার উপর সকালে খালি পেটে আসার ক্ষুধার মধ্যে শুধু খাবারের চিন্তা মাথায় আসছিল , তাই বোধহয় ... !
মাথার মধ্যে তখন কয়েকটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল । গদাইদা কি এবারও ... ? তার মানে তাকে কারখানায় কাজ করতে যেতে হবে ? তখন তিনি আমার উপর কি অ্যাকশন নেবেন ? ইত্যাদি ইত্যাদি ... ।
আপনাদের একটি লাইক , রেটিং , শেয়ার আমাদের অনেক উৎসাহিত করে। লাইক কমেন্ট শেয়ার রেটিং করবেন প্লীজ।
গদাইদার পরীক্ষা
অডিও মোড
00:00
00:00
গতি:
ভলিউম:
304
Views
6
Likes
4
Comments
4.8
Rating