পৃথিবীর সুখী মানুষ

অডিও মোড

00:00 00:00
গতি:
ভলিউম:
প্রত্যন্ত গ্রামের এক কোণে, নদীর তীরে এক আশ্রমে বাস করতেন সাধু । শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন অন্তর্মুখী এবং ধ্যানমগ্ন। জীবনের নানা উত্থান-পতন তাঁকে ধীরে ধীরে ঈশ্বরের দিকে আকৃষ্ট করে। তিনি পৃথিবীর মোহ-মায়া ত্যাগ করে গুরুর আশ্রয়ে সাধনা শুরু করেন। গুরুদেবের কাছ থেকে যোগ, ধ্যান এবং তপস্যার জ্ঞান লাভ করে তিনি নিজের জীবনকে সাধনার পথে নিবেদিত করেন।


সাধু কেন দুনিয়া ভুলে থাকেন? তার মতে, এই দুনিয়া মায়াময়, যা মানুষকে প্রকৃত সত্য এবং শান্তি থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে পৃথিবীর সবকিছুই ক্ষণস্থায়ী, যা মানুষের মনে অসন্তোষ এবং অস্থিরতা সৃষ্টি করে। সাধু বলেন, "এই পৃথিবীর সবকিছুই ক্ষণস্থায়ী। সম্পদ, সম্পর্ক, ক্ষমতা, সবকিছুই একদিন বিলীন হয়ে যাবে। কিন্তু ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্ক চিরস্থায়ী এবং এতে প্রকৃত সুখ পাওয়া যায়।

সাধুর মতে, জাগতিক বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ মানুষকে আসল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করে। তাই তিনি নিজেকে দুনিয়ার মোহ-মায়া থেকে দূরে রেখেছিলেন এবং নিজের অন্তরের আনন্দের সন্ধানে ব্রতী ছিলেন।


সাধু বেশিরভাগ সময় নিরব থাকতেন। নিরব থাকার পিছনে তার এক গভীর অর্থ ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, কথার মাধ্যমে মন সহজেই অস্থির হয়ে ওঠে এবং ধ্যানস্থিরতা নষ্ট হয়। তিনি বলেন, "শব্দ মানুষের মনকে ব্যস্ত করে রাখে। নিরবতা মনকে স্থির রাখে এবং ঈশ্বরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে।"

সাধুর নিরবতা ছিল তার অন্তরের শান্তি এবং গভীর ধ্যানের প্রতিফলন। তিনি মনে করতেন, নিরবতার মধ্যে এক অপার শক্তি নিহিত আছে, যা মনের স্থিতি বজায় রাখতে সহায়ক। তার নিরবতা ছিল এক ধরনের গভীর চিন্তাশক্তি এবং আত্মনিমগ্নতা।


সাধুর কোনো চাওয়া-পাওয়া ছিল না। তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল ঈশ্বরের সাধনা এবং আত্মার মুক্তি। তিনি পৃথিবীর কোনো বস্তুগত সম্পদ, ক্ষমতা বা খ্যাতির প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন না। তার মতে, এসব চাওয়া-পাওয়া মানুষকে দুঃখ এবং অসন্তোষের দিকে নিয়ে যায়। সাধু বলেন, "যতক্ষণ মানুষের চাওয়া-পাওয়া থাকবে, ততক্ষণ সে দুঃখী থাকবে। আসল সুখ হলো চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে থাকা।"


সাধু কি সুখী ছিলেন? হ্যাঁ, তিনি ছিলেন। তার সুখ ছিল অন্তরের শান্তি এবং ঈশ্বরের সঙ্গে সংযোগে। বাহ্যিক কোনো বস্তু বা অবস্থার সঙ্গে তার সুখের কোনো সম্পর্ক ছিল না। তিনি বলেন, "সুখ হলো অন্তরের এক অবস্থা। তা বাহ্যিক জগতে নয়, নিজের অন্তরে পাওয়া যায়।"

সাধুর সুখ ছিল তার নিরব সাধনার ফল। তিনি প্রতিদিন ধ্যান এবং যোগাভ্যাসের মাধ্যমে নিজের মনকে স্থির রাখতেন এবং অন্তরের সুখ অনুভব করতেন। তার জীবন ছিল এক জীবন্ত প্রমাণ যে সত্যিকারের সুখ এবং শান্তি বাহ্যিক জগতের চাহিদা মেটাতে গেলে নয়, বরং অন্তরের গভীরে ডুব দিয়ে পাওয়া যায়।


সাধু খুব কম কথা বলতেন, কিন্তু যখনই তিনি কিছু বলতেন, তা শুনতে মধুর লাগত। তার বচনে ছিল মাধুর্য এবং গভীরতা। তিনি সহজ ভাষায় গভীর সত্য প্রকাশ করতেন, যা শুনে মানুষের মন আলোকিত হয়ে উঠত। তার বচন ছিল হৃদয়স্পর্শী এবং মঙ্গলময়। গ্রামের লোকেরা তার কাছ থেকে শিক্ষা নিতে আসতো এবং তার বচন শুনে মুগ্ধ হতো।


সাধু সাধনা ছিল অন্তর্দর্শন এবং আত্মানুসন্ধান। তিনি প্রতিদিন নিরব ধ্যানে বসে নিজের অন্তরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতেন। তার সাধনার মূল উদ্দেশ্য ছিল ঈশ্বরের সঙ্গে মিলন এবং আত্মার মুক্তি। তিনি মনে করতেন, জীবনের প্রকৃত অর্থ হলো আত্মার মুক্তি এবং ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্ম হওয়া।

তার সাধনা ছিল কঠোর এবং নিবেদিত। তিনি দিনের অধিকাংশ সময় ধ্যান এবং যোগাভ্যাসে কাটাতেন। তার সাধনার মাধ্যমে তিনি নিজেকে পরিপূর্ণ করতেন এবং অন্তরের শান্তি লাভ করতেন।


সাধু জীবনের শেষ দিনগুলোও নিরব সাধনায় কেটেছিল। একদিন, তিনি নিরবেই মহাপ্রয়াণ করলেন। তার মৃত্যুর পরেও তার আশ্রম এবং তার জীবনের শিক্ষা গ্রামের লোকেদের মধ্যে অনুপ্রেরণা যোগাতো। তার নিরব সাধনা এবং আত্মত্যাগের গল্প প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ে।



সাধু জীবন একটি নিদর্শন যে নিরবতা এবং আত্মসাধনার মাধ্যমে কিভাবে প্রকৃত সুখ ও শান্তি লাভ করা যায়। পৃথিবীর মোহ-মায়া ত্যাগ করে অন্তরের সুখ সন্ধানে নিবেদিত জীবনই ছিল তার সত্যিকারের আদর্শ। তার নিরবতা, সাধনা এবং অন্তর্দর্শনের মাধ্যমে তিনি এক অপূর্ব শান্তি এবং সুখ লাভ করেছিলেন, যা আজও মানুষের মনে অনুপ্রেরণা জোগায়।
160 Views
1 Likes
1 Comments
5.0 Rating
Rate this: